Ameen Qudir

Published:
2019-10-05 20:29:26 BdST

বায়োমেট্রিক উপস্থিতি নিয়ে চিকিৎসক অসন্তোষ প্রসঙ্গে আমার কথা !


 

ডা. অসিত বর্দ্ধন , কানাডা থেকে
____________________________ 

আমার কৈশোরে ও তারুণ্যে পড়া বইয়ের তালিকায় সেবা প্রকাশনী বইয়ের সংখ্যা অনেক। এরকম কোন একটা বইতে লেখা ছিল যে " আউট অফ দ্যা বক্স" চিন্তা করার কথা। একটা ট্রাক ব্রিজের নীচে এসে আটকে গেছে। ট্রাকে বোঝাই করা সামগ্রী ব্রিজের চাইতে সামান্য বেশি উঁচু হওয়ায় ট্রাক এমন আটকে গেছে যে সামনে বা পিছনে যাওয়া যাচ্ছে না। সবাই ভাবছে কিভাবে মালপত্র সরালে ট্রাক আবার চালু হবে। এরকম অবস্থায় এক কিশোরে মন্তব্য করেছিল । " ট্রাকের চাকা থেকে একটু পাম্প কমালে ট্রাক দেবে যাবে এবং তখন ট্রাক সরানো যাবে" । সবাই যেখানে ভাবছিল কিভাবে উপরের উচ্চতা ঠিক করা যায়, সেখানে সেই কিশোর টি ভাবছিল নীচের দিকে কিভাবে হাইট কমানো যায়। অর্থাৎ সমাধান শুধু এক দিকে নয় , অন্য দিকেও হতে পারে।

এত বড় উপক্রমণিকার কারণ হল বায়মেট্রিক উপস্থিতি নিয়ে চিকিৎসকদের অসন্তোষ। এর অনেক গুলো কারণ আছে। একঃ এটা অনেকটা হাজিরা খাতায় সই করার মত। যেহেতু প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে চিকিৎসকেরা কখনো হাজিরা খাতায় সই করেননি, তাই এটা অনেকের কাছে হতাশাজনক। আরেকটু বাড়িয়ে বললে, কারো কারো কাছে এটা অপমানজনক!
দুইঃ চিকিৎসকদের কাজের ধরণ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাজের ধরন এক নয়, বিশেষত যারা ক্লিনিকাল সাইডে কাজ করেন। দুপুর ২.৩০ মিনিট হলেই একজন চিকিৎসক তাঁর হাতের রোগীকে ফেলে যেতে পারেন না। এমনকি আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করতেও সময় লাগে। হাতে একজনের বেশি রোগী থাকতে পারে। কখনো নাও থাকতে পারে। আবার ঘড়ি দেখে ঠিক সকাল ৮.৩০ মিনিটে রোগী দেখা শুরু হয়না। ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে ইন্টার্নি ডাক্তার , সি এ , রেজিস্ট্রার আরও অনেক আগে রাউন্ড শুরু করেন। শেষ রোগী দেখার সময় নির্দিষ্ট নয়, যতক্ষণ খারাপ রোগী আছে ততক্ষণ থাকতে হয়। যেদিন যে অধ্যাপকের ভর্তির দিন , সেদিন তাঁর ইউনিটে কাজ হয় ২৪ ঘণ্টা। সব দিন সমান নয় তবে কাজের পরিধি এবং সময় একেক জন চিকিৎসকের একেক রকম। জেলা হাসপাতালে সব চিকিৎসকদের কাজের ধরণ এক নয়। এখানে একটি অভিযোগ হচ্ছে যে কিছু চিকিৎসক একটানা ২ দিন কাজ করে স্টেশন ছেড়ে চলে যান। নতুন বায়মেট্রিক পদ্ধতিতে উপস্থিতি প্রমাণে এরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
যেহেতু চিকিৎসকদের কেউ কেউ এই কাজ টাকে অন্যায় মনে করেন তাই এদের সমর্থনে আমি তেমন একটা লেখা দেখিনি। যারা এরিমধ্যে লিখেছেন, তাদের অনেক ধন্যবাদ। তা আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছে বলে দুঃখিত । আমি এইভাবে ডিউটি করাকে সমর্থন করি। বিশেষত যেখানে পোস্টিং হয়েছে পোষ্ট গ্রাজুয়েশনে অধ্যয়নরত ছাত্রদের। একটু ব্যাখ্যা করে বলিঃ ইমারজেন্সিতে দিনে/২৪ ঘণ্টায় ৩ জন চিকিৎসক ডিউটিতে থাকেন। তাঁর পরিবর্তে ১ জন চিকিৎসক সম্পূর্ণ ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করলে তার ১ সাথে ৩ দিনের ডিউটি করা হয়। এভাবে টানা ২ দিন ডিউটি করলে মোট ৬ দিনের ডিউটি করে একজন বাকি ৫ দিন অন্য কাজে মন দিতে পারেন। যেহেতু কর্মক্ষেত্রে ১ জনের কাজ ১ জন করেন তাই এই ধরণের ডিউটিতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক থাকেন। আবার চিকিৎসকের বাড়তি দিন গুলো নিজের/অধ্যয়নের কাজে ব্যবহার করতে পারেন। বায়মেট্রিক ব্যবস্থাপনায় এটি সম্ভব নয়।
তিনঃ চিকিৎসকদের অনেকেই অধ্যাপনার সাথে যুক্ত থাকেন। একটা ক্লাস নিলে হয়ত ১ ঘণ্টা হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু এর জন্য প্রস্তুতিতে যে আরও ৩-৪ ঘণ্টা ব্যয় হয় সেটা বায়মেট্রিকে ধরা পড়ে না।
চারঃ কন্টিনিউ মেডিকেল এজুকেশন বা সংক্ষেপে সিএমই (CME) চিকিৎসকদের জন্য প্রয়োজনীয়, এই করমঘন্টা বায়মেট্রিক পদ্ধতিতে মাপা যাবে না। তাতে চিকিৎসকেরা বঞ্চিত হবেন।
পাঁচঃ অধ্যাপক /বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক / ক্ষেত্র বিশেষে সিএ , রেজিস্ট্রার তাদের " এডমিশনের" দিনে ( যে দিন সেই অধ্যাপকের অধীনে রোগী ভর্তি হন ) অন কলে থাকেন । অর্থাৎ প্রয়োজনে তারা গুরুতর রোগী দেখতে হাসপাতালে আসেন , সেই কর্মঘণ্টার পরিমাপ কি বর্তমানের ঘণ্টা নির্ভর বায়মেট্রিকে কি সম্ভব?
ছয়ঃ শিক্ষানবিশ চিকিৎসক, ইন্টার্নি, ইনডোর মেডিকেল অফিসারসহ অনেকেই নির্দিষ্ট ৮ ঘণ্টার বেশি সময় কাটান হাসপাতালে। এদের বাড়তি কর্মঘন্টার হিসেব কি থাকবে বর্তমান পদ্ধতিতে?
সাতঃ একজন চিকিৎসকের কাজ ও একজন খাতায় লেখা কেরানির কাজের ধরণ এক নয়। দুজনেই কাগজে লেখেন। দুজনের দায়িত্ববোধ এক নয়, নয় জীবন বাঁচানোর ক্ষমতা! চিকিৎসকের প্রত্যেকটি লেখায় থাকে কারো সুস্থতা ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা, কারো অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর বীজ! একজন কেরানির লেখায় থাকে সেইসব হিজিবিজি যা হয়ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ফেলে দ্যায় বিপদের মুখে নিদারুণ দায়িত্বহীনতায় !
তাহলে দুকুল রাখি এমন সমাধানের খোঁজ করা দরকার! ডিজিটাল রেকর্ড ও রোস্টার সিস্টেম হচ্ছে সেই সমাধান! এমন একটি রোস্টার সিস্টেম প্রয়োজন যেখানে একজন চিকিৎসকের ডিউটি নির্দিষ্ট থাকবে। এই রোস্টার যে কোনো প্রশাসনিক পর্যায় থেকে দেখা যাবে। যারা তদারকির দায়িত্বে থাকবেন যেন নিজের দফতরে বসেই কোথায় কোন চিকিৎসকের থাকার কথা তা দেখতে পারেন এবং খোঁজ নিতে পারেন তিনি আছেন কি না।
ডিজিটাল রেকর্ডের মাধ্যমে যেমন রোগীকে কি সেবা দেওয়া হয়েছে তাঁর বর্ননা থাকবে, তেমনি সেই চিকিৎসক কখন কি চিকিৎসা দিয়েছে সেই সময় ও নির্দিষ্ট থাকবে।। দফতর থেকে সেই তথ্য দেখা গেলে চিকিৎসক উপস্থিত কি না তা দেখার জন্য বায়মেট্রিক প্রয়োজন হবে না। এই রেকর্ডে ছাত্র চিকিৎসক সবার কন্টিনিউ মেডিকেল এজুকেশন বা সংক্ষেপে সিএমই (CME) এর তথ্য থাকলে কর্মঘণ্টা হিসেব করা যাবে, ছাত্রদের উপস্থিতি দেখা যাবে।
ক্লাউড ভিত্তিক ডিজিটাল রেকর্ডের সুবিধা অনেক। যেমন যে কোন হাসপাতাল থেকে ডাটা এন্ট্রি করা সম্ভব , তেমনি যে কোন স্থান থেকে তদারকি সম্ভব। ২১ শতকে এসে ডিজিটাল রেকর্ডের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে গতিশীল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চাইলে প্রশাসনের উচিৎ হবে চিকিৎসকদের আস্থায় এনে একসাথে কাজ করা। একজন চিকিৎসকের তুলনায় অন্য যে কোন ক্যাডারের কর্মকর্তার যে মানসিক ও কাজের প্রয়োগ গত পার্থক্য আছে, এই সহজ সত্যটি না বুঝলে এত বড় কর্মিবাহিনির আস্থা অর্জন দূরের স্বপ্ন না থেকে যায়!
___________________________

ডা. অসিত বর্দ্ধন । পাঠক ধন্য সুলেখক। তার তৈরী করা অ্যাপস ডাক্তারদের কল্যাণে এখন জনপ্রিয়।
কানাডায় কর্মরত এনেস্থেসিওলজিস্ট, BDEMR নামের সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা।

 

 

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়