Ameen Qudir

Published:
2019-08-29 23:59:35 BdST

"ম্যাডামকে উপর থেকে খুব কঠোর মনে হত,কিন্তু বাস্তবে ছিলেন পরম মমতাময়ীর প্রতিরূপ"


 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের জনপ্রিয়তম প্রাক্তন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সৈয়দা নূরজাহান ভূঁইয়া র মহাপ্রয়াণে বিরল কিছু স্মৃতিছবিসহ শোক এপিটাফ লিখেছেন, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক ,প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সায়েবা আখতার ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যার সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুলতানা আলগিন,প্রবাসী চিকিৎসক ও সাবেক ছাত্র নেতা ডা. রূপন রহমান ,প্রবাসী খ্যাতিমান শিক্ষক চিকিৎসক ডা. বি এম আতিকুজ্জামান ,নয়া দিল্লী থেকে শিক্ষক চিকিৎসক ডা. নাসির আহমেদ এবং
ঢাকা ডেন্টাল কলেজের শিক্ষক ডা.
ফরিদা ইয়াসমিন আকুল।



ডেস্ক
_____________________

উপমহাদেশের অন্যতম শীর্ষ গাইনোকোলজিস্ট ,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের জনপ্রিয়তম প্রাক্তন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সৈয়দা নূরজাহান ভূঁইয়া র মহাপ্রয়াণে তাঁর স্নেহধন্য হাজারো ছাত্রছাত্রী , তাঁর সেবা ধন্য লাখো জন সকলেই গভীর শোকার্ত। তাঁর স্নেধন্যরা বিভিন্ন শোকবানীতে তাঁর সম্পর্কে শোক শ্রদ্ধার পাশাপাশি বিভিন্ন দুর্লভ ঘটনার স্মৃতিচারণ করছেন। সেসব থেকে সংগৃহীত কিছু শোকবানী এখানে প্রকাশ করা হল। শোক এপিটাফে তারা বলেন, ম্যাডাম ছিলেন আমাদের মাতৃপ্রতীম। তাঁকে উপর থেকে খুব কঠোর মনে হত। কিন্তু স্নেহ সান্নিধ্যে গিয়ে দেখেছি , তিনি ছিলেন পরম মমতাময়ীর প্রতিরূপ।


চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক লিখেছেন,

We have lost a mother,a great teacher, a giant administrator, an obstetrician of enviable popularity, above all an honest and transparent personality.Prof.Nurjahan Bhuiyan, left us a few hours back. She has produced innumerable number of medical doctors and teachers and specially OBG specialists who are serving humanities throughout the world. I will never forget the affection and love I got from her during my acquaintances with her in the Chittagong Medical College. She was a mother figure for everyone in the medical campus.


প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সায়েবা আখতার লিখেছেন,

·
Our beloved teacher, Past president OGSB Chittagong Branch, Ex Professor and Principal of Chittagong Medical College, Dean Faculty of Medicine, Chittagong University, Prof. Syeda Nurjahan Bhuiyan Madam left us all behind at 3 am, 29: 8: 2019.

Let us pray for the departed soul and for her family to have the strength to live without her.

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যার সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুলতানা আলগিন তাঁর শোক এপিটাফে লিখেন, ম্যাডাম ছিলেন আমাদের মাতৃপ্রতীম। তাঁকে উপর থেকে খুব কঠোর মনে হত। কিন্তু স্নেহ সান্নিধ্যে গিয়ে দেখেছি , তিনি ছিলেন পরম মমতাময়ীর প্রতিরূপ। শিক্ষকরূপ,মাতৃরূপ , কল্যাণী রূপ সব রকম স্নেহের আঁধার হিসেবে আমরা যারা তাকে পেয়েছি, আমৃত্যু আমাদের স্মৃতিতে তিনি চির জাগরুক ও অমর হয়ে থাকবেন। তাঁর নেতৃত্ব গূন, শিক্ষকতার অনন্য ভঙ্গি সবই আমাদের চলার পথের পাথেয়।

 

প্রবাসী চিকিৎসক ও সাবেক ছাত্র নেতা ডা. রূপন রহমান লিখেছেন,

রুপে নয় গুনে কিংবা মহিলা হয়েও যিনি তারঁ সমসাময়িক অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন ম্যাডাম নূরজাহান ভূঁইয়া তার উদাহরন । চিকিৎসা বিজ্ঞানে এবং দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তাঁর অবদান স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে । ওনাকে নিয়ে ক্যাম্পাসে একটু অহেতুক ভীতি জড়িয়ে থাকতো কিন্তু যেই ওনার কাছাকাছি গিয়েছেন তারা সবাই জানতে পেরেছে ভীতিটা ছিলো সম্পূর্ন কল্পনা প্রসূত । মায়ের ভালোবাসা এবং স্নেহ নিয়েই তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের আপন করে নিতেন । তবে তিনি কাউকে ভয় পেতেন না । একাডেমিক কাউন্সিল হোক কিংবা ডিসিপ্লিনিনারি কাউন্সিল হোক পুরুষ সহকর্মীকে তোয়াক্কা না করে সত্যের প্রতি ছিলেন সোচ্চার । রাতের আধাঁরে তাঁর চেম্বার ভেংগেও আমার কিছু সিনিয়র ছাত্র নেতাদের উদ্দেশ্য পূর্ন হয়নি আমি তার স্বাক্ষী । তিনিই প্রথম চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক মা ও প্রসুতি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সম্মেলনের আয়োজক । তিনিই প্রথম বাংলাদেশী চিকিৎসক যার লেখা অন্যদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাঠ্যবুকে স্থান পেয়েছে কিংবা তাঁর অবদান স্বীকৃত হয়েছে । ম্যাডামের সেই বিখ্যাত " রিনি ঝিনি" কন্ঠস্বর , বাসার বিশাল কালো কুকুর , সম্মেলন আয়োজনে রাতদিন খাটাখুটি , ভাইভা বোর্ডে চিরচেনা হাসি , সব ছাপিয়ে মা মা মুখ ... কিছুই ভুলিনি এখনো এবং ভুলবোও কোনদিন ।

 


প্রবাসী খ্যাতিমান শিক্ষক চিকিৎসক ডা. বি এম আতিকুজ্জামান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে লিখেছেন,



বিয়ের পরপরই সিলভিকে নিয়ে ঢাকা গিয়েছিলাম।

অধ্যাপিকা সৈয়দা নুরজাহান ভুঁইয়া ম্যাডামকে জানানোমাত্র তিনি সিলভিকে নিয়ে চাটগাঁ আসতে বললেন। কলেজে সাহিত্য সাংস্কৃতিক উৎসব হচ্ছে জানালেন।

 

সেবার স্বীয় পুত্রবধুর মতো করে খুলশীর বাড়িতে সিলভিকে বরন করে নিয়েছিলেন তিনি।

ম্যাডামের সাথে আমাদের অনেক স্মৃতি।
আমি ভাগ্যবান যে তাঁর কাছে যেতে পেরেছি।

অসাধারন এ চিকিৎসক, অধ্যাপিকা এবং বড় মনের মানুষ আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন পরপারে।

মহান করুনাময়ের কাছে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। তিনি জান্নাতবাসী হোন।

 

 

নয়া দিল্লী থেকে শিক্ষক চিকিৎসক ডা. নাসির আহমেদ লিখেছেন,

আমাদের চিকিৎসক সমাজের অতি শ্রদ্ধাভাজন খুব আপনজন উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান গাইনিকোলোজিস্ট অধ্যাপিকা ডা: সৈয়দ নুরজাহান ভূঁইয়া ম্যাডাম আর আমাদের মাঝে নেই । তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক—আমাদের শিক্ষক। তাঁর মতো এত সুন্দর করে পড়ানোর যোগ্যতা ছাত্রজীবনে এবং পরবর্তী সময়ে হাতে গোনা দু-এক জনের মাঝে পেয়েছি মাত্র। তাঁর বাচনভঙ্গিমা ছিলো অসাধারণ। অসাধারণ ছিলো তাঁর ধী-শক্তি। আমরা তাঁকে প্রচন্ড ভয় পেতাম আর ভক্তি করতাম মায়ের মতো।আমরা বলতাম—ব্লাক ডায়মন্ড। তিনি হেঁটে চলছেন—সেই দৃশ্য এখনো চোখের সামনে ভাসছে। তিনি যেন রঙিন সিল্কের শাড়ি পড়ে খটখট শব্দ করে মেঝের দিকে আনত নয়নে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন লেকচার গ্যালারির দিকে।

 


তিনি ছিলেন চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ। কখনো অধ্যক্ষ হিসেবে, একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে আবার কখনো অভিভাবক হিসেবে কতবার তাঁর সান্নিধ্যে গিয়েছি—আর বার বার শ্রদ্ধায় নত হয়েছে এই মন। তাঁর
চেম্বারে গিয়েছি সময়ে অসময়ে কত বার। চেম্বারে এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি আমাকে সময় দিয়ে হাসিমুখে কথা বলেছেন—মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন আমার কথা। আজ অশ্রু ঝরছে দুই চোখ গলে আর মনে পড়ছে সব স্মৃতি-কথা।

 


অনেক কথা জমা আছে ম্যাডামকে নিয়ে।তবে একদিনের কথা খুব মনে পড়ছে এ মুহুর্তে। ম্যাডামের খুলশীর বাসায় এক পার্টিতে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি তখন ৫ম বর্ষের ছাত্র। গিয়ে দেখি বিশাল জমজমাট আয়োজন। সেখানে সবাই সিনিয়র ডাক্তার আর গাইনি-অবস বিভাগের সকল পর্যায়ের ডাক্তার। কোন ছাত্র-ছাত্রী নেই। আমিই এক মাত্র ছাত্র। ম্যাডামের স্বামী তখন বিশাল শিল্পপতি—ইউনি গ্রুপের—পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁর এক মাত্র পুত্রের সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিলো। ম্যাডাম যে সে সময়ের ছাত্রদের মাঝে আমাকে কতটা ভালবাসতেন সেদিনই আমি প্রথম তা হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হলাম। আজো সেই ভালোবাসা আর স্নেহের গর্ব ধারণ করে আছি। তবে আমি যে হতভাগা তাঁর স্নেহ ভালোবাসার দাম দিতে পারলাম না। আজ তাঁকে শেষ দেখা দেখতে পারলাম না।
২৯.৮.১৯/ দিল্লী।

 

 

 

 


ঢাকা ডেন্টাল কলেজের শিক্ষক ডা.
ফরিদা ইয়াসমিন আকুল স্মৃতিচারণে বলেন,


আমি তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। কান্তা ছাত্রী নিবাসে থাকি।ছন্নছাড়া হোস্টেল জীবনের সাথে তখনো খাপ খাওয়াতে পারিনি।সুযোগ পেলেই আত্মীয় স্বজনদের বাসায় হামলা করি সদলবলে। তা সে আত্মীয় নিজের হোক বা বন্ধুর হোক। তেমনি এক আত্মীয় লিপির খালা। বাসা মেডিকেল সংলগ্ন মেহেদীবাগে।খালুজান ডাক্তার।খুবই সজ্জন ব্যক্তি।একদিন কথাপ্রসঙ্গে বললেন," মেয়েদের ডাক্তারি পড়া উচিৎ নয়,দেশের ক্ষতি!"এ ধরনের কথায় রেগে যাওয়া স্বাভাবিক।মেডিকেলের ছাত্রী হিসাবে সবার কাছে বিশেষ
"সম্মান " পেতে ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।স্বপ্ন দেখার দিন আমাদের। ।আর খালুজানের এই কথা!!
উনি বুঝিয়ে বললেন, " একটা ছেলে ডাক্তারি পড়লে পুরা একটা পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে। একটা মেয়ে ডাক্তার হলে,সে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কিছু করতে পারেনা। আমাদের সমাজে মেয়েদের একা একা যাতায়াতের সমস্যা,বিয়ের পর সংসার দেখাশোনা, শ্বশুর বাড়ির অনুমতি... এইসব... তাকে ডাক্তার হতে বাঁধা দেয়! এতগুলো বছর ব্যয় করে এত কষ্টের পড়াশুনা তার কোন কাজে লাগেনা।সরকার তার পিছনে যে ব্যয় করে সব লস।সবাই কি আর "নূরজাহান ভুঁইয়া" হতে পারে!!"

নূরজাহান ভুঁইয়া!!

ম্যাডামকে তখন শুধু দূর থেকে দেখেছি।থার্ড ইয়ার থেকে ম্যাডামকে পাই লেকচার ক্লাসে , ওয়ার্ডে ।।ইন্টার্নশিপ এবং গাইনীতে পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনিং করার সময় ম্যাডামকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই।একজন গাইনোকলজিস্ট কি পরিমাণ কাজের লোড নিতে পারে,তা একজন সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারবেনা। শুধু টাকার জন্যে কেউ এই খাটুনি খাটেনা। একজন মরনাপন্ন রোগী যখন আসে তখন তাকে সুস্থ্য করার যে চ্যালেঞ্জ এবং সেই রোগী সুস্থ্য হয়ে যখন হাসিমুখে বাড়ি যায় অথবা একজন মায়ের কোলে তার শিশুকে প্রথম তুলে দেয়ার যা তৃপ্তি, তার কোন মূল্য হয়না। টাকা এখানে বাই প্রোডাক্ট।

আর নূরজাহান ম্যাডাম শুধু একজন গাইনোকলজিস্টই ছিলেন না,তিনি নিজেই ছিলেন একটা প্রতিষ্ঠান। আমার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ নারী, মেধাই যার সৌন্দর্য। স্মার্টনেস যার জন্মগত। কোকিলকন্ঠি ম্যাডামের লেকচারের সময় গ্যালারি থাকত কানায় কানায় পূর্ণ। ওটিতে তাঁর উপস্থিতিই সবার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিতো।
খালুজান ঠিকই বলেছিলেন। নূরজাহান ভুঁইয়া প্রতিদিন প্রতিবছর জন্মায় না।একজন নূরজাহান ভুঁইয়ার জন্য যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে হয়।
তাঁর অগুনিত সফল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আমার অবস্থান ধূলিকণা সম।সাহসের অভাবে ট্রেনিং করা সত্বেও গাইনী পড়িনি।

তবুও আমি সৌভাগ্যবান,জীবনের একটা সময় এই মহীরুহের ছায়া পেয়েছি।

 

ম্যাডাম আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাঞ্জলি ।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়