Ameen Qudir

Published:
2020-02-12 01:09:11 BdST

করোনা ভাইরাসের দিনগুলোতে




ডা. জামান অ্যালেক্স
সুলেখক
________________________

১...

সকাল সকাল মেজাজ খারাপ হচ্ছে। মেজাজ খারাপের অবশ্য যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। চা খাবার সময় এক পাগল-ছাগলের বকবক সহ্য করতে হচ্ছে...

এই ছাগলা আমাদের হাসপাতালে ভর্তি, প্রশাবের রাস্তায় নল-ইউরোব্যাগ লাগানো, সেই নল আর ইউরোব্যাগ হাতে উচুঁ করে ধরে সে সারা এলাকা টইটই করে চষে বেরাচ্ছে...

However, বেটার সাথে কথোপকথনের নমুনা দেই, তাকে ছাগলা বলার কারণ টের পাবেন...

--স্যার, চায়নার বিষয়ডা কি?
--কোন বিষয়?
--'করুনা ভাইরাসে' আসলে মরছে কত?..
--ঠিক বলতে পারি না, তিনশো-চারশো হবে...
--হে হে, কি যে কন স্যার!(কানের কাছে এসে) অলরেডী 'ছয় কুটি' মইরা শেষ...
--বলেন কি!
--কথা সইত্য, যদি বলেন তো কিরা কাইট্যা কইতে পারি...
--কিরা কাটার দরকার নাই, ওয়ার্ডে যান, আপনার মত রোগীর এখানে ঘোরাঘুরি করা ঠিক না...

ওয়ার্ডে যাওয়ার কোন লক্ষণ তার মাঝে দেখলাম না। ছাগলা আমার আরো কাছে আসলেন...

--স্যার, আমাগো দেশের খবর জানেন কিছু?...
--(চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে) হালকা পাতলা কিছু জানি আর কি...
--(আবার কানের কাছে এসে) কিছুই জানেন না স্যার, 'করুনা ভাইরাস' অলরেডী কয়েকজনরে মাটির তলায় কিন্তু হান্দায় দিছে...
--'হান্দায়' দিছে মানে?
-'-হান্দায়' দিছে মানে 'শোতায়' দিছে...

করোনা ভাইরাস এদেশের কয়জনকে মাটির তলায় হান্দায় দেয়াতে তাকে বেশ উৎফুল্ল মনে হলো। সঞ্জীব চট্টপাধ্যায় যথার্থই বলেছিলেনঃ

"পরিচিত কারো খুব বড়ো ধরণের বিপদ হয়েছে, বাঙালির জন্য এর চেয়ে খুশির খবর আর কীইবা হতে পারে..."

আমার চা খাওয়া শেষ, টাকা বের করে দোকানিকে দিতে দিতে বললামঃ"এইসব আজেবাজে কথা কাউকে না বলাই ভালো, পরে গুজব ছড়ানোর দায়ে পুলিশের প্যাঁদানি খেতে পারেন..."

আমি হাঁটা দিলাম। কে শোনে কার কথা! ছাগলা ইতিউঁতি চেয়ে আরেকজনের সাথে তার 'গুপন খবর' শেয়ার করা শুরু করলেন...

গুজব ছড়ানোর মাঝে যে পৈশাচিক আনন্দ আছে সেই আনন্দ হতে বাঙালিকে নিবৃত্ত করা অনেকটা অসম্ভব...

২...

বাঙালি গুজব প্রিয় জাতি এবং গুজব দ্বারা এরা যথেষ্ঠ প্রভাবিত। গুজব কিভাবে ছড়ায় তার নমুনা দিলাম, গুজব দ্বারা কিভাবে প্রভাবিত হয় তার একটা নমুনা দেই...

বিকেলে চেম্বারে রোগী দেখছি। এক রোগী এসে হাজির, গত কয়েকদিন ধরে নাকি বারেবারে প্রশাব হচ্ছে। আমি কথা বলা শুরু করলাম...

--প্রশাবে জ্বালাপোড়া আছে?
--জ্বি না..
--ডায়াবেটিস আছে?
--জ্বি না...

আমি চিন্তায় পড়লাম। প্রশাব বারেবারে হওয়ার আরো কিছু জটিল কারণ আছে, সেগুলোতে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা লাগে...

চিন্তার মাঝেই জিজ্ঞেস করলামঃ ডেইলী কয় গ্লাস পানি খান?

পাশ থেকে রোগীর স্ত্রী এবার জ্বলে উঠলেনঃ "স্যার, এই কয়দিন ধরে গ্লাস না, জগে জগে সে পানি খায়..."

ঘটনা বের হলো। ফেসবুকের মাধ্যমে সে নাকি জানতে পেরেছে গলা ভেজা থাকলে করোনা ভাইরাস শরীরে ঢুকতে পারে না। এরপর থেকে গ্যালনকে গ্যালন পানি সে সাবাড় করে চলছে। করোনা ভাইরাসের এদেশে আসার খবর নাই, এদিকে পানি খেয়ে ধুমায়ে প্রশাব করতে করতে তার জান এখন যায় যায়...

৩...

এদেশের মানুষের হোমিও প্রীতির কথা আমাদের সবারই জানা। গতবার ডেঙ্গুর সময়ে হোমিওর নাকি ধনন্তরী চিকিৎসা বেরিয়েছিলো। করোনা ভাইরাসের অ্যাটাক হবে, আর হোমিওর কেরামতি থাকবে না, সেটা কি হয়?...

রাত ১০ টার দিকে আমার বাসায় এক রিটায়ার্ড আঙ্কেল আসলেন, মুখে মাস্ক লাগানো, সেই মাস্কও তিনি পরেছেন উল্টোভাবে...

--কি ব্যাপার আঙ্কেল, মুখে মাস্ক কেন?...

--আর বইলো না, কয়েকদিন পরপর কিসব করোনা ফরোনা আসে আর আমরা পড়ি বিপদে। সবই গজব। যাই হোক বাবা, তুমি এক কাজ করো, করোনা ভাইরাসের ওষুধটা একটা কাগজে একটু লেইখা দাও...

--ওষুধ দিয়ে কি করবেন?...

--কিনে বাসায় রেখে দেই, কখন না কখন কাজে লাগে, কে জানে! তিন কার্টন মাস্ক কিনা রাখছি, ওষুধটাও কিনা রাখি আর কি...

--আঙ্কেল, নির্দিষ্ট কোন ওষুধ তো নেই...

--এইটা কি বললা! তোমাগো এলোপ্যাথীতে করোনা ভাইরাসের কোন ওষুধই নাই!!! আমার হোমিও বন্ধু তো বললো ওগো নাকি করোনার খুব কার্যকর ওষুধ আছে!...

--(মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে আস্তে আস্তে বললাম)Eyes are useless when the mind is blind...

--বিড়বিড় কইরা কি বললা বাবা!

--কিছু না আঙ্কেল। কয়েক কার্টন হোমিও ওষুধ কিনে রাখেন। আয়ুর্বেদও কিন্তু খারাপ না, একটা খবর নিয়া দেখেন...

--(চোখ চকচক করে)কথা তো খারাপ বলো নাই, আয়ুর্বেদ এর কথা তো মনেই ছিলো না! এই কারণেই তোমার কাছে আসি, ভালো কিছু বুদ্ধি পাওয়া যায়। আয়ুর্বেদ ডাক্তার যে কই পাই...

উনি হোমিও আর আয়ুর্বেদ ওষুধের খবর নিতে বের হলেন, আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম...

৪...

"I always wonder why birds stay in the same place when they can fly anywhere on the earth. Then I ask myself the same question..."

ভয়াবহ ফিলোসফিক্যাল কথাবার্তা মনে হলেও এর উত্তর আসলে খুব সহজ। জীবনধারণের মৌলিক বিষয়গুলো যেখানে পাবে, মানুষ সেখানে তার আসন গাড়বে...

ঘটনাস্থলঃ রংপুর হাসপাতাল...

এক বদ বেশকিছুদিন ধরে রংপুর হাসপাতালের এক বেড দখল করে বসে ছিলো। তাকে নাড়ানোও যায় না, তাড়ানোও যায় না। তিন বেলা হাসপাতালের ফ্রি খাওয়া পেয়ে হাসপাতালকেই সে তার বাড়ি ঘর বানিয়ে ফেলেছে। তিন বেলা খাবার খায় আর লুঙ্গি তুলে ধরে বিভিন্ন বেডে গিয়ে অন্য রোগীর ফিমেল অ্যাটেন্ডেন্ট সাথে খাজুরে আলাপ চালায়...

রংপুর হাসপাতালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে এক রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে শুনে ঐ বদ ১ ঘন্টার মাঝে তার কাথা বালিশ নিয়ে পগারপার। যাওয়ার সময় নাকি ভয়ে ডিসচার্জ পেপারও নিয়ে যায়নি...

চারদিকে করোনা ভাইরাস নিয়ে খালি নেগেটিভ কথাবার্তা শুনি, এক কলিগের কাছ থেকে আজ করোনা ভাইরাসের এই পজিটিভ দিকটাও জানা হলো...

৫...

আরেক বদ এর কথা বলি। এই টাউট এর কাজ হলো সারাক্ষণ ডাক্তারের পিছে লেগে থাকা। কোন এক গার্মেন্টস কোম্পানির ম্যানেজার বা এই টাইপ কিছু একটা হবে। কয়দিন পর পর আমার চেম্বারে এসে ঢু মেরে যান...

কয়দিন আগে এক বিকেলে এই বেটা আমার চেম্বারে ঢু মারলেন, টেবিলের ওপাশের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আমার সাথে কথা শুরু করলেনঃ

টাউটঃশুনলাম, আপনারা নাকি এইবার করোনা নিয়া আসতেছেন?...
আমিঃবুঝলাম না আপনার কথা...
টাউটঃনা, মানে, ডেঙ্গু তো আপনারাই নিয়া আসছিলেন...
আমিঃতাতে আমাদের কি লাভ?
টাউটঃএই ধরেন, এই টেস্ট-সেই টেস্ট, লাভ না আপনাগো...
আমিঃও আচ্ছা, বুঝছি...

আমি আমার ব্যাগ থেকে ছোট ছোট কিছু পাথর বের করলাম, তারপর তার হাতে দিয়ে বললাম, এগুলা ভালো মত দেখেন। উনি ঘুরায়ে ফিরায়ে পাথরগুলো দেখা শুরু করলেন...

--ডাক্তার সাব, এগুলা কি?
--ভালোমত দেখেন..
--দেখলাম তো, কিন্তু জিনিসটা কি?
--করোনা ভাইরাসের শুটকি, পানিতে দিলে এগুলা জীবিত হবে...

"বলেন কি! বলেন কি " বলে উনি পাথর ছু্ড়ে ফেলে চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন...

আমি হো হো করে হাসতে লাগলাম...

সৌদি আরবে "ওয়াদি আল জ্বিন" বলে একটা জায়গা আছে। পাথুরে সেই এলাকায় ঘুরতে গিয়ে ছোট ছোট ভিন্নধর্মী এই পাথরগুলো আমার নজর কেড়েছিলো। কিছু পাথর সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। ব্যাগ থেকে আর বের করা হয় নাই...

৬...

লেখাটা শেষ করি...

করোনার আতঙ্কে আমরা এখন সবাই ভুগছি। আমি জানি এই আতঙ্ক এক সময় কেটে যাবে, Just when the caterpillar thought her life was over, she began to fly...

তবে সেই আতঙ্কের সাথে সাথে বাস্তব জীবনে যে কত ইন্টারেস্টিং ঘটনা জড়িয়ে থাকে সেটি আপনাদের সামনে এক্সপ্লোর করাই ছিলো আমার এ লেখার উদ্দেশ্য...

করোনা ভাইরাস এদেশে আসবে কি আসবে না-সেটা আমি বলতে পারবো না। তবে একটা কথা বলতে পারি। ডেঙ্গুর সময় এদেশের মানুষের সাহায্যে চিকিৎসক ছাড়া আর কাউকে যেমন পাওয়া যায়নি, তেমনি করোনা এলেও এই চিকিৎসকরা নিশ্চিতভাবেই আপনাদের আগলে রাখবেন....

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়