Ameen Qudir

Published:
2016-12-17 05:43:17 BdST

স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বিশ্বাস করে সেবার যে চরম শিক্ষাটা পেয়েছিলাম


ডা. জামান অ্যালেক্স
____________________________

বিসিএসে পুলিশ ভেরিফিকেশন বলে একটা ব্যাপার আছে।ভেরিফায়েড হবার জন্য আমাকে ফোন করা হলো।থানায় গেলাম। ওসি সাহেব হ্যান কথা বলেন, ত্যান কথা বলেন-আমি ত্যক্তবিরক্ত.....

কথায় ত্যাঁনা প্যাঁচানো যে একটা বিশেষ সিগন্যাল-সেটা বুঝতে একটু দেরী হয়েছিলো। শেষে ওসি সাহেব বাঁ হাতে দু'হাজার টাকা নিয়ে পকেটে তা ভরে মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাকে মুহূর্তের মাঝে ভেরিফায়েড করলেন।আমি বিসিএস ক্যাডার হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যখাতে পদার্পণ করলাম....

ওরিয়েন্টশনের দিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সবাইকে নিজ গ্রামে যাবার জন্য রেডী হতে বললেন, পোস্টিং নাকি সেভাবেই হবে।আমি আনন্দিত ও রোমাঞ্চিত।যাক বাবা! বিসিএসের কারণে এবার নিজের গ্রামটা তো দেখা হবে! আমার আনন্দ আরো বাড়লো যখন মন্ত্রী নিজে বললেন--প্রত্যেক ডাক্তারের জন্য গাড়ীর ব্যবস্থা হচ্ছে।আমি, আমার বউ, আমার বোন-তিনজনই বিসিএস ক্যাডার।তিন-তিনটা গাড়ী! ওহ্ মোর খোদা!- এটাও সম্ভব! মন্ত্রীর মুখের কথা, অবিশ্বাস করিই বা কেমন করে! নিজের ব্যক্তিগত গাড়ী বিক্রির বিজ্ঞাপন রেডী করতে বসলাম.....

গেজেট পাবলিশ হলো।একবার গেজেটে আমার পোস্টিং প্লেস এর নামের জায়গায় চোখ বুলাই আর একবার টিভিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর চেহারাটার দিকে অবাক হয়ে তাকাই।

যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাকে যেতে হবে-গুগল ম্যাপেও তারে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, কিছুক্ষণ বসে বসে ঢোঁক গিললাম।

টিভিতে আবার তাকালাম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসছেন।উনাদের সব কথা বিশ্বাস করতে নেই- সেদিন এই বিশাল শিক্ষাটা উনিই আমাকে দিয়েছিলেন।ও হ্যাঁ, ভাগ্য ভালো, নিজের ব্যক্তিগত গাড়ীটি বিক্রি করিনি, কারণটা নিশ্চয়ই আর আপনাদের খুলে বলতে হবে না .....

কিভাবে দুর্গম সে জায়াগায় আমাকে যেতে হয়েছিলো-সেটা আর না বলি।লম্বা জার্নি, কাজেই জয়েনিং প্লেসে গিয়ে প্রথমেই টয়লেট কোথায় তা জেনে সেখানে ঢুকে ভয়াবহ গন্ধে এক ঝটকায় বের হয়ে আসতে হলো, দু'একবার বমিও আসতে চাইলো।কারেন্ট এই আছে তো এই নেই, বিশুদ্ধ খাবার পানিও জোটে না- অদ্ভুত এই জায়গা থেকে কিছুদিন পর অন্য আরেক অজপাঁড়াগায়ে জয়েনিং এর অর্ডার আসলো....

নতুন জায়গায় জয়েন করলাম, আমার ওয়াইফের পদায়ন হলো আমার কর্মস্থল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে আরেক গহীন অরণ্যে।তার হসপিটাল কোয়ার্টারে উঠলাম.....

সরকারী বাসায় হেঁটে হেঁটে অবস্থা দেখছি, এমন সময় মাথার পেছনে কে যেন চাঁটি মারলো।পেছনে ঘুরে কাউকে না পেয়ে উপরে তাকিয়ে বুঝলাম-ছাদের পলেস্তারা খসে আমার মাথায় পড়েছে...

খাবার পানি আমাদের নিয়মিত কিনেই খেতে হতো, কল ছাড়লে যে পানি আসে, আয়রনের কারণে তা লালচে।যা বেতন পেতাম তার অর্ধেক যেতো বোতলজাত পানি কিনতে, বাকী অর্ধেক যেতো ঢাকা টু গহীন অরণ্যে যাতায়াতে.....

এভাবেই এদেশের অধিকাংশ ডাক্তাররা চিকিৎসা সেবা দিয়ে যান।থাকার ভালো পরিবেশ নেই, কর্মস্থল যে হাসপাতাল-সেখানেও উপযুক্ত পরিবেশ অনুপস্থিত।একদিকে চলে দালালদের দৌরাত্ম্য,অন্যদিকে চলে এলাকার পান্তা নেতার চোখরাঙানি।ফ্রি হিসেবে পাওয়া যায়-কসাই, কমিশনখোর গালি। ঢাকা কিংবা বড় শহরের এসিতে নিজেকে আবদ্ধ রেখে এ দূর্ভোগ কারো বোঝার কথা নয়....

২.....

আচ্ছা, ভালো কথা, এদেশে বেসরকারী চিকিৎসকরা কেমন আছেন? যদি ভেবে থাকেন এরা সবাই সুখে আছেন-তবে আমাকে বলতে হবে-'You are in a fool's paradise '.....

প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এরাও কিন্তু খুব একটা সুখে নেই।ডিটেইল এনালাইসিস দিতে পারি, বাদ দিলাম।বেসরকারী হাসপাতালে ডাক্তারদের কি অবস্থা সেটা বোঝার জন্য একটা ঘটনা বলি,সেটা শুনুন। চাল সিদ্ধ হয়েছে কি হয়নি-তার জন্য প্রত্যেক চালে টিপ দিতে হয় না, একটা চালে টিপ দিলেই চলে .....

প্রাইভেট বিশেষায়িত হাসপাতালে নাইট ডিউটি করছি, রাত ৯ টার মত বাজে। উপর তলায় CCU+ ICU -এর মোট ২৫ টি বেডের দায়িত্বে আমরা দুইজন(!!!) ডাক্তার, বাংলাদেশ বলেই তা সম্ভব।নিচ তলায় কার্ডিওলজীর এক সিনিয়র কনসালটেন্ট রাতের দায়িত্ব পালন করছেন।

হঠাৎ ফোন এলো-হাসপাতালের মালিক( যিনি ব্যবসায়ী) কিছুক্ষণের মাঝেই ভিজিটে আসবে।ত্রাহিত্রাহি অবস্থা...

কার্ডিওলজীর কনসালটেন্ট কিছুক্ষণ পরপর ICU তে ঢুকে বলছেন, "ভয়ের কিছু নাই"--এ কথাটি বলে উনি নিজেই অবশ্য ভীত হয়ে একটু পরপর বোতল থেকে পানি খাচ্ছেন।

নিজের উপর আমার যথেষ্ঠই কনফিডেন্স আছে, হাজারে হাজার মানুষের সাথে কমপিট্ করে এই পেশায় এসেছি, মামুলী ব্যাপার না, কোনো ব্যবসায়ীকে ভয় পাবার লোক আমি না, কোনো চিকিৎসকের সেটা হওয়াও উচিত না, একটা নূন্যতম সেলফ কনফিডেন্ড সব চিকিৎসকের ই থাকা উচিত বলে আমি মনে করি....

আমরা যখন মনে করেছি উনি আর আসবেন না, ঠিক তখনই ব্যবসায়ী মালিক হুট করে আবির্ভূত হলো।অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম- একমাত্র আমি ছাড়া বাকী সবাই( ইনক্লুডিং কার্ডিওলজীর সিনিয়র কনসালটেন্ট) তার কদমবুসী করা শুরু করা করলো, সবার চোখে ছিলো স্পষ্ট ভীতি।কিছু টাকার জন্য একজন সিনিয়র কনসালটেন্টের এহেন বেগতিক অবস্থা সেদিন আমাকে যথেষ্ঠই ব্যথিত করেছিলো...

৩....

সরকারী ও বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা যখন পদাবনত, তখন আশ্চর্যের বিষয়টা হলো-আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অন্য সেক্টরগুলোকে পেছনে ফেলে একমাত্র স্বাস্থ্যখাতের সাফল্যই জ্বলজ্বল করে....

মা ও শিশুমৃত্যুহার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে আমাদের দেশের টিকাদান কর্মসূচীর ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় সাফল্য, সংক্রামক রোগের প্রকোপ হ্রাস--আর কত বলবো?

ক্রেডিট নেয়া লোকের অভাব নেই, কিন্তু এই সাফল্যগুলোর পেছনে আসল কারণ কি জানেন? হেলথ্ সেক্টরে ক্রমাগতভাবে দাবিয়ে রাখা সরকারী ও বেসরকারী চিকিৎসকগুলোর ডেডিকেশন ও মেধাই এই সাফল্যের পিছনে নীরবে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।অথচ অন্য সব সেক্টরের তুলনায় স্বাস্থ্যখাতের এই ডাক্তাররাই সবচেয়ে অবহেলিত।প্রমাণ চান? আসেন, একটা ফ্রেশ প্রমাণ দেই...

আজকে সকালে চেম্বার শেষ করে ফেসবুক স্ক্রল করছিলাম।দেখলাম, আমার এক কলিগ তার স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেছেন যে -বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সরকারী লোকসহ পাতিনেতারা পর্যন্ত সবাই বসার চেয়ার পেলেও আমার কলিগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বসার কোন চেয়ার পাননি। ডাক্তার বলে কথা! এদের আবার চেয়ার দিতে হয় নাকি!( কমেন্টে কলিগের লিঙ্কটা দিয়ে দিলাম).....

সরকারী -বেসরকারী ডাক্তাররা কিভাবে তাদের দিনাতিপাত করেন-তা আমি উপরে ১ ও ২ নাম্বার সেগমেন্টে উল্লেখ করেছি।কলিগের স্ট্যাটাসে ডাক্তারদের এখন যে অবস্থাটা দৃশ্যমান-তাতে তো এখন সম্মানটাও যায় যায়......

৪....

কয়েকদিন আগে বাসায় এক আঙ্কেল এলেন, মিস্টি নিয়ে।উনার ছেলে মেডিকেলে ওয়েটিং লিস্টে, তবে বুয়েটে সিভিল এ চান্স পেয়েছে।আঙ্কেলের ইচ্ছা ছিলো তার ছেলেকে তিনি মেডিকেলে পড়াবেন।বুয়েটে চান্স পাবার জন্য মিস্টি নিয়ে এলেও তাই সঙ্গত কারণেই তার মন খারাপ।

আঙ্কেল ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি-তিনি ও তার ছেলে দু'জনেই কত বড় ফাঁড়া থেকে থেকে বেঁচে গেছেন। অবস্থাটা এরকম যে- আঙ্কেল মন খারাপ করে আমার সামনে বসে রয়েছেন আর আমি তার ছেলের ফাঁড়া কেটে যাওয়া উপলক্ষে হাসিহাসি মুখে একটার পর একটা মিস্টি টপাটপ করে গিলছি....

৫.....

ধরুন, আপনি একটা লোককে অপছন্দ করেন, তাকে ডিপ্ লেভেলে সাইজ করতে চান।একটা টেকনিক বলে দেই....

জাস্ট লোকটাকে সামনে পেলেই মিস্টি মিস্টি কথায় তার কাছে ডাক্তারের প্রশংসা করুন, এমনভাবে করুণ যাতে তার মনে তার ছেলেমেয়েকে ডাক্তার বানানোর স্পৃহা জেগে উঠে। এটা করার পর আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান.....

৬.....

একটা সময় পর্যন্ত আমি আমার জুনিয়রদের চিকিৎসক হবার ব্যাপারে উৎসাহ দিতাম, নোবেল প্রোফেশন বলে কথা। এখন যদি কেউ উপদেশ চাইতে আসে, তবে আমি ডাক্তার হবার ব্যাপারে ডিসকারেজ করি, ডাক্তার হবার ব্যাপারে অফুরাণ প্রাণশক্তি থাকলে ভিন্ন কথা....

১৪ ই ডিসেম্বর এদেশে চিকিৎসক সহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের গুপ্তহত্যার মাধ্যমে মেধাবীদের স্ফূরণকে বন্ধ করা হয়েছিলো। এদেশ এখনো মেধাবীদের বরণ করার জন্য প্রস্তুত নয়, বর্বর পাক সেনারা বিদায় নিয়েছে, তাদের দোসররা এখনো এদেশে থেকে চিকিৎসকদের দাবিয়ে রাখছে....

৭.....

আজ ১৬ ই ডিসেম্বর, বিজয় দিবস।বিজয় অর্জনের পথটা ছিলো যথেষ্ঠই দুর্গম।বিখ্যাত নিউজপেপার London times এর কালোর্ত্তীণ উক্তিটা সব সময় কানে বাজে, " If blood is the price of independence, then Bangladesh has paid the highest price in history.”.....

১৯৭১ এ দেশমাতৃকার জন্মলগ্নে যে রক্তগঙ্গা বয়ে গিয়েছিলো সেখানে কি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চিকিৎসকের রক্তস্রোতও শামিল হয়নি? এদেশে চিকিৎসকদের এ করুণ দশা দেখার জন্যই কি তাঁরা আত্মত্যাগ করেছিলেন? এদেশে অধিকাংশ চিকিৎসকদের হাতে যে অদৃশ্য পরাধীনতার শৃঙ্খল -তাঁদের আত্মা কি তা দেখতে পায়? তাঁরা কি তাতে কষ্ট অনুভব করেন? আপনারা কেউ কি তাঁদের সেই আর্তনাদ শুনতে পান?

_____________________________

ডা. জামান অ্যালেক্স
কথাসাহিত্যিক। লোকসেবী চিকিৎসক।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়