Ameen Qudir

Published:
2019-04-01 21:48:26 BdST

'উপজেলার নেতা ফোন করে জানতে চেয়েছেন, উক্ত ইনজুরি সার্টিফিকেট বদলানো যাবে কিনা?'


 

 

 

ডাঃ আজাদ হাসান
______________________________


আজ মেডিক্যাল/ইনজুরি সার্টিফিকেট নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।

আমি তখন চট্টগ্রামের একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকুরী করি।

১৯৯৫ সনের কোনো একদিন। সেদিন জরুরি বিভাগে ডিউটিতে ছিলাম। এমন সময় ২০/২২ বছরের একজন মহিলা আসলেন মাথায় ইনজুরি নিয়ে। স্কাল্প ইনজুরি হওয়ায় বেশ ব্লিডিং হচ্ছিল। হিস্ট্রি নিয়ে জানতে পারলাম দাম্পত্য কলহের জের ধরে স্বামী কর্তৃক মেয়েটি আহত হয়েছে। আমি একটা প্রশ্নের কোনো উত্তর পাই না, যে মেয়েটি তার বাবা-মায়ের আদর, ভাই-বোনের মায়া ভরা স্নেহের বন্ধনকে ছেড়ে স্বামীর সংসারের সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং একটা নতুন পরিবেশে চলে আসে, যে তার স্বভাবজাত সব আরাম আয়েশকে বিসর্জন দিয়ে প্রতিনিয়ত স্বামীর সেবা করে থাকেন, সর্বোপরি যেই স্বামীর উপর ভরসা রেখে স্বামীর হাত ধরে বাবা-মায়ের গৃহত্যাগ করেন, সেই স্বামী কি করে তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে!
যা হোক ইমার্জেন্সীর রেজিস্ট্রারে ইনজুরি নোট লিখে, রোগীর ওন্ড (wound) শেলাই করে ড্রেসিং করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিলাম। তবে মেয়েটিকে বেশ দূর্বল দেখাচ্ছিল। হয়তো দাম্পত্য কলহের কারণে কতক্ষণ না খেয়ে আছে কে জানে। মেয়েটির জন্য একটা সফ্ট কর্নার বা সিমপ্যাথাইজ হয়ে পড়লাম। মেয়েটিকে ঐ মূহুর্তে আমার খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো। আমি জানি না এখান থেকে সে কি বাপের বাড়ী যাবে নাকি স্বামীর গৃহে যাবে। স্বামীর গৃহে গেলে সেখানে সে কতটা নিরাপদ থাকবে? এসব নানা ভাবনার মাঝে যে সমাধানটি মাথায় এলো সেটা হলো, আপাততঃ মেয়েটিকে হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করে দেই, যাতে করে মেয়েটি কিছুটা হলেও মানসিক নিরাপত্তা পাবে। তারপর অবস্থার উন্নতি হলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তির দু'দিন পর ছেড়ে/ডিসচার্জ দেই।

এর দু-একদিন পর ঐ মেয়েটির স্কুল শিক্ষক বাবা আসলেন মেডিক্যাল (ইনজুরি) সার্টিফিকেট-এর জন্য। ইমার্জেন্সি রেজিস্টার হতে ইনজুরি নোট অনুযায়ী মেডিক্যাল /ইনজুরি সার্টিফিকেট দিয়ে দেই।

পরদিন টিএইচ এন্ড এফপিও স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি উক্ত রোগীকে কোনো মেডিক্যাল সার্টিফিকেট ইস্যু করেছি কিনা? আমি বললাম জ্বি, আমি উক্ত রোগীর মেডিক্যাল সার্টিফিকেট ইস্যু করেছি। উনি আমাকে বললেন, উপজেলা হতে স্থানীয় কোনো একজন নেতা নাকি ওনাকে ফোন করে জানতে চেয়েছেন, উক্ত সার্টিফিকেট কি পরিবর্তন করা যাবে কিনা? টিএইচ এন্ড এফপিও স্যার অত্যন্ত সজ্জ্বন ব্যক্তি ছিলেন, আমি জানি আমাকে এই প্রশ্নটা করতে ওনারও বিবেকের দংশন হচ্ছিল, তারপরও চেয়ারের খাতিরে উনি আমাকে প্রশ্নটি করেন। আমি ওনাকে বললাম, ওনাকে জানিয়ে দিন যে, "ডাক্তার সাহেব রোগী পরীক্ষা করে যা পেয়েছেন, মেডিক্যাল রিপোর্টে তা-ই উল্লেখ করেছেন, উনি যা লিখেছেন তা উনি বাড়াতে কিংবা কমাতে পারবেন না"।

ঘটনা চক্রে সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার, আর রবিবার থেকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে এআরআই-এর(Acute Resp. Tract Infection) উপর সম্ভবত ৩/৪দিনের একটা ট্রেনিং প্রোগ্রাম ছিলো। যা হোক, আমি আমার মতো ঢাকায় চলে যাই।

@@@@@
আমি তখন হাসপাতালের কোয়ার্টারে থাকতাম। ঢাকার ট্রেনিং শেষে আমি যথারীতি ডিউটিতে জয়েন করার উদ্দেশ্যে আমার কর্মস্থলে ফিরে যাই । কিন্তু বাসায় ঢুকতে যেয়ে খটকা লাগলো। কি যেনো নাই মনে হচ্ছে(?) হ্যা, তাই তো আমার সাইন বোর্ডটি যথা স্থানে নাই।

পরে যে ছেলেটি আমাদের রান্না করে খাওয়াতো ওর কাছে জানতে পারলাম যে, জনৈক নেতার চামচারা এই অঘটন ঘটিয়েছে। আমার আর কিছু বোঝার বাকী থাকলো না। এসব বিষয়ে অভিযোগ করে লাভ হবে বলে মনে হলো না, তাই দাতে দাত চেপে অপমানটা হজম করতে হলো।

@@@@@
এরও প্রায় বছর দুয়েক পরে দেখি ঐ মেয়েটি (মহিলা) কোলে একটি ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে আউট ডোরে অপেক্ষা করছে। সম্ভবতঃ বাচ্চাকে টীকা দিতে কিংবা চিকিৎসা করাতে এসেছে।

আমার তখন অতীতের স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। প্রকৃত ঘটনা ছিলো, (যা আমি পরে নিশ্চিত হতে পারি), সেদিন আসলে ঐ মেয়েটিকে ওনার স্বামী মেরেছিলো। এতে মেয়েটি আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসে।
এই ঘটনার জের ধরে চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে হয়তো দুই পরিবারের মাঝে হয়তঃ সমস্যা তৈরী হয়, যা হয়তঃ তাৎক্ষণিক ভাবে সমাজিক ভাবে সমঝোতা করা সম্ভব হয়নি বিধায় আইনের আশ্রয় নিতে যেয়ে মেডিক্যাল ইনজুরি সার্টিফিকেট এর প্রয়োজন হয়। আর এসব ইনজুরি যেহেতু "সিম্পল ইনজুরি" তাই উকিল সাহেবদের কাছে গেলেই ওনারা বলেন, এই সার্টিফিকেট দিয়ে কিছু হবে না, এটা "গ্রিভিয়াস হার্ট'' বানিয়ে আনুন। আর তখনই পার্টির দৌড় ঝাপ শুরু হয়। অতীতে হয়তো আামাদের প্রফেশনের অনেকে এ ধরণের পরিস্থিতিতে উল্টা-পাল্টা সার্টিফিকেট দিয়ে থাকতে পারেন আর সেই কারণে হয়তো উকিল সাহেবরাও এমনটি বলে থাকতে পারেন। কিন্তু কেউ চাইলেই তো আর সিম্পল ইনজুরিকে "গ্রিভিয়াস হার্ট" লেখা যায় না। ফরেন্সিক মেডিসিন বই অনুযায়ী এর জন্য ৮ টি খাত নির্দিষ্ট করা আছে। তাই এখানে ডাক্তারদেরও দায়বদ্ধতা আছে। সেটা একদিকে যেমন নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত তেমনি ব্যক্তিগত ভাবে পেশাগত সার্টিফিকেট এর নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত। কেননা, কেউ যদি ভূয়া মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেন এবং তা কোর্টে প্রমাণিত হয় তা হলে ঐ ডাক্তারের জেল জরিমানা হতে পারে এমন কি সার্টিফিকেট পর্যন্তও বাতিল হতে পারে। তাই জেনে শুনে কেউ নিশ্চয় এই বোকামি করবেন না।
আমার কথা হলো, আমি এ ক্ষেত্রে "নো কম্প্রোমাইজ'।
যা হোক, যে কথাটি বলার জন্য ঘটনাটির উল্লেখ করলাম তা হলোঃ

ধরুন যদি আমি সেদিন ফল্স বা মিথ্যা সার্টিফিকেট দিতাম, তা হলে এই কেসটি অনেক দূর গড়াতো, যার অবশ্যম্ভাবি পরিণতি হতো ডিভোর্স। আর সেটা কি মেয়েটির জীবনের জন্য ভালো হতো? আর যদি ডিভোর্স হতো, তখন মেয়েটির স্থান হতো ঐ স্কুল শিক্ষক বাবার গৃহে। ঐ বাবার ঘরে তখন আরো দু'একজন বিবাহযোগ্যা কণ্যা থাকাটাও অসম্ভব নয়। এমতাবস্থায় পিতৃগৃহে ঐ মেয়েটির জীবন কি দূর্বিষহ হয়ে উঠতো না?

★ আমার ধারণা দুটি' পরিবারের মাঝে পরবর্তীতে সমঝোতা হয়েছে, মেয়েটিও তার স্বামীর গৃহে ফিরে গিয়েছে। পেয়েছে নতুন জীবন, পেয়েছে নতুন শিশু, পেয়েছে নতুন করে বেচে থাকার আশ্বাস।

এরপর অনেকদিন আমি মনে মনে ঐ স্কুল মাস্টার সাহেবকে খুজেছি। যদি আমার সামনে পড়তো তা হলে আমার ইচ্ছে ছিলো, ওনাকে প্রশ্ন করবোঃ

★ কেনো সেদিন আপনি মিথ্যা সার্টিফিকেট এর জন্য স্থানীয় নেতার মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন?
★কেনো আমার বাসা হতে আমার সাইন বোর্ড সরিয়ে ফেলে আমাকে অপমান করেছিলেন?
★ যদি আমার দ্বারা প্রদত্ত ফল্স বা মিথ্যা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট এর কারণে ওনার মেয়ের সংসার ভেংগে যেতো তা হলে কি সেই দায় ওনি বহন করতেন?

কিন্তু এরপর আর ঐ স্কুল শিক্ষক-এর সাথে দেখা হয়নি, আর আমার প্রশ্নগুলোও ওনাকে করা সম্ভব হয় নি।

_____________________________

ডাঃ আজাদ হাসান।
সিওমেক।
২১ তম ব্যাচ।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়