Ameen Qudir

Published:
2019-12-01 06:19:44 BdST

'ওদের শেখাতে পারছি না, কারণ আমরাও জানিনা কি শেখাতে হবে': জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকের উপলব্ধি


ডা. রেজাউল করীম
পশ্চিম বঙ্গের প্রখ্যাত চিকিৎসকনেতা
_______________________

আমার কাছে বাংলা খবরের কাগজ পৌঁছায় না। দেবাদৃতার মৃত্যুর খবরটি তাই সবিস্তার জানা ছিল না। ওর মুখটি ঠিক মনে করতে না পারলেও ঐ সময়ে সাগরদত্তের সব ছাত্রছাত্রীদের চিনতাম। হাসিখুশি তরতাজা ছেলেমেয়ের দল। অথচ সে আর তার পুরো পরিবার একসাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
আমরা যখন চিকিৎসা বিদ্যাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম, সেই আশির দশকে, তখন চিকিৎসকদের সামাজিক মান-মর্যাদা যেমন ছিল, তেমনি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও গ্রাস করে নি। তখন চিকিৎসকদের হাতযশের যুগ, যন্ত্র-যশ তার থাবা তখন সবে দেখাতে শুরু করেছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠা শুধু অর্থ দিয়ে হয় না, তার জন্য সমাজকে বোঝার ও সমাজের বাইরে থেকে নয় তার একজন হিসেবে তার শরিক হওয়ার শিক্ষা তখনো দেওয়া হতো। ছাত্রছাত্রীদের এক বিরাট অংশ আসতেন নিম্ন, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে, গ্রাম থেকে, খেটে খাওয়া শ্রমিক পরিবার, মধ্যবিত্ত কেরানি বাড়ী থেকে। একক সন্তানের স্বার্থপর পৃথিবী, বিত্তের ছোঁয়া পাওয়া কোচিং সেন্টারের গণ্ডি কাটা জীবন তখন ছিল না। তখন জীবনে বসন্ত আসতো, পড়ার খাতায় কবিতা প্রজাপতির মত ডানা মেলতো। পরীক্ষায় ১০০ই ১০০ পাওয়া ছেলেটা ফুটবলে পা রাখলে তাকে হারানো মুস্কিল ছিল, গানের গলায় ফার্স্টগার্ল সবাইকে অনায়াসে হারাতে পারতো। এখন ১০০ই ১০০পাওয়া, কানে ইয়ারফোন গোঁজা ছেলেমেয়েদের দেখলে সেদিনটা স্বপ্ন মনে হবে।
এখনকার ছেলেমেয়েদের বুদ্ধিমত্তা দেখে চমকিত হই, থিয়োরি জ্ঞানে তাদের ধারেকাছে কেউ নেই, মাল্টিপল চয়েসের গোলকধাঁধায় সহজেই সে পথ দেখাতে পারে। কিন্তু খেলাধুলায় পঞ্চাশ পায় না। জগতকে দেখতে চায় নি, দুরের দৃষ্টি ফ্লাটবাড়ীর কল্যাণে এমনিতেই ধোঁয়াশা, খেলার মাঠ হল মোবাইল স্ক্রিন, সেখানেই ফুটবল দাবা। কোথায় তীরের বেগে মাঠে ছোটা সেই উজ্জ্বল ছেলেদের ঝাঁক। আর সমাজ সেখানে পায় না ঠাঁই, ছোট্ট জীবনের প্রতি পরতে মায়োপিয়া, পাশের মানুষটি অচেনা, রোগী সেখানে রোগগ্রস্ত মানুষ নয়, তিনি সেখানে একটি অবজেক্ট, মোবাইল গেমে যেমন দেখা যায়।
ইতিহাস লিখে ক্লিনিক্যাল ডায়াগনসিস না লিখে তাই প্রেসক্রিপশনে পাতা জোড়া পরীক্ষা। ইতিহাস লেখা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেখার প্রথিতযশা বইটির নাম আমার বর্তমান কলেজের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীদের অজানা। আমার একটি বই এদের একজনকে পড়তে দিয়েছিলাম। পড়ে আমাকে বলেছে ফেলুদার গল্পের মত সুন্দর- আদর্শ গোয়েন্দাদের পড়া উচিত। কাল এদের একজন সকালে এসে আমার অজান্তে নিজের একটি সিটি স্ক্যান করে গেছে। বিকেলে জিজ্ঞাসা করলাম- কি হে, একেবারে সিটি স্ক্যান। বললঃ লো গ্রেড ফিভার হচ্ছিল, এক্সরে তে ক্যালসিফিকেশন পেয়েছে। এক্সরে পুরোপুরি স্বাভাবিক। সে বললঃ ওর সিনিয়ার ও বলেছে এবনরম্যাল। ওকে আমি হরধনু ভঙ্গ করার গল্পটি শোনালাম- কে জানে আর কতজন ক্যালসিফিকেশন দেখতেন। আর সিটি স্ক্যান তো বলা বাহুল্য। এভিডেন্স বেস্ড মেডিসিন না কচু পোড়া জানিনা কিন্তু চিকিৎসক আর দরকার হবে না, এ আই আসবে আমাদের স্থান ভরাট করতে।
এই উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রীদের মনের খোরাক তাই মিটছে না। ওদের শেখাতে পারছি না, কারণ আমরাও জানিনা কি শেখাতে হবে। ওদের মনের মধ্যে সুপ্ত আকাঙ্খা আছে নিজেকে মেলে ধরার। প্রস্ফুটিত সে ফুলে রয়েছে অপ্রাপ্তির, অনিশ্চয়তার আধো আঁধার। সে জানে সে আসলে যন্ত্রের দাস- কটা টাকা তার আসতে পারে কিন্তু সমাজে তার মর্যাদা নেই। এই সমাজ তাকে অন্তর থেকে বিসর্জন দিয়েছে। তার জন্য সে দায়ী নয়। সে তার শৈশব আর কৈশোরকে টুঁটি চেপে মেরেছে। যৌবনের মনোরম দিনে সে বইয়ে মুখ গুঁজে থেকেছে। তাহলে তার প্রাপ্তি কি? এই অনিশ্চয়তা থেকে, ভঙ্গুর আকাঙ্ক্ষার গজদন্তমিনারের ভস্মাবশেষ তাকে কি দিতে পারে! অর্থ-বিত্তের জন্য লড়াই সে লড়তে পারে, সে বুদ্ধি তার আছে। কিন্তু সমাজের সাথে অসম লড়াইয়ে আজকের রমেশরা অসহায়। চারিদিকে তৈরী ঘৃণার সমুদ্র, পারস্পরিক অবিশ্বাসের বেড়াজালে বদ্ধ মানসিকতার যন্ত্রণা, অবদমিত আবেগ! তার তুলনায় কি দড়ির ফাঁসে ঝুলে যাওয়া সহজ। লেখা যায় I quit.
এর জবাব আমি জানি না। কিন্তু এই অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের কাজ নয় এর উত্তর খোঁজার। সমাজকে এর উত্তর দিতে হবে, মেডিকেল কাউন্সিলকে দিতে হবে, সরকারকে এর উত্তর দিতে হবে। আমাদের নেতাদের এর উত্তর দিতে হবে- যারা রঙিন মিথ্যার কার্পেটে সত্যকে লুকিয়ে রাখতে চান, মোহজালে সমাজকে আটকে রেখে দূরাগত সোনার হরিণের পদধ্বনি শোনান। কিন্তু বাস্তবের কালো ধোঁয়া যেখানে দৃষ্টিশক্তিকে নিজের বাইরে কাউকে দেখার ও বোঝার ক্ষমতা হরণ করে।
দেবাদৃতা একজন নয়। গত সপ্তাহে দুজন নার্স ও আত্মহত্যা করেছে। এর শেষ কোথায়! কেন এদের অকালে ঝরে পড়তে হয়?

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়