Ameen Qudir

Published:
2019-03-24 20:45:35 BdST

সিএ, রেজিস্ট্রার ডাক্তাররা নিঃশব্দে যে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, আমরা কখনো তা প্রচার করি না


 


ডাঃ আজাদ হাসান
__________________________

নিজের স্মৃতির পাতা হতে লেখাটা শুরু করব। এ স্মৃতি ভুক্তভোগী ডাক্তার সকলের।


সময়টা ১৯৮৯ সন। আমরা এক ঝাক তরুণ (তরুণী) নবীন ডাক্তার সদ্য এমবিবিএস ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষা পাশ করে তখন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নি ডাক্তার হিসেবে জয়েন করেছি। আমি যে সময়টার কথা বলছি তখনো সিলেট সদরের সাথে সব উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনকার মতো এতটা উন্নত ছিলো না।

তা ছাড়া সিলেটে প্রাইভেট ক্লিনিক বলতে তখন হাতে গণা কয়েকটি ক্লিনিক ছিলো। তার মাঝে উল্লেখ যোগ্য ছিলো নূরজাহান পলি ক্লিনিক, সেন্ট্রাল ক্লিনিক, আয়শা ক্লিনিক আর এর বাহিরে যে দু'একটি ক্লিনিক ছিলো এ মুহূর্তে সেগুলোর নাম স্মরণ করতে পারছি না। কিন্তু প্রাইভেট ক্লিনিকের চিকিৎসা ব্যয় তখনও এত বেশী ছিলো যে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষেও সেই ব্যয় সামলানো সম্ভব ছিলো না। তাই নিম্নবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্তের চিকিৎসার জন্য শেষ ভরসা ছিলো সরকারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

ইন্টার্নিশিপ ট্রেনিং এর সময় লক্ষ্য করেছি, রাত যতো বাড়তে থাকতো, অবস্ ওয়ার্ড এর ব্যস্ততাও ততই বাড়তে থাকতো। দূর-দূরান্তের সব কম্পলিকেটেড্ এবং অবস্ট্রাকটেড লেবারের রোগীরা তখন আসতো। বেশীর ভাগ রোগীই আসতো গ্রাম হতে এবং হত দরিদ্র পরিবারের। এদের কেউ আসতো "হ্যান্ড প্রোলাপ্স" আবার কেউ আসতো "ঠ্যাং প্রোলাপ্স" বা "লেগ প্রোলাপ্স" নিয়ে, কখনো কখনো আবার "রাপ্চার্ড ইউটেরাস" নিয়ে আসতো। ওনাদের দেখলেই বোঝা যেতো কি ধরনের অর্থনৈতিক পরিবার থেকে ওনারা এসেছেন। ওনাদের চোখে তাকালেই ওনাদের অসহায়ত্ব বোঝা যেতো। কেমন করে ওনারা রোগীর চিকিৎসা চালাবেন তাও তারা জানেন না। কিন্তু ওনাদের রোগীকে সুস্থ করে তোলার দারুন আকুতি এবং নিজেদের অসহায়ত্ব ফুটে উঠতো চোখে মুখে।

আর তখন ঐ সব জটিল রোগীদের নিয়ে রাতভর চলতো ইমার্জেন্সী ওটি। চলতো যমে-মানুষে টানাটানি। হাসপাতালে প্রয়োজনীশ ঔষধের সরবরাহ পর্যাপ্ত না হওয়ায় পড়তে হতো বিপাকে। কিন্তু নবীন ডাক্তার আর ওয়ার্ডে কর্মরত ডাক্তারদের কর্ম প্রেরণা, উদ্যোম সর্বোপরি মানব সেবার ঐকান্তিকতা ঐ সব চিকিৎসা প্রত্যাশী সমাজের অবহেলিত এবং সমাজের সুবিধা বঞ্চিত রোগীদের সেবা থেমে থাকতো না। "পুওর ফান্ডে"র ঔষধ দিয়েই বেশীর ভাগ সময় রাতের ইমার্জেন্সী ওটিগুলো ম্যানেজ করা হতো। ছাত্র জীবন আমি যেহেতু সন্ধানীর সাথে যুক্ত ছিলাম আর তাই কোনো রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলেই রক্ত সংগ্রহ করার দায়িত্ব পড়তো আমার উপর। আর রক্তের জন্য আমি যে কত মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের ভোরের ঘুম ভাংগিয়ে ইমার্জেন্সী প্রয়োজনে ব্লাড কালেক্ট করেছি তার হিসেব নেই। ব্লাড ম্যানেজ করা শেষে ছুটেছি সন্ধানীর অফিসে পুওর ফান্ড হতে ঔষধ জোগাড় করার নিমিত্তে। মজার ব্যাপার হলো, আমরা যে রোগীর জন্য এতো কান্ড ঘটিয়ে চলেছি তা কিন্তু রোগী কিংবা রোগীর পরিচর্যাকারীও জানতে পারতো না। কারণ আমরা কখনো প্রচারমুখী ছিলাম না। আর তখন সবার হাতে মোবাইলও ছিলো না। সময়টা আবারো স্মরণ করিয়ে দেই, আজ হতে জাস্ট তিন দশক আগের কথা বলছি।

অনেক সময় পেসেন্ট ম্যানেজ করতে যেয়ে দেখেছি সিএ, রেজিস্ট্রার আপা/ভাইয়াদের খাওয়া-দাওয়ার সময় ঠিক থাকতো না। প্রতিটি এডমিশন নাইটে ওনারা সারা রাত নির্ঘুম ডিউটি করে, ইমার্জেন্সী ওটি করে সকাল আটটায় আবার প্রফেসর স্যারদের সাথে মর্নিং রাউন্ডে উপস্থিত থাকতে দেখেছি। আর তখন প্রফেসর স্যারের কাছে ওয়ার্ডে ভর্তিকৃত সব নতুন রোগী প্লাস পুরানো রোগীদের কেসগুলো প্রজেন্ট করতে হতো। ওয়ার্ডের রাউন্ড শেষে আবার কখনো কখনো ইমার্জেন্সি ওটি থাকলে সেটা নিয়ে আবার ওটিতে ঢুকতে হয়েছে। এভাবে ওয়ার্ডের সব রোগী ম্যানেজ করে প্রায় আড়াইটা-তিনটার দিকে রেস্ট নিতে যেতেন।

আমার বিশ্বাস এখনো প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনী-অবস্ বিভাগের সিএ, রেজিস্ট্রার ডাক্তাররা এভাবে নিঃশব্দে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, অথচ প্রচার বিমুখ ডাক্তারদের এই ত্যাগ বা সেবার কথা আমরা কখনো প্রচার করি না। আর তাই মিডিয়াতেও আসে না। আর আমাদের দেশের মানুষ ও এসবের ছিটে ফোটাও জানে না।

____________________________

ডাঃ আজাদ হাসান।
সিওমেক।
২১ তম ব্যাচ।

 

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়