Ameen Qudir

Published:
2019-09-19 20:25:16 BdST

ডাক্তারী ভাবনা: এমবিবিএস বনাম নন-এমবিবিএস ডাক্তার


ডা. তারিক অনি

_________________________

ডা: আব্দুল করিম ( ছদ্মনাম)। প্রেসক্রিপশনে নামের পাশে এমবিবিএস শব্দটি নেই। আছে কিছু অ-আ-ক-খ বর্ণমালা। এমএলএফ( গ্রাম ডাক্তার), সাকমো( SACMO) সাব এসিস্টেন্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার , ভিডি( ভিলেজ ডক্টর) , পিসি( পল্লী চিকিৎসক), মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট, ডিপ্লোমা, বিভিন্ন ধরণের পিজিটি। মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। মফস্বল বা জেলা-উপজেলা শহরগুলোর কোন এক ফার্মেসীতে প্রাকটিস করেন এরা। দশম শ্রেণী পাশ নিউরোমেডিসিন অধ্যাপক সেজে প্রাকটিস করছে- এরা আমার এই লেখার আলোচ্য না। আলোচ্য যারা নন-এমবিবিএস অথচ ডাক্তার লিখে প্রাকটিস করছেন। প্রায়ই অদ্ভুত সব প্রেসক্রিপশন বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে আসছে, প্রচুর সমালোচনা এসব চিকিতসা পত্র নিয়ে, যার মোদ্দা কথা বেশিরভাগ ই অপচিকিতসা। ভুলে ভরা পরীক্ষা, ভুল ঔষধ, অপ্রেয়োজনীয় ঔষধ, এমনকি বানান পর্যন্ত ভুল। কিন্তু আসলেই কি ভুল ? সবটুকুই ভুল নাকি কিছুটা ভুল? কত শতাংশ ভুল? আসলেই কি এই নন-এমবিবিএস প্রাকটিশনার রা শুধু অপচিকিৎসা করে যাচ্ছেন নাকি এদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? আজকের লেখাটা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টা।
দেখুন, গত বিশ-ত্রিশ বছর ধরেই দেশে ভূয়া ডাক্তার ধরা চলছে। জরিমানা করে ধাওয়া করে দুএকজন আব্দুল করিম ভূয়া ডাক্তার হিসেবে ধরা পড়ছে, কিন্তু বছরান্তেই তিনি আবার অন্য এক জেলায় ডাক্তারী শুরু করছেন। ডাক্তারদের সোসাল মিডিয়া পেজে প্রচারণা চলছে, কিন্তু সমস্যা টা সমাধান হচ্ছে না। আইন যথেষ্ট আছে।তারপরও সমাধান নেই। দেশের বিশাল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বৃহৎ একটা অংশ সজ্ঞানেই আব্দুল করিমদের কাছে চিকিতসা নিচ্ছেন, অনেকেই ভালো হয়ে যাচ্ছেন বা তাৎক্ষণিক উপশম পাচ্ছেন, তার খবর আমরা পাইনা। অপচিকিৎসার ফলে রোগীর ক্ষতির খবরগুলো আমরা পাই কারণ তা ফলাও করে ছাপা হয়। কিনেতু এরপরও কিন্তু আবদুল করিমদের রোগী কমছে না। ত্রিশ বছরে কোন আইন প্রয়োদ করেও এই প্রাকটিস বন্ধ না করতে পারার ব্যর্থতার দুটো কারণ মনে হয় আমার - ১। সরকারের সমর্থন: নন এমবিবিএস এসব প্রাকটিশনারদের প্রতি সকল সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল এবং বর্তমানেও আছে। দেখুন, এটা তিক্ত এবং প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, বিসিএস ডাক্তাররা গ্রামে থাকে না। কেন থাকেনা সেটা ভিন্ন আলোচনা। সরকার নাই মামার থেকে কানা মামাদের পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে বা বন্ধ করার চেষ্টা করছে না। একইরকম হোমিওপ্যাথী। কারণ অসচেতন বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ স্বল্প খরচে ১০০-২০০ টাকার মধ্যেই আপাতত সমাধান দ্রুত কিছু একটা প্রেশক্রিপশন পেয়ে যাচ্ছে, যেটা সরকারের জন্য স্বস্তির। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাহিদা আপাত মিটছে।
২। প্রয়োজনীয়তা: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে এসব নন-সার্টিফিকেটধারী প্রাকটিশনার( ডাক্তার বলছি না) মিসহ্যাপ করলেও কিথু মানুষ সেবা পাচ্ছে, এবং সেই কিছু মানুষ সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়, বরং মূল প্রাকটিসের চেয়ে বেশি। অর্থাত, এদের আসলেই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রশ্ন রয়েই যায়, এই সেবার কত শতাংশ মিসহ্যাপ হচ্ছে? সেটা কি ডাক্তারদের থেকে বেশি? কোন স্টাডি/ ডাটা সম্ভবত নেই, যা আছে মুখে মুখে। এই আলোচনায় পরে আসছি। বরং, সমরূপ একটা উদাহরণ টানছি দেখুন। সরকার বিগত ৪০ বছরেও ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদ করতে পারেনি। রাস্তা থেকে কাচাবাজার উচ্ছেদ করতে পারেনি। কেন পারেনি ? দুইদিন পর পর উচ্ছেদ অভিযান, জেল জরিমানা, এরপরও কেন তা বন্ধ হচ্ছেনা ? কারণ টা হল প্রয়োজনীয়তা। হকার প্রয়োজন। সব হকার উচ্ছেদ করে দিলে দেশের মানুষ সবাই বসুন্ধরা সিটি বা শপিং মল থেকে জামা কিনে পরতে পারবে না। হকারের কাস্টমার ই বেশি। প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে যে উচ্ছেদ এবং যার সাথে পুর্নবাসন শব্দটি নেই তা যত শক্ত আইন আর উচ্ছেদ অভিযান ই হোক না কেন, ফলপ্রসূ হয় না। কারণ necessity knows no law. এই বিশাল নন-এমবিবিএস প্রাকটিসিং গ্রুপ বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় নেসেসিটি।
বিদেশে প্রাকটিস করে আমার প্রায়ই মনে হয় বাংলাদেশে যে বিলাত-আমেরিকার ডাক্তারী বই পড়ে একজন ডাক্তার এমবিবিএস পাশ করে তার ৫ শতাংশ জ্ঞান প্রয়োগের সুযোগ ৯৫ শতাংশ ডাক্তারের কর্মক্ষেত্রে নেই, এমন কি ঢাকার সর্বোচ্চ হাসপাতালেও অনেকসময় নেই- সেই ট্রেনিং নেই, দক্ষ জনবল নেই, নির্ভরযোগ্য ল্যাব নেই, লজিস্টিকস-যন্ত্রপাতি নেই, উপরন্তু অর্থাভাব, দূর্নীতি, বিশ্রী রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে রয়েছে।
দেশের সাথে সামন্জস্যপূর্ণ চিকিতসা পদ্ধতি, লোকাল গাইডলাইন নিজেদের ই উদ্ভব করতে হবে। এমবিবিএস ছাড়া যারা প্রাকটিস করছে তাদের কোন ট্রেনিং/ সার্টিফিকেট দিয়ে রেফারাল সিস্টেমের মধ্যে আনা যায় কি না ভেবে দেখা দরকার। বাইরে নার্স প্রকাটিশনার রয়েছে, দেশেও এরুপ সম্ভব, বর্তমান বাস্তবতায় প্রয়োজনীয় ও বটে, প্রয়োগের অপেক্ষা। নন-এমবিবিএস বিশাল এক প্রান্তিক সেবাপ্রদানকারী জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে আইন এবং শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করে স্বাস্হ্য ব্যবস্থা চালানোর সামর্থ বাংলাদেশের আছে কি না, সেটা তর্কসাপেক্ষ। আমার উত্তর - আমাদের সেই সামর্থ নেই। শুধু ডাক্তার দিয়ে একদম প্রান্তিক জনগণ পর্যন্ত সেবা পৌছানোর ক্ষমতা বাংলাদেশের এখনও হয়নি, তাই আব্দুল করিমদের আমাদের লাগবে। নিয়মের মধ্যে লাগবে- নিয়ম করাটা জরুরী।
সমস্যা হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশে যে জুনিয়র ডাক্তার কিছুতেই রেফারাল ছাড়া কনসালটেন্টের কাছে রোগী পাঠাতে চাচ্ছেন না, আন্দোলন করছেন রেফারাল পদ্ধতির জন্য, অথচ সে ই দুইদিন পর মেডিসিনের কনসালটেন্ট হয়ে রেফারাল ছাড়াই শিশুরোগ দেখে ভিজিটের টাকা টা রেখে দিচ্ছে। কারণ টা যে মেডিসিন নয়, পিওর অর্থনীতি তা নিশ্চয়ই সবাই বুঝে গেছেন। রেফারাল সিস্টেম হলে একদম নিম্নস্তরের নন-এমবিবিএস প্রাকটিশনার আব্দুল করিম থেকে থেকে উচ্চস্তরের অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ স্যার পর্যন্ত হওয়া দরকার।
আব্দুল করিমদের ট্রেনিং দরকার। স্বীকৃতি দরকার। সম্মান দরকার। তাদের নির্দিষ্ট গাইডলাইন দরকার। যে গাইডলাইনে সে তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার মধ্যে সাধারণ পেট ব্যাথা, জ্বর, মাথা ব্যাথার সঠিক ঔষধ টা দিতে পারবে এবং রোগীর সাথে কথা বলে এবং কিছু সাধারণ পরীক্ষা করে এটুকু বুঝতে পারবে কোন মাথাব্যাথাটা ডাক্তার এর কাছে যাওয়া জরুরী, কোন পেট ব্যাথা টা প্রাণঘাতী হতে পারে। অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন- এত বোঝার ক্ষমতা সামান্য আব্দুল করিমদের আছে কি না। আমার উত্তর -আছে। খুব ভালোভাবেই আছে। শুধু ট্রেনিং দরকার। অস্ট্রেলিয়াতে মাঠ পর্যায়ে প্যারামেডিক হার্ট এটাক( STEMI) ইসিজি করে লাইসিস পর্যন্ত করে ফেলে- অথচ সে কার্ডিওলজির “ক” টাও হয়তো আমাদের বিচারে বুঝে না। তাকে কিছু নির্দিষ্ট প্যাটার্ণ শিখানো আছে। সে তার প্যাটার্ণ এ কাজ করে। ট্রেনিং পেলে আমাদের আব্দুল করিম রাও এরচেয়ে ভালো কাজ করে দেখাতে পারবে। আমরা অবজ্ঞাভরে ফেলে রেখেছি, মানব সম্পদ পড়ে রয়েছে, আমরা তাদের খাঁটি সোনা দক্ষ মানব সম্পদে পরিনত করতে পারছি না, উল্টো তাদের পিছনে বাহিনী লাগিয়েছি। এজন্য, আমি যখন এরকম কোন আব্দুল করিমের ভুল প্রেসক্রিপশন দেখি আমার তাকে কটাক্ষ করার আগে নিজেদের দিকে তাকাতে ইচ্ছে হয়। তাকে কোনরকম ট্রেনিংছাড়া কাজ করতে হচ্ছে, সে প্রেসক্রিপশনে ভুল-শুদ্ধ যা লিখেছে হয়তো কোন এক ডাক্তার বা ফার্মেসীর কাছে একনজর দেখে শিখেছে। তাকে পুরোপুরি কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার পূর্বে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিজের সিস্টেম ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করা উচিত। কারণ আব্দুল করিম রা সিস্টেমের বাই প্রোডাক্ট, সিস্টেমের তৈরী।
অনেকেই আব্দুল করিমদের দৌরাত্ম, রোগীকে জিম্মি করা, দুই নম্বরী পন্থার প্রাকটিস আর অর্থ উপার্জনের ব্যাপারটি তুলে ধরবেন। এই ব্যাপারটি আলোচনা করাটাও আরও বেশি লজ্জাকর হবে। কারণ আমি যদি বড় শহরগুলোর বাইরে খোদ এমবিবিএস পাশ ডাক্তারদের প্রাকটিসের বিভিন্ন অন্ধকার দিক এবং অর্থ উপার্জনের নানা পন্থা নিয়ে আলোচনা শুরু করি তাহলে তা অনেকের জন্যই অস্বস্তিকর হয়ে দাড়াবে। তাই এই আলোচনা টা বাদ দিচ্ছি। আমি অর্থনীতির ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলাম সবার সম্মান রক্ষার্থেই।
অর্থনীতি যখন এসেই গেল তখন বলি, উন্নত বিশ্ব তথা সারা পৃথিবীতেই স্বাস্হ্য একটা ব্যবসা। জ্বী, ভুল শুনছেন না। স্বাস্হ্য শুধু সেবা কখনই নয়। বরং সেবামূলক ব্যবসা। ঈশ্বরের পরে অবস্থান বলে পেশাটিকে মহিমান্বিত করা হলেও ডাক্তার মোটেও ঈশ্বর না, তার লোভ লালসা আর সাধারণ দশটা মানুষের মতই, কারণ তাদের ও পেট চালাতে হয়, মুদী দোকানদার ডাক্তার বলে তাকে চাল-ডাল ফ্রী দেয়না, মাছওয়ালা দুটো মাছ ফ্রী দিয়ে দেয়না। যে পরিমান গাধার খাটুনি করে সে চার- পাঁচটা ডিগ্রী অর্জন করেছে তার মুনাফা রিটার্ণ সে তুলতে চায়। সারা পৃথিবীতে তাই হয়। গায়ে সাদা এপ্রন জড়ালেই মনটা সফেদ সাদা হয়ে যায় না এই সত্য সবার জানা। এই খোদ অস্ট্রেলিয়াতেও তাই হয়। এক ফেলোশিপ করা জুনিয়র সার্জনের আয়ের থেকে ডাবল ফেলোশিপ করা- দশটা গবেষণা বেশি করা সার্জনের আয় ও ডাবল বেশি। সহজ ব্যবসায়িক সুত্র। কেন সার্জনের আয় মিলিয়ন ডলার আর অফিসারের বেতন তার দশ ভাগের এক ভাগ তা নিয়ে জনমনে অসন্তোষ থাকলেও জনগণ সম্মানের সাথেই মেনে নেয় কারণ ন্যূনতম স্ট্যান্ডার্ড( যেটা সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মানের) নিশ্চিত করে রাস্ট্র। প্রচুর নিয়ম করে এবং তা কঠোরভাবে অনুসরণ করে নিশ্চিত করা হয় যে সবকিছু একটা নিয়মে চলবে।
যেকোন ঘটনার পর সামগ্রিক সিস্টেম টা কে শক্তিশালী করার একটা চেষ্টা থাকে, কোন নির্দিষ্ট চেয়ার/ ব্যাক্তি কে নয়, বা শুধু একজন কে ধরে শাস্তি দিয়ে ব্যাপারটা শেষ করে ফেলা হয় না। এই অস্ট্রেলিয়াতেও ভূয়া ডাক্তারের ঘটনা ধরা পড়েছে, যে এই দেশের ভয়াবহ চালুনী পদ্ধতির ফাঁক গলে বের হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া তাকে ধরতে পারে নি, কিন্তু দোষ টা শুধু তাকে না দিয়ে নিজেদের দিকে আরেকবার ঘুরে তাকিয়েছে নিজেদের ছিদ্রগুলো খুজে বের করার জন্য।
আমার সাথে অনেকেই দ্বিমত করতে পারেন, অথচ আমার প্রায়ই মনে হয়, বাংলাদেশে সামগ্রিক “নার্সিং” ব্যবস্থাটাকে আমরা ডাক্তার রাই অবদমিত করে রেখেছি, অবজ্ঞা-তাচ্ছিল্য করে বিকশিত হতে দেইনি। এর পিছনেও কিছু অর্থনীতি-রাজনীতি আছে, সেদিকে না যাই।
সামগ্রিক সত্যি এমন দাড়িয়ে গেছে রোগী- ডাক্তার এর মাঝে বিশাল ব্যক্তিবর্গ ( নার্স, মেডিক্যাল এসিস্টেন্ট, ফার্মাসিস্ট, কাউন্সেলর, ফিজিও, অকুপেশনাল থেরাপী, স্পীচ প্যাথোলজী, ডায়েটিশিয়ান, নার্স এডুকেটর, মিডওয়াইফ, নার্স ট্রেইনার, কমিউনিটি অফিসার..... বলতে থাকলে ৫০ হয়ে যাবে) সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। একটি রোগীর ম্যানেজমেন্টে ১০ শতাংশ কাজ করে ডাক্তার। হ্যা, তার ক্লিনিকাল ডিসিশান টা অবশ্যই মূখ্য ভূমিকা পালন করে কিন্তু তা কখনই সম্পূর্ণ নয়। আমরা যেহেতু বাকী ৯০ শতাংশকে বিকশিত হতে দেইনি তাই বাকী ৯০ শতাংশ লোকের কাজ আমাদের উপর পড়ছে এবং সেই কাজের দায়ভারও এখন পুরোপুরি বাংলাদেশের ডাক্তার বহন করছে। ভুল চিকিতসা হলে তো মাফ নেই, তাছাড়াও হাসপাতালে কেন ঔষধ নেই, রিপোর্ট কেন ভুল, এলাইড হেলথের বালাই নেই- রোগী ভুক্তভোগী, নার্স কেন ঔষধ দিল না, ফী কেন বেশী, বেড ভাড়া কেন এত সেই জবাবদিহিতাও ডাক্তারের। ডাক্তারের এক প্রেসক্রিপশনে ফার্মেসী অন্য ঔষধ দিলে সেটা মনিটরিং এর দায়িত্বও ডাক্তারের। ব্যাপারটা হয়ে গেছে দায়ভার সব ডাক্তারের, তীর সব তার দিকে।
সরলীকরণ করি। খুঁটিনাটি আলোচনা পরিহার করে মোটা দাগে আমার মনে হয় এই যে জটিল সমস্যা তার পিছনে ১. দুর্নীতির পরই দায়ী ২. অর্থনীতি এবং ৩. রাজনীতি। এবং আমার এটাও মনে হয় যে সমাধান টা ও শুধুমাত্র এই তিনটি জিনিস দিয়ে সম্ভব। এছাড়া সম্ভব নয়।
১। রাজনীতি:
প্রথমত, দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আমার মনে হয় না ডাক্তার রাজনীতি কোন সমাধান আনতে পারবে- কারণ যা গত চল্লিশ বছর ধরে ব্যর্থ এবং ডাক্তাররাই যেখানে ডাক্তার নেতাদের বিশ্বাস করেন না, পোষ্টিং আর নিয়োগ অর্থনীতি যেখানে মূল রাজনীতি, সেখানে ডাক্তারদের রাজনীতি ডাক্তার এবং রোগীদের দু:খ ঘুচিয়ে সুবাতাস বইয়ে দিবেন সে আশা দূরাশা। সদিচ্ছা টা দরকার একদম উপর মহল থেকে- প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি থেকে। একটা দেহের মাথা সুস্থ হলে দেহ অসুস্থ থাকতে পারে না- সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার দেশপ্রধানরা তা করে দেখিয়েছেন। আমরা পারছি না, তার পিছনে একটাই কারণ - আমরা মনে প্রাণে এখনও সেই পরিবর্তন চাইছি না। মুখে মুখে চাইছি, অন্তরে ধারণ করছি না। মোটা দাগের দুটো বিশ্রী উদাহরণ দেই - স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত আমার বাংলাদেশের কোন প্রধানমন্ত্রী-রাস্ট্রপতি বিলাত-আমেরিকা-সিঙ্গাপুর ছাড়া আজ পর্যন্ত দেশের হাসপাতালে কোন চিকিতসা নেননি। দুদিন আগেও বর্তমান রাস্ট্রপতি সিঙ্গাপুর গেছেন স্বাস্হ্য পরীক্ষা করতে আর তার মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রী গেলেন বিলাতে চোখ অপারেশন করাতে। একই কাজ খালেদা জিয়া, এরশাদ সাহেব ও করেছেন, সকল রাস্ট্রপতি করেছেন। যে হোটেলের ম্যানেজার নিজের হোটেলে খাবার খান না তিনি কাস্টমারদের সন্তষ্টির ব্যাপারে কতটা যত্নবান আর আন্তরিক? যেদিন আমার দেশের প্রধানরা নিজ হোটেলে ভাত খাবেন, সেদিন কোন কাস্টমার খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগই পাবে না। সেদিন সরকারী হাসপাতালের মেঝেতে বিড়াল তেলাপোকা ঘুরবে না, টয়লেট পরিষ্কার থাকবে, ঔষধের সাপ্লাই ও পাওয়া যাবে, সব যন্ত্রও দেখবেন সুন্দর কাজ করছে অবিরাম!
২। দুর্নীতি:
দুর্নীতি নিয়ে কিছু বলার নেই। ওটা থাকলে দেশ আগামী একশ বছরেও যা আছে তাই থাকবে বা পিছাবে। দু চারটা যা উন্নয়ন খবর আসে তা ম্লান হয়ে যায় হাজার হাজার দুর্নীতি খবরের গ্লানিতে। সূচকে আমরা আর দূর্নীতি তে এক নম্বর নই, কারণ আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ ওই স্থানগুলো নিয়েছে- এতে আত্মতুষ্টির কিছু নেই। আমরা সেই বাদরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার মত, তিন ফুট উপরে উঠি তো দুই ফুট নীচে নামি। এভাবে ঘন্টায় এক ফুট করে উপরে উঠতে উঠতে বাকি বিশ্ব দশ ফুট করে দূরে চলে যায়। উন্নত বিশ্ব কে বোধহয় কোনদিনই ছোয়া হবে না। এই জীবদ্দশায় দরিদ্র বাংদেশের সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে মরতে আমার গ্লানি নেই বরং গর্ব আছে, কিন্তু দরিদ্র শব্দটির আগে “করাপ্টেড এন্ড পুউর” বিশেষণটি গা জ্বালা ধরায়।
৩। অর্থনীতি/ স্বাস্থ্যবীমা:
শেষ ব্যাপারটি অর্থনীতি। আমার মনে হয় এটা সমাধানে দেশে স্বাস্থ্যবিমা টা খুব জরুরী। কারণ চিকিতসা ব্যয় একটি জটিল এবং স্পর্শকাতর বিষয়। চিন্তা করুন, আপনার বাবার হার্ট এটাক হয়েছে এবং রিং পরাতে পাঁচ লক্ষ টাকা লাগবে, অথবা আপনার আদরের ছোট্ট বাচ্চাটা গুরুতর অসুস্থ আইসিইউতে ভর্তি, প্রতিদিন অর্ধলক্ষ টাকা খরচ, প্রায় সময়ই এই অর্থনৈতিক ব্যাপারগুলো ডাক্তার-রোগীর আত্নীয়- হাসপাতাল সবার জন্যই বিব্রতকর এবং স্পর্শকাতর সত্য হয়ে দাড়ায়। চিকিতসা ব্যহত হয়।সবশেষে রোগীর আবেগ যেয়ে দাড়ায় দেশ কেন পাঁচটি মৌলিক অধিকার- ব্যাসিক বা ইমার্জেন্সী চিকিতসা টা নিশ্চিত করতে পারছে না তার উপর। ভাংচুর হয় হাসপাতাল। জুনিয়র ডাক্তারদের নিয়মিত শারীরিক-মানসিকভাবে হেনস্থা হওয়ার ঘটনাটা আলোচনা থেকে বাদ দিলাম। যে বেচারার পকেটে হয়তো আপনার পাঁচ লক্ষ টাকা বিল এর ৫ হাজার টাকাও যায়নি, অথচ মার খেয়ে সারাজীবনের জন্য বিতশ্রদ্ধ হয়ে গেল সে। কোনদিন আর কেয়ার করবে না। কারণ আপনি একবার হাত তুলেছেন, সে সারাজীবন তা মনে রাখবে।
চিকিতসায় ভুল হয়, এই উন্নত বিশ্বেও প্রচুর হয়, মামলা হয়, জরিমানা হয়, দু একটা হাতাহাতি হয়ে জেল হয়, কিন্তু ডাক্তারদের উপর জনগণের বিশ্বাস টাকে কিছুতেই আঘাত করতে দেওয়া হয়না। কারণ ওটা সামগ্রিক চিকিতসা ব্যবস্থাটার ভিত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক আস্থার জায়গাটাই অজ্ঞানে বা সজ্ঞানে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে, যেটা মারাত্মক পরিনতি আনবে।
চিকিতসা ব্যয় অর্থনীতির এই দরকষাকষির ব্যাপারটা এরা ডাক্তার-রোগী-হাসপাতালের হাতে ছেড়ে না দিয়ে “দালাল” নিয়োগ দিয়েছে। যার নাম “মেডিকেল ইনস্যুরান্স”। সে চিকিৎসার ব্যয় বহন করবে, জরুরী অবস্থায় আপনার টাকা পয়সা নিয়ে ভাবতে হবে না, বিনিময়ে আপনি তাদের দেওয়া কিছু নিয়ম মেনে চলবেন এবং প্রতিমাসে আপনার আয় থেকে খুব ন্যূনতম একটা শতাংশ দিয়ে যাবেন সবসময়। চিন্তা করে দেখুন, সমস্যা টা কিন্তু এখানে। ৫০ হাজার টাকা বেতনের যে চাকুরীজীবী আজ তার আয়ের ৫-১০ শতাংশ প্রতিমাসে বীমা কে দিতে চাইবে না, একেবারে পাঁচলক্ষ টাকার ধাক্কায় তার ক্ষোভ টা যেয়ে পড়বে দেশের উপর, আর ওই মুহূর্তই ক্ষোভ ঝাড়তে দেশ কে আর হাতে পাওয়া যাচ্ছে না, পাওয়া যাচ্ছে দেশের অভাগা একজন ডাক্তার কে, মার তাকে ! তাও ডাক্তার মেরে হাসপাতাল ভাংচুর করে যদি বাবা বেঁচে যেত তাও একটা কথা ছিল ! এরপর সেই ডাক্তার তো মার খেয়ে বাবার পর চাচাকেও মনথেকে চিকিতসা করবে না, পিঠ বাচিয়ে টাকা নিয়ে চলে যাবে। কিরকম ব্যয় হবে, চিকিৎসক মাত্রাতিরিক্ত টেস্ট দিচ্ছেন নাকি একদম ই দিচ্ছেন না, অতিরিক্ত ঔষধ প্রেসক্রাইব করছেন নাকি স্ট্যান্ডার্ড প্রাকটিস করছেন, অপারেশন যথাযথ করেছেন কিনা, বেশি কম বিল নিয়েছেন কিনা, এসব সুক্ষ্ম বিষয়গুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ এ পাঁচ শতাংশ ডাক্তার ও বসায়নি, বসিয়েছে ৯৫ শতাংশ আইনজীবী, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট আর হেলথ ম্যানেজমেন্টের লোক কে। সরকার ৬৫ এর উপর জনগণের চিকিতসা সরকারী হাসপাতালে ফ্রী করার যে উদ্যোগ নিচ্ছে তা ভালো, তবে আমার মতে বোঝা হয়ে যাবে। কই এর তেলে কই ভাজার বীমা পদ্ধতি চালু না করতে পারলে অচীরেই বোঝা বড় হয়ে যাবে এই দরিদ্র দেশের জন্য। দেশে কেন স্বাস্হ্য বীমা আসছে না সে এক আশ্চর্য জিজ্ঞাসা!
লিখাটা নন-এমবিবিএস প্রাকটিশনার নিয়ে শুরু হয়েছিল , ডালপালা ছড়িয়ে গেছে। আসলে সমস্যার বিস্তৃতি এত ব্যাপক আর সমস্যাগুলো একটার সাথে আরেকটা এত বেশি সম্পর্কযুক্ত যে এক আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখা কঠিন । তাও চেষ্টা করেছি অনেক তর্ক ই এই আলোচনায় না আনতে, একটি প্রসঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকতে। নন-এমবিবিএস দের দৌরাত্মে দেশের বেশিরভাগ ডাক্তারই বিরক্ত তারপরও ভিন্নমত পোষণ করে চেষ্টা করেছি কাউকে আঘাত না দিতে লিখতে। মাঝে মাঝেই শুনতে হয় বিদেশে ডাক্তারী করে দেশ নিয়ে এত কথাবার্তা না বললেও চলবে, এটাও এক বিড়ম্বনা। চেস্টা করি কম বলতে, তাও বলা হয়ে যায়। কেন যেন লাল-সবুজের দেশটাকে পিছনে পড়ে থাকতে দেখতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে আমার দেশ টা রোল মডেল হয়ে যাক। সবাই সিঙ্গাপুরের মত পরের উদাহরণ টা বাংলাদেশ দিক। খুবই সম্ভব।
আমার ব্যক্তিগত মতামত আর অভিব্যক্তির কথা দিয়ে শেষ করি। ২০১৮ এর একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে, অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্হ্য ব্যবস্থার ৬০ শতাংশ ডাক্তার নন-অস্ট্রেলিয়ান। অর্থাৎ, এদের নিজস্ব কোন লোক নেই, হাসপাতাল আর প্রাকটিস চালানোর মত যথেষ্ট পরিমাণ ডাক্তার ই নেই। এরা সারা পৃথিবী থেকে লোক ভাড়া করে, একে তাকে ধরে এনে কাজ চালাচ্ছে। এদের মধ্যে একজন আমি। মোটামুটি স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত( ফেয়ার) , নিরাপদ, সুন্দর একটা সিস্টেম তারা তৈরী করেছে যেই সিস্টেমে আমার মত বহিরাগত ও আন্তরিকভাবেই কাজ করছে, আর তাদের স্বাস্হ্য ব্যবস্থা বিশ্বের প্রথম পাঁচটি স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি হয়ে দাড়িয়েছে। ভাড়া করা লোক দিয়ে একটি দেশ যদি এই অর্জন করতে পারে তবে, বিশাল মানবসম্পদের দেশ বাংলাদেশ নিজের আপন জনগণ দিয়ে কেন অস্ট্রেলিয়ার থেকে দশগুণ উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরী করতে পারবে না? আলোচনার ওই তিনটি জিনিস কি কথনই মিলবে না আমাদের?
__________________________

 

ডা. তারিক অনি

কে-৬১, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।

রেজিস্ট্রার, এক্সিডেন্ট এন্ড ইমার্জেন্সী

সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় কর্মরত।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়