Ameen Qudir

Published:
2018-09-06 18:11:16 BdST

সম্মানিত ইউএইচএফপিও মহোদয়দের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ এবং ১০ পয়েন্ট


লেখকের ছবি


ডা. রাজীব দে সরকার
_____________________________

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য স্তর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুলো। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে এই হাসপাতালগুলো আরোগ্য লাভের এক আস্থার আশ্রয়। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে সেবা নিতে আসা বিপুল এই জনগোষ্ঠী যদি তাদের কাঙ্খিত সেবা পায়, তবে তা সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য বিভাগ এবং একই সাথে সরকার এর সাফল্য হিসেবে গণ্য হয়।

এর বিপরীত চিত্রটিও সত্যি। যে কোন কারনেই হোক না কেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সেবাগ্রহীতারা আশানুরূপ সেবা না পেলে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা যাই থাকুক না কেন, তা সাফল্যের আলো দেখবে না। উপজেলা হাসপাতাল ও এর অধীনস্থ উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক গুলো উপজেলা পর্যায়ে একজন দক্ষ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার অধীনে থাকে।

 

আবার উপজেলার হাসপাতালে একজন ইউএইচএফপিও এর অধীনে যোগদান করা নতুন চিকিৎসক এর প্রতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ফীডব্যাক অনেকাংশেই স্বাস্থ্য প্রশাসন নিয়ে চিকিৎসকের মনে একটি প্রাথমিক ধারণা তৈরী করে দেয়।

 

নতুন চিকিৎসক যদি একজন কর্মীবৎসল, নিয়ামানুবর্তী, দৎ, দক্ষ ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান প্রধানের অধীনে কাজ শুরু করেন তবে তার মধ্যেও একই গুণাবলীর সন্নিবেশ ঘটতে থাকে। আর যদি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষই মেরুদন্ডহীন কিংবা দুর্নীতিপরায়ন হন, তবে ঐ নতুন যোগদান করা কর্মকর্তার কাছ থেকে ভালো সার্ভিস আশা করা বৃথা।

 

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নতুন যোগদান করা/করতে যাওয়া চিকিৎসকদের জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধানগণকে লক্ষ্য করে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। তারই আলোকে আমি কিছু বিষয়ে সম্মানিত ইউএইচএফপিও মহোদয়দের বিশেষ অনুরোধ করতে চাই। আমার অনুরোধের লিস্টে যদি কেউ বিন্দু মাত্র মর্মাহত হন কিংবা আমার লেখাগুলো শিষ্টাচার বহির্ভূত মনে করেন তবে আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

 

১। নতুন চিকিৎসক যিনি গেলেন তিনি সংখ্যায় ১ জন হলেও তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেবার চেষ্টা করুন। একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন, ফুলের মাধ্যমে তাকে সংবর্ধনা দিন, কোন উপহার সামগ্রী দিতে পারলে অনেক ভালো হয়। এই সামান্য উপহার ওই চিকিৎসকের সারা জীবনের জন্য এক পরম পাওয়া হয়ে থাকবে। জেনে রাখুন এই চিকিৎসক যখন উপজেলা থেকে চলে যাবেন, তার বিদায় সংবর্ধনা হবে না, হয় না। আমার জানামতে আমার সমসাময়িক বিসিএস ব্যাচের ও আমার জেলায় কর্মরত কারো আনুষ্ঠানিক বিদায় হয় নি। কর্মচারী পরিষদ থেকে ইউএইচএফপিও মহোদয়দের বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হলেও একজন কর্মকর্তার বিদায় কখনোই হয় না। অবশ্য কর্মচারীদের কেউ চলে গেলে তার কিন্তু ঘটা করেই বিদায় দেওয়া হয়। আপনার সম্প্রদায়ের একজন মানুষের আগমন আপনি থাকতে নিরুৎসব কেন হবে??

 

২। তাকে সকল চিকিৎসক, সেবিকা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন। সবাইকে নির্দেশনা দিন এই নতুন চিকিৎসককে যেন পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়। তাকে যেন সহযোগিতা করা হয়।

 

৩। প্রথম দিন থেকেই তাকে ডিউটিতে ঢুকিয়ে দেবেন না। তাকে প্রিপারেটরী লীভ উপভোগের সুযোগ দিন। তিনি ছুটি শেষে যোগদান করার পরেও তাকে দুই সপ্তাহ শুধু হাসপাতালের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন। এই দুই সপ্তাহ তাকে হাসপাতালকে বুঝে নিতে সময় দিন। অফিসের নিয়ম কানুন নিয়ে তাকে ওরিয়েন্ট করান। প্রথম থেকেই রোগী দেখা, মর্নিং-ইভিনিং-নাইট করানোর কট্টর মানসিকতা থেকে সরে আসুন। নতুন চিকিৎসক চাকরী করতেই এতোদূর এসেছেন, তাকে প্রথম দিন/সপ্তাহ থেকে দায়িত্বের ভারে ক্লান্ত করে দেওয়াটা সমীচীন হবে না।

 

৪। তার বেতন বিল করা তাকে শিখিয়ে দিন। সে যেন নিজের বেতন বিল নিজেই করেন। আপনার ক্যাশিয়ার কিংবা অ্যাকাউন্ট অফিসের বাবুদেরকে যেন একটা পয়সা দিতে না হয়, সে ব্যাপারে জিরো টলারেন্স অবস্থানে থাকুন। আর আপনি যদি মনে করেন, আপনার সাথে যা হয়েছে ওর সাথেও তা হবে, তবে আর এসব বলা অর্থহীন। প্রতি মাসে বেতন বিল বাবদ ১০০, আর নানা কাজে ২০০-৫০০ টাকার সংস্কৃতিতে তাকে ঢুকিয়ে দেবেন না।

 

৫। উপজেলার সকল মিটিং এ নতুন কর্মকর্তাকে নিয়ে যান। উপজেলার সকল কর্মকর্তাদের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিন এবং যে কোন সময় তাদের সহযোগিতার জন্য অনুরোধ জানান। তাকে অফিসার্স ক্লাবে নিয়মিত করুন, প্রয়োজনে আপনিও নিয়মিত হোন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণের সাথেও সুসম্পর্ক তৈরী করে দিন। তাকে প্রশাসনিক কাজগুলো শেখাতে পারেন। কিছুদিনের জন্য তাকে আপনার ডেপুটি-ইউএইচএফপিও মনে করুন। আপনার কাজের ভারও কমবে, নতুন কর্মকর্তারও অনেক কিছু শেখা হবে।

 

৬। তার ডর্মিটরী আপনি নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার করানোর ব্যবস্থা করুন। তাকে দায়িত্ব দেবেন না। তার বাসায় গিয়ে হলেও তার পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যকর থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন। আপনার পরিচ্ছন্নতা কর্মী দিয়ে ডর্মিটরীর আশে পাশের এলাকা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করুন।

 

৭। নিরাপত্তা জন্য আপনার উপজেলার বিশেষ কোন বিষয় জানানোর থাকলে তাকে জানান। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কী করণীয় তা তাকে জানান। আপনি সব সময় তার পাশে থাকবেন - এই আস্থা যেন তার তৈরী হয়।

 

৮। অফিসের কর্মচারীদের নির্দেশ দিন নতুন চিকিৎসকের সকল কাজ যেন দ্রুত সম্পন্ন করা হয়। চিকিৎসক কর্মকর্তাদের যে কোন ব্যক্তিগত দাপ্তরিক কাজ যেন সহজে ও সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয় এজন্য আপনার অফিসকে বিশেষ নির্দেশনা দিন। চিকিৎসকদের দাপ্তরিক কাজে অহেতুক সময়ক্ষেপন সামগ্রিক অর্থে জনস্বার্থের জন্যও ক্ষতিকর।

 

৯। নতুন চিকিৎসকের কক্ষটি আপনি নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার করান। সেখানে নতুন/পরিচ্ছন্ন আসবাব দিন, নতুন পর্দার ব্যবস্থা করুন, লাইট ফ্যান আদৌ চলে কী না খোঁজ নিন। রোগীদের বসার চেয়ার, বিপি মেশিন, স্টেথোর সরবরাহ নিশ্চিত করুন।

 

১০। তার যোগদানের পর থেকে প্রতিদিন তার খোঁজ খবর নিন। তার খাবারের আয়োজনটি তদারকি করতে পারেন। পরিবার ছেলে চাকুরী করতে আসা তরুণ কর্মকর্তাটি যেন নিজেকে কোনভাবেই একা না মনে করে। বিকেল বেলা ডক্টরস রুম (যদি থাকে) বা হাসপাতালে আপনার কক্ষে গল্প/আড্ডায় সময় দিতে পারেন কিছুদিন।

 

আমি বিশ্বাস করি, আপনি যদি একজন দক্ষ ইউএইচএফপিও হন, আপনার অধীনস্ত কর্মকর্তাও আপনার দ্বারা প্রভাবিত হবে এবং আপনি তার কাছ থেকে তার বেস্ট সার্ভিসটা বের করে আনতে পারবেন। সেও হাসপাতালকে দ্রুত আপন করে নিতে পারবে। জনপদের মানুষের প্রতি তথা গোটা রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ববোধ তৈরী হবে।

প্রজাতন্ত্রের একজন সৈনিক হিসেবে রাষ্ট্রকে এই নতুন কর্মকর্তা কতোটুকু সার্ভিস দেবে, তা আপনার আচরণের উপর বহুলাংশে নির্ভর করবে। কারন আপনি তার কষ্টার্জিত সরকারী চাকুরী জীবনের প্রথম বস (নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ), এই সত্য কেউ কোনদিন মুছে ফেলতে পারবে না।

 

নতুন মানুষটির জন্য আপনার অনেক কিছু করার আছে, যদি আপনি সত্যি করতে চান এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে থাকেন।
______________________________

ডা. রাজীব দে সরকার
রেজিস্ট্রার, সার্জারী বিভাগ
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
প্রচার ও জনসংযোগ সম্পাদক, বিএমএ, রাজবাড়ী
আহবায়ক, সুহৃদ সমাবেশ, গোয়ালন্দ।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়