Ameen Qudir

Published:
2020-02-20 02:31:48 BdST

পর্ব -১ বাংলাদেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং প্রশ্নবিদ্ধ চিকিৎসা শিক্ষার মান


লেখক

ডা সুরেশ তুলসান
____________________

বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সমুহের মানোন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রনে কমিটি গঠন করা হয়েছে এরকম একটা খবর পড়েছিলাম বেশ অনেকদিন আগেই।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন চিকিৎসা শিক্ষার মান নিয়ে কোনরকম আপোষ করবে না সরকার।
সম্প্রতি মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, মেডিকেল শিক্ষার উচ্চ মান রক্ষার স্বার্থে যত্রতত্র মেডিকেল কলেজ করার অনুমতি দেওয়া হবে না।
তবে দৃশ্যমান কোন কোন এক্টিভিটি এখনো চোখে পড়লো না।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সমুহের শিক্ষার মান এখন সর্বজন বিদিত প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়।
এবং এর কারন সমূহও মোটামুটি সকলেই জানেন অথবা অন্তত অনুমান করতে পারেন।
 
প্রথমেই আসা যাক যথাযথ চিকিৎসা শিক্ষার জন্য অত্যাবশকীয় এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ গুলো কি কি?
 
১) শিক্ষক, অর্থাৎ মেডিকেল গ্রাজুয়েট এবং উচ্চতর ডিগ্রির জন্য প্রশিক্ষণরত এবং উচ্চতর ডিগ্রী সম্পন্ন একসেট দক্ষ ডাক্তার গন।

২) রোগী ( একেকটি রোগী যেন একেকটি জীবন্ত বই ).
৩) অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা।
৪) পুস্তক এবং জার্নাল।
৫) শিক্ষা এবং চিকিৎসা উপকরণ।
৬) ব্যাবচ্ছেদের জন্য মানুষের মরদেহ এবং মানব কংকাল ।
৬) ভালো মানের মেধাবী সহপাঠীগণ এবং সিনিওর ভাই /বোনেরা।
এবার আলোকপাত করা যাক বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সমুহে শিক্ষক স্বল্পতার কারন সমূহের প্রতি।
১) কলেজ মালিকদের অতিমাত্রায় ব্যবসায়িক মনোভাব।
যার ফলে প্রয়োজনের তুলনায় অল্প সংখক শিক্ষক নিয়োগ।
শিক্ষকদের মানের চাইতে তুলনামূলক কম বেতনের দিয়ে নজর। ফলে নিম্নমানের শিক্ষক নিয়োগ।
রেগুলার শিক্ষক মণ্ডলীর বদলে খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ ।
এমনকি যদি শোনা যেত, লেকচার প্রতি পেমেন্ট, অর্থাৎ দিনমজুরও না, প্রকৃতপক্ষে ঘন্টা মজুর হিসাবে নিয়োজিত শিক্ষক - তাতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিলো না।
তবে এমনও অনেক কলেজ মালিক আছেন যাদের শিক্ষার মানের প্রতি যথেষ্ট সদিচ্ছা এবং আন্তরিকতা আছে, কিন্তু অনেক টাকা বেতন ও অন্যান্ন সুযোগ সুবিধা দেয়া সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভালো শিক্ষক তারা পান না।
তার কারন সমুহ--

(১) শিক্ষক স্বল্পতা।
বেসরকারি মেডিকেলের তুলনায় বেতন ভাতা অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও সরকারি চাকুরীর প্রতি বাংলাদেশের ডাক্তারদের আগ্রহের অনেক গুলো যুক্তি সংগত কারন আছে। এবং সেগুলো হলো --

ক) চাকুরীর নিশ্চয়তা।
খ) ডেপুটেশন এর মাধ্যমে চাকুরীরত থাকা অবস্থায় উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য পড়াশুনার এবং প্রশিক্ষণের সু্যোগ।
গ)সরকারি চাকুরীর একটা আলাদা বাড়তি সামাজিক মর্যাদা।
ঘ)সরকারি কর্মস্থলে কাজের মাধ্যমে খুব দ্রুত পরিচিতি পাওয়ার সম্ভাবনা।
গ) বেসরকারির তুলনায় সরকারি হাসপাতালে একাডেমীক পরিবেশে কাজ শেখা, কাজ করা ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ।
ঘ) রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, এবং সরকারি মেডিকেল কলেজে চাকুরীরত একজন চিকিৎসকও যেহেতু জনগণেরই একজন সদস্য তাই সে সরকারি হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজকে আপনার প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভাবতে পারে এবং নিজেকে একজন চাকর না ভেবে প্রকৃত অর্থে একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা ভেবেই রাষ্ট্রের সেবায় স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ পায় যেটা বেসরকার মেডিকেল কলেজে কল্পনাতীত।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সমুহে সরকারি মেডিকেল এর তুলনায় অনেক মোটা বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সত্ত্বেও ডাক্তারদের অনিহার বাড়তি কারন সমুহ।
ক) সরকারি চাকুরীর তুলনায় বেসরকারি চাকুরিতে উপরোল্লিখিত সুযোগসুবিধা সমূহের অভাব।
খ) বেসরকারি মেডিকেলে চাকুরীর ক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠানে মালিক চাকর সুলভ সম্পর্ক।
গ) মালিক পক্ষ থেকে খারাপ আচরন।
ঘ)যখন তখন চাকুরী খোয়ানোর সম্ভাবনা।
উঁ) উপযুক্ত একডেমিক পরিবেশের অভাবে কাজ শেখা ও দক্ষতা অর্জনের সীমিত সুযোগ।

সরকারি মেডিকেল কলেজ সমুহে শিক্ষকদের যোগান আসে সরকারি চাকুরীতে নিয়োজিত হাজার হাজার চিকিৎসকদের সমন্নয়ে গঠিত অনেক বড় একটা পুল থেকে এবং এদের সকলেই বেশ প্রতিযোগিতা মুলক বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্ত প্রকৃত মেধাবী চিকিৎসক।
যেখান থেকে পোস্টিং বা বদলি, ডেপুটেশন, ওএসডি, বা এটাচমেন্ট এত মাধ্যমে সহজেই শিক্ষকদের অভাব পুরন করা সম্ভব।
তদুপরি উচ্চশিক্ষার জন্য ডেপুটেশন, শিক্ষা ছুটি, প্রশিক্ষন ইত্যাদির মাধ্যমে উচ্চতর ডিগ্রী ধারী দক্ষ শিক্ষক তৈরির বিশাল এক কারখানা বা কর্মযজ্ঞ হচ্ছে সরকারি খাত তাও আবার জনগণের স্বার্থে সম্পুর্ন সরকারি খরচে।

অবশিষ্ট যে সকল চিকিৎসকগন, যারা প্রতিযোগিতামূলক সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় টিকতে পারেননি তারা থাকেন বেসরকারি চিকিৎসক হিসাবে এবং এখান থেকেই যোগান আসে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সমুহের শিক্ষকদের। যদিও ইদানীং কালে এই ট্রেন্ড আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে। অনেকেই এখন সরকারি চাকুরী না করে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষক হওয়া পছন্দ করেন তবে সেটা প্রধানত ঢাকা কেন্দ্রিক।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সমুহে শিক্ষক পাওয়ার আর একটি উপায় হচ্ছে সরকারি মেডিকেল কলেজ সমুহ হতে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ।
তবে সাম্প্রতিককালে সরকারি চাকুরীতে চিকিৎসকদের অবসরের বয়স সীমা বৃদ্ধি এবং যোগ্য শিক্ষকদের এবং বিশেষভাবে বেসিক সাবজেক্ট এর শিক্ষকদের চাকুরির শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে সেটাও দিন দিন কঠিন হয়ে পড়েছে।
উপরন্তু অবসরের পর উনারা খুব বেশিদিন কাজ করতে পারেন না অথবা অনেকেই বয়সের কারণে অসুস্থ থাকেন বিধায় এই নিয়োগের ফলে শুধুমাত্র মেডিকেল কলেজ সমূহ চালু রাখার মত অফিসিয়াল ফরমালিটিজ পুরণ ছাড়া আর কোন একাডেমি উৎকর্ষতা সাধন হয় না।

সরকারি চাকুরীরত একজন চিকিৎসক তার উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং পোস্টে
থাকা অবস্থায় একাধারে ট্রেনিং নেয়া, রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া, এবং তার জুনিয়র ডাক্তারদের ট্রেনিং দেয়ার পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা চালানোর মতো কাজ করে থাকেন, যেন দশভুজা দুর্গা।
অনেক বেসরকারি মেডিকেলে কলেজেই এর নুন্যতম কিছুও নেই ।

যদি কোন গ্রাজুয়েট ডাক্তার বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে চাকুরীরত অবস্থায় উচ্চতর বিষয়ে ডিগ্রী নিতে ইচ্ছুক হন সেক্ষেত্রে প্রায়শই বর্তমান চাকুরীর মায়া ত্যাগ করে, বউ বাচ্চা বাবা মা আত্মীয় পরিজনদের আর্থিক সংকটের মধ্যে ফেলে বেকার হয়ে লেখাপড়া করতে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় আছে বলে আমার জানা নেই।
(১) রোগীর অভাব।

এবার আসা যাক চিকিৎসা শিক্ষার দ্বিতীয় আবশ্যিক উপকরন রোগীর বিষয়ে।
সকলেই জানেন চিকিৎসা শিক্ষা ব্যাবস্থায় একটি অতিব গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যাবশ্যকীয় ব্যাবহারিক উপকরন হলো রোগী।
এক একজন রোগি যেন এক একটি জীবন্ত বই।
একেতো বেসরকারি মেডিকেল কলেজসমুহে রোগীর স্বল্পতা, এবং যাওবা কিছু রোগী তাও আবার উচ্চমুল্যে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা, এবং তাতে আবার ধনী, অভিজাত ক্ষমতাধর শ্রেণীর প্রাধান্য , স্বভাবতই তারা নিজেদের কে চিকিৎসা শিক্ষার উপকরন বানাতে অনাগ্রহী এবং এবিষয়ে ছাত্র এবং শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের প্রতি তাহাদের চরম অসহযোগিতা।
তারপর আবার বেসরকারি মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মত বিভিন্ন প্রকার রোগের এবং বিভিন্ন উপসর্গ সম্বলিত ভিন্নতর ( Multi diversity ) রোগী পাওয়া দুষ্কর।
সুতরাং চিকিৎসা শিক্ষার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবহারিক উপকরণের অভাব মানেই শিক্ষা অপুর্ণতা।

 

ডা সুরেশ তুলসান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়