Ameen Qudir

Published:
2019-04-06 18:45:39 BdST

কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নির্মমভাবে পেটানো হল কর্তব্যরত ডাক্তারকে


 

ডেস্ক
_____________________

আবারও ৪ এপ্রিল কক্সবাজারে নির্মম ভাবে পেটানো হল কর্তব্যরত ডাক্তারকে। ভাংচুর করা হয় একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে । এ ব্যাপারে বিএমএ নেতা ও ওই হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাহেদুল ইসলাম শার্দুল জানান, কর্তব্যরত ডাক্তারকে বিনা বাক্য ব্যয়ে আমাদের চিরাচরিত 'ভুল চিকিৎসার' ইস্যু তুলে পরবর্তী আধাঘন্টা ধরে নির্মমভাবে ওয়ার্ডেই পেটানো হয়, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের জামাকাপড়। চিকিৎসক মার খাওয়ার সময় বারবার একটি কথাই বলছিলেন, আমি এখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছিনা, আমার দোষ থাকলে আপনারা তার বিচার করুন, কিন্তু এভাবে হেনস্থা করবেননা। কিন্তু বীর বাঙালি এমন উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে কি এসব ছাইপাশ শুনে?!! এর মধ্যে যারাই তাদের বাধা দিতে এসেছেন তারাও পিটুনি খেয়েছেন। মার থেকে বাদ যাননি মহিলা ইন্টার্ণ চিকিৎসকরাও। তালিকায় ইন্টার্ণ চিকিৎসক থেকে শুরু করে নার্স, স্টাফ সবাই ছিলেন। শুধু মেরেই তাদের মৃত্যুশোক কমেনি, ভেঙ্গে তছনছ করা হয় ডাক্তারের রুমের প্রতিটি আসবাব।

ডা. শাহেদুল ইসলাম শার্দুল এর বিস্তারিত বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হল।

যে কোন মৃত্যুই কষ্টের। ৪ এপ্রিল কক্সবাজার সদর (মেডিকেল কলেজ) হাসপাতালে ভর্তি একজন রোগী মারা গেছেন। তিনি একিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস (acute pancreatitis) এর ব্যাথা নিয়ে দু-দিন ধরে ভর্তি ছিলেন। সেদিন তাঁর ব্যাথা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। মর্নিং রাউন্ডে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখেও গিয়েছেন। আর কর্তব্যরত ডাক্তাররা তো সময়ে সময়ে খোঁজ নিচ্ছিলেনই। বাস্তবতা হল, আমাদের হসপিটাল সেটিংয়ে (কক্সবাজার সদর হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ২৫০, এখানে জনবল নিয়োজিত আছে ১০০ শয্যার, আর প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে গড়ে ৬৫০!) প্রতিটি মুহুর্ত একজন রোগীর বেডের কাছে বসে থাকা সম্ভব না। (যেটা হয়ত মাউন্ট এলিজাবেথে সম্ভব!) যা হোক, দুপুর দুইটায় কর্তব্যরত চিকিৎসক ওয়ার্ডে অন্য রোগী দেখছিলেন। ওই সময় ওই রোগীর এটেনডেন্ট এসে বলেন তার রোগী কেমন যেন করছেন। কর্তব্যরত ডাক্তার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন রোগীর লোকেরা 'কেমন যেন' করছেন বলা মানে পরিস্থিতি ভাল না। তিনি তৎক্ষণাৎ অন্য রোগীর কাজ ফেলে সেই রোগীর কাছে যান এবং দেখতে পান রোগী মূমুর্ষুপ্রায়। রোগীর লোকের consent (মৌখিক অনুমতি) নিয়ে তিনি সাথে সাথেই সহযোগী ইন্টার্ণ ডাক্তারদের সাথে নিয়ে CPR (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) শুরু করেন। প্রায় আধা ঘন্টা CPR দেয়ার পরও রোগীকে বাঁচানো সম্ভব না হলে আধাঘন্টাব্যাপি পরিশ্রমে (CPR একটি শ্রমসাধ্য কাজ) ক্লান্ত বিষন্ন সেই কর্তব্যরত ডাক্তারকে বিনা বাক্য ব্যয়ে আমাদের চিরাচরিত 'ভুল চিকিৎসার' ইস্যু তুলে পরবর্তী আধাঘন্টা ধরে নির্মমভাবে ওয়ার্ডেই পেটানো হয়, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের জামাকাপড়। চিকিৎসক মার খাওয়ার সময় বারবার একটি কথাই বলছিলেন, আমি এখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছিনা, আমার দোষ থাকলে আপনারা তার বিচার করুন, কিন্তু এভাবে হেনস্থা করবেননা। কিন্তু বীর বাঙালি এমন উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে কি এসব ছাইপাশ শুনে?!! এর মধ্যে যারাই তাদের বাধা দিতে এসেছেন তারাও পিটুনি খেয়েছেন। মার থেকে বাদ যাননি মহিলা ইন্টার্ণ চিকিৎসকরাও। তালিকায় ইন্টার্ণ চিকিৎসক থেকে শুরু করে নার্স, স্টাফ সবাই ছিলেন। শুধু মেরেই তাদের মৃত্যুশোক কমেনি, ভেঙ্গে তছনছ করা হয় ডাক্তারের রুমের প্রতিটি আসবাব।

প্রশ্ন হল, ডাক্তার কি রোগীর জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারে? অবশ্যই না। সে যা পারে তা হল, নিয়মানুযায়ী চেষ্টা করা। এক্ষেত্রে তার কোন ত্রুটি ছিলনা। তাহলে কেন এই প্রতিক্রিয়া? একজন ডাক্তার তার সবটুকু দিয়ে কাজ করার পরও (ফলাফল রোগীর অনুকুলে না এলে) যদি শারীরিকভাবে প্রহৃত হয়, জীবনাশঙ্কায় থাকে, তাহলে সে কেন কাজ করবে? অথচ সাংবাদিকরা কালও নিউজ করলেন কসাই ডাক্তাররা চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছে। নিউজে একটিবারও বলা হলনা যে চিকিৎসক অন্যায়ভাবে প্রহৃত হয়েছেন! ভাবটি এমন মার খেয়ে যান, তবু চিকিৎসা ঠিকঠাক দেয়াই লাগবে। কারণ আপনারা মানুষ না কসাই। কসাইদের আবার মানবিক অধিকার আছে নাকি?

আমি মনে করি, এই দেশে কেউ কারো অধিকার যেচে দিবেনা। নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করতে হবে। রাজনৈতিক নেতারা আসবেন, সবকিছু দেখবেন কিন্তু বিচারটি ঝুলিয়ে রাখবেন। এক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। মাননীয় মেয়র মহোদয় এসেছেন, শুনেছেন। এমনকি বলেছেন এই রোগটি (acute pancreatitis) সম্পর্কে উনি ভালমতনই জানেন। কারণ তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ ছিল এই রোগ। উনি খুবই আন্তরিক ছিলেন, তথাপি ডাক্তারদের এই অনিরাপত্তার definitive কোন সমাধান তিনি দেননি। আশ্বাস দিয়েছেন এমন কাজ আর হবেনা।

আমরা আশ্বাস চাইনা, আমরা বিচার চাই। এই বিচার শুধু ডাক্তারের স্বার্থে নয়, এই বিচার আপামর রোগীর স্বার্থে। সিংহভাগ রোগীরাই নিরীহ। কিন্তু গুটিকয়েক বীর বাঙালির বাহাদুরির খেসারত দিতে হয় তাদেরকেই। কারণ যারা ঝামেলা করে তারা প্রাইভেট ক্লিনিকেও দেখাতে পারে, যারা ঝামেলায় নেই, নীরিহ নাগরিক তাদের তো সম্বল ওই সরকারি হাসপাতালটাই। সুতরাং সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করলে সাধারণ নাগরিকেরই লাভ। সাংবাদিকদের বলব, আপনারা ডাক্তারদের পেছনে অযৌক্তিকভাবে লাগবেননা দয়া করে। আর নেতাদের কাছে অনুরোধ, হামলাকারীদের বিচার করে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মস্থলে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে দিন। তাতে জনসাধারণই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে।
_____________________________

ডা. শাহেদুল ইসলাম শার্দুল
Cultural and Entertainment Secretary at BMA, Cox's Bazar
Medical Officer, Blood Transfusion Department at 250 Bed District Sadar Hospital, Cox's Bazar

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়