Ameen Qudir

Published:
2016-11-11 02:27:50 BdST

‘পপপ’ মানে পরের পয়সায় পকেটভারিহাসপাতালের জার্নাল নতুন পর্ব


 

ডা. অরুণাচল দত্ত চৌধুরী
সিনেমার ভাষায় এতক্ষণ ফ্ল্যাশ ব্যাক হচ্ছিল।
ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড করে চলে যাই স্বর্গলোকের মত কল্পিত এক দেশের হাসপাতালে। অনির্ণেয় সেই কল্পলোকে আজ থেকে বহু বছর পরের এক সময়ে, প্রচুর প্রচুর লোকেরা ভিড় করে এক সরকারি হাসপাতালে আসে। সকালে আউটডোরে লাইন ফুরোতে চায় না। রোগীরা দেড় ঘণ্টা লাইন দিয়ে টিকিট জোগাড় করে। ডাক্তারের ঘরের সামনে লাইন দেয় আরও ঘণ্টাখানেক। ডাক্তারের সাথে ইন্টারঅ্যাকশন কিন্তু বেশিক্ষণের নয়। হওয়া সম্ভবও নয়। সরকারি ঢাকের আওয়াজে ঝাঁকে ঝাঁকে রোগী এসেছে। ডাক্তার বাড়েনি কিন্তু। সারাদিন ভিড় ইমারজেন্সিতেও। সরকারি ঢাকের সাথে বেচারা হাসপাতালের কাঁসরের আওয়াজ মেলে না।
অধিকাংশই রোগীই হদ্দ গরিব। যদিও উন্নয়নের নিরিখে সে দেশে তাত্ত্বিক হিসেবে কোনও গরিব নেই। যাদের কিছু নেই তাদের বিপিএল কার্ড বলে একরকমের বস্তু দেওয়া হয়েছে যার বলে তারা দু’টাকা দরে অমৃত অর্থাৎ অন্নসুধা পায় রেশন দোকান থেকে।
উঁহু… উঁহু… এ’তো হাসপাতালের জার্নাল। নিষিদ্ধ কোনও আনকথা নয়। এখানে শুধু হাসপাতালের কথা।
টালি ছাওয়া এক রাজপ্রাসাদে থাকেন পবিত্র গণতন্ত্রদেবের অধ্যাদেশ পাওয়া গ্রামবৃদ্ধা। তাঁর বরে সে দেশের সরকারি চিকিৎসকেরা অমরত্ব বর লাভ করেছে। ফরমান পেয়ে ডাক্তারেরা নাওয়া খাওয়া ভুলে চিকিৎসাযজ্ঞে নিজেদের আহুতি দেবার জন্য সমবেত হয়েছে। তাদের সবারই ম্লেচ্ছভাষায় যাকে বলে STD হয়েছে। এই STD মানে Sexually Transmitted Disease নয়। এর মানে সরকারি পরিভাষায় Service Till Death.
সেই হাসপাতালে ওষুধ সমেত চিকিৎসার কোনও খরচ লাগে না। স্বর্গীয় বুলেটিনে… মাঠেঘাটে প্রচারপত্রে ফ্লেক্সে তাইই বলা হয়েছে। ওষুধ সমেত সবই বিনা মূল্যে পাওয়া যাবে, তবু কী কারণে জানা যায় না, একরকমের ওষুধ বিপণি খোলা হয়েছে, প্রতি হাসপাতালে। দাম বাড়ানো ওষুধে সত্তর পার্সেন্ট কমিশন দিয়ে, ‘ন্যায্য মূল্যে’ বিক্রি করা হয় সে’খানে। পাপীরা সর্বত্র থাকে, এমনকি স্বর্গেও। যতদিন না হরেক কেস দিয়ে তাদের নরকে নিক্ষেপ কড়া হয়, তারা ফিসফিস করে বলতেই থাকে, এ’ হল ন্যায্য মূল্যে অন্যায্য ওষুধের দোকান। সে দোকানের কোনও ওষুধেই কাজ হয় না নাকি।
ওষুধের দোকানের পরে খোলা হল, সস্তায় প্যাথলজি আর রঞ্জনরশ্মি ছবির দোকান। ‘পপপ’ মডেল। ‘পপপ’ মানে পরের পয়সায় পকেটভারি’।
কেন? সরকারের হাসপাতালে কি বিনা মূল্যে ওই পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই? আছে। তবে কিনা ছোট অমাত্যর সেজ ভায়রার বড় পিসেমশাইর ভাগ্নেটি সেই অল্প দামের দোকানের বরাত পাওয়ায়, এখন মূল বিনি পয়সার সরকারি জায়গাটিতে লম্বা ডেট দেওয়া শুরু হয়েছে অমাত্যর নির্দেশে। প্রবল জ্বরের রোগীকে সাধারণ পরীক্ষা বা ইদানিংকার অন্য আরও ভয়ঙ্কর দঙ্গই রোগের যে পরীক্ষাটি… কিছুদিন আগেও হাসপাতালের ডাক্তার লিখলে সেই দিনই বা পরের দিন করে দেওয়া হত, হ্যাঁ বিনামূল্যেই, সে’টি এখন ডেট দেওয়া হয়। ডেট পাওয়া যায় অনেক পরে। তদ্দিনে রোগ হয় সেরে যায়, নয় রোগী অক্কা পায়। কাজেই লোকজন দঙ্গই মহামারীর আতঙ্কে ওই অল্প মূল্যের ‘পপপ’-মডেলে লাইন লাগায়। ভিড় উপচে পড়ে সে’খানে। কর্তারাও সঙ্গত কারণে চাপ দেন, ‘পপপ’তে কেস কম যাচ্ছে কেন? প্রসঙ্গত সেই কল্পরাজ্যে ডেথ সার্টিফিকেটে দঙ্গই রোগের নাম লেখা নাকি বারণ।

 

সেই কল্পলোকের হাসপাতালের আউটডোরে সে’দিন যাচ্ছেতাই এক কাণ্ড ঘটল। ‘শ্রীযুক্ত দাবার বোড়ে’ নামের এক ভারপ্রাপ্ত কর্মচারি একটা ব্যবস্থাপত্রের যান্ত্রিক ছবি নিয়ে এসে তার নিম্ন পদস্থ কর্মীদের প্রচুর বকাবকি করল।
দিন এনে দিন খায়… মরা গরিব। তাকে কেন ‘পপপ’তে পাঠিয়েছিস? মহামাত্যর কাছে নালিশ করেছে রোগী। ওরা কি কুবের, যে দঙ্গই রোগের রক্ত পরীক্ষার জন্য অন্যূন বারোশ’ মুদ্রা খরচ করতে পারবে? তোদের চাকরি খেয়ে নেব।
ঘোর অপদস্থ সেই নিম্নপদস্থ বোঝাতেই পারল না,
আজও হাসপাতালের বিনামূল্যের সরকারি পরীক্ষাগার এক জ্বরের রোগীকে পরীক্ষার তারিখ দিয়েছে অনেকদিন পরে।
সে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল মহামাত্য নিজেই তো নির্দেশ দিয়েছিল, সব কেস ‘পপপ’তে পাঠাতে। আজ কী হল তবে?

আসলে সে মূল গল্পটা জানত না।
পুরাকালে পৃথিবী নামক গ্রহের বহরমপুরে বাস স্ট্যান্ডের পাশে এক হোটেল ছিল। সেই হোটেলে মাংস অনেক সময় বাসী হয়ে কিঞ্চিৎ অম্লভাব ধারণ করত। খরিদ্দারকে সেই টকটক মাংসই পরিবেশনের নির্দেশ ছিল মালিকের। কখনও কোন ক্রেতা আপত্তি জানালে, পাচক ঠাকুরকে ডেকে পাঠাত মালিক।
প্রচণ্ড বকাবকি করত অতঃপর,
ঠাকুর, তোমারে বারবার কইসি মাংস রান্নায় এত দই দিবা না। এহনে বাবু কয় মাংস অতিরিক্ত টক হইসে। বাবুরে কও কী কইবা।
একদিন এ’হেন বকাবকির সময় আবেগের বশে ঠাকুরকে এক চড় মেরে বসেছে মালিক। ঠাকুর রুখে বলে উঠল,
খালি বকবার জইন্য এক পয়সা কইরা দ্যাও। আইজ চড় মারসো। পুরা একডা সিকি দিতে হইব আইজ।

আউটডোরে আজকের বকাঝকার নাটকটা সেই গল্পেরই স্বর্গীয় এডিশন। স্বর্গলোকে পয়সা খরচ করে তথাকথিত বিনি পয়সায় চিকিৎসা চলছে… চলবে।

 

লেখক - কলকাতার বিশিষ্ট চিকিৎসক । বিদগ্ধ লেখক। বাংলা রাজ্য সরকারের হেল্থ এন্ড ফেমিলি ওয়েলফেয়ারের কর্মরত।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়