Ameen Qudir

Published:
2018-07-29 16:03:42 BdST

তোমরা যারা এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছো ,তাদের জন্য.. ..


 


ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ
_________________________________

তোমরা যারা এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছো তাদের জন্য-
_________________

মিছেই এই মরীচিকার পিছনে ছুটিও না।
চিকিৎসা পেশা ছাড়াও এদেশে আরও অনেক ভালো ভালো মানসম্মত প্রফেশন আছে।
সময় থাকতে সেদিকেই ঝুকো।

এখনই সময়।
ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ জীবনসমুদ্রের এক তীরে তরী ভিড়িয়েছো কেবল!
গন্তব্যে পৌঁছাতে এখনই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এই মুহুর্তের ভুল সিদ্ধান্তে জীবনটাই তোমার ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে যেতে পারে!!

মনে রেখো, এই মেডিকেল প্রফেশনে গন্তব্যে পৌঁছাতে ন্যূনতম(সৌভাগ্যবশতঃ যদি কোথাও ছেদ না পড়ে) ১১বছর(এমএস/এমডিসহ) সময় তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে!

১১বছর শেষে এসে দেখবে তোমার সাথের বন্ধুরা যারা তোমার মতো এই পথে পা বাড়ায়নি তারা ইতিমধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছিয়ে পরিবার সংসার নিয়ে নিরাপদ জীবন যাপন করছে।

আর তুমি ?
ঘুম খাওয়া জীবন সংসার পরিবার সব ছেড়ে উদয়াস্ত শুধু ছুটছো!
ছুটছো আর ছুটছো!
এই ছুটার যেন শেষ নেই!

হতাশাটা তখনই শুরু হবে যখন দেখবে
এতো ছুটাছুটি শেষেও কোন রেজাল্ট নেই!

না আছে নিরাপত্তা!
না আছে নিশ্চয়তা!
না আছে ভালোবাসা!
না আছে সম্মান!
না আছে সম্মানী!

বটতলার উকিলও(সম্মানীত প্রথিতযশা উকিলদের কথা না হয় বাদই দিলাম) লাখ টাকা সম্মানী নেয়,
কেউ প্রশ্ন তোলে না কিন্তু তোমার পাঁচশত টাকা সম্মানীতেই সবার গাঁয়ে জ্বালা!

মমতাজ একটা স্টেজ পারফর্ম করে ১/২ঘন্টার বিনিময়ে ২/৩লাখ টাকা সম্মানী নেয়!
সেই মমতাজও তোমার পাঁচশত টাকার সম্মানী নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না!

রাষ্ট্রের শিক্ষিত সকল নাগরিকের শিক্ষার পিছনেই জনগণের ট্যাক্সের টাকা ব্যায় হয়।
পার্থক্য হলো আর কাউকে ট্যাক্সের খোটা সইতে হয় না আর তোমাকে উঠতে বসতে সারাটা জীবনই ট্যাক্সের খোটা সইতে হবে!

যে লোক জীবনে কোনদিন একপয়সাও ট্যাক্স দেয়নি, ট্যাক্স অফিসের খিড়কিটাও চেনেনা, সুযোগ পেলে সেও তোমাকে ট্যাক্সের খোটা দিয়ে দু'কথা শুনিয়ে যাবে, দুটো ডলা দিয়ে যাবে!!

অনারারী ট্রেনিঙের নামে একদিনও কোন পারিশ্রমিক না নিয়ে তোমার জীবনের মূল্যবান ৩/৪বছর সময় সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে এদেশের জনগণ ও রাষ্ট্রের পেছনে নিরলসভাবে উদয়াস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তোমাকে ব্যায় করতে হবে যা সারা পৃথিবীতে একেবারেই বিরল!

এই ৩/৪বছর সময়ের বিনিময়ে কোন সম্মানী কখনোই আমরা চাইনি।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস!
সম্মানী তো দূরে থাক ন্যূনতম সম্মানটুকুও আমরা পাইনি!!

একজন মাংস ব্যাবসায়ী কসাই'র যে সম্মান আছে তোমার সে সম্মানটুকুও নেই!
লোকে তোমাকে কসাই বলে ডাকবে ঠিকই তবে বাঁকা চোখেও তাকাবে অথচ দেখো মোড়ের দোকানের কসাইয়ের দিকেও তারা বাঁকা চোখে তাকাই না :'(

এখানে তুমি দিবে শ্রম বিনিময়ে খাবে গালি গরম!
এখানে তুমি দিবে সেবা বিনিময়ে পাবে লাঞ্জনা!

এখানে তুমি পরার্থে নিজ স্বার্থ বিকিয়ে দিবে বিনিময়ে 'লোভী' তকমা পাবে!

এখানে তুমি সীমীতমাত্র রিসোর্স লজিস্টিকস নিয়ে স্ট্যাণ্ডার্ড চিকিৎসা দিবে বিনিময়ে ভুল চিকিৎসার মিথ্যা অপবাদ জুটবে!

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে পুলিশ ছাড়া কেউ যায় না সেখানে তুমি যাবে,
মানুষকে ভালোবেসে আদর করে সেবা দিয়ে কোলে তুলে নিবে আর সেই মানুষগুলোই তোমাকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলবে(কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া)।

পুলিশও অবশ্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যায় কিন্তু তাদের দুর্বৃত্তপনায়ও মানুষ চোখ রাঙানোর সাহস করে না!

বাস্তবতা হলো এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে তুমি অফিস বলতে যা পাবে তা হলো ভাঙাচোরা ও পলেস্তরা খসা চারখানা দেওয়ালের উপর শতবছরের পুরোনো একখানা ছিদ্রওয়ালা ছাদ!
তোমার বসার জন্য পাবে পায়া ভাঙা একখানা পাঁচ দশকের পুরোনো কাঠের কেদারা যেটা পাটের মলিন রশি দিয়ে সামনে ঘুনে ধরা একটা টেবিলের সাথে বাঁধা।

তোমার কাধের উপর ঝুলতে থাকা রুগির চাপেই সেই কেদারা তোমাকে নিয়ে দিনের মধ্যে অন্ততঃ দু'তিনবার মাটিতে গড়াগড়ি খাবে!

একটু বৃষ্টি হলেই ছাদ গলিয়ে অঝোর ধারায় ঝরবে বৃষ্টির পানি, আসলে সেটা বৃষ্টির পানি নয় সেটা তোমার হতাশার কান্না, সেটা তোমার হতাশারই বৃষ্টি!

এতো বঞ্চনা আর রাষ্ট্রীয় অবহেলাকে তুচ্ছজ্ঞান করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের হতভাগা জনগণকে হৃদয়ে ঠাই দিয়ে তুমি সেবা দিয়ে যাবে আর তোমারই সমপর্যায়ের অপরাপর সরকারি অফিসাররা আলিশান অফিসে সরকারি গাড়ি হাকিয়ে পাইক পেয়াদা নিয়ে দাপিয়ে বেড়াবে!

তোমার সমপর্যায়ের হওয়া সত্ত্বেও সুযোগ পেলে তোমারই উপর ছড়ি ঘুরাতেও তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না!
সত্যি বলছি, অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এইদেশে এটা তেমনই একটি অবহেলিত পেশা যেখানে কেউই তোমাকে সমীহ করে কথা বলবে না!!

এমন আরো কতো কতো নির্মম বঞ্চনা ও বাস্তবতার গল্প আছে এই পেশায়!
যদি তুমি এই পেশায় আসো তখনই টের পাবে আমি সত্যি বলছি না-কি মিথ্যা বলছি!
সবাই শুধু উপরের মোড়কটাই দেখে ভিতরের বঞ্চনাটার খোঁজ কেউ রাখে না!

হ্যাঁ এটাই দেশের একমাত্র পেশা যেখানে কর্মস্থলে কর্মরত অবস্থায় তুমি যেকোনরকম অযাচিত নির্যাতনের শিকার হতে পারো এমন কি জীবনলীলাও সাঙ্গ হতে পারে তোমার!!

দেশের এটাই একমাত্র পেশা যেখানে তুমি সবচেয়ে বেশী শ্রমঘন্টা ব্যায় করার পরও সমপর্যায়ের অপরাপর যেকোন পেশার তুলনায় কম নাগরিক সুবিধা পাবে!
ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রও তোমার সাথে বৈরী আচরন করবে!

আদতে এই মহোত্তম পেশাটি এই দেশের জন্য নয়!
এদেশের ১৬কোটি নাগরিকই একেকজন চিকিৎসক!
এখানে চোর ডাকাত থেকে শুরু করে সাংবাদিক সচিব পর্যন্ত সবাই একেকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক!

তারাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা মতামত দিতে পারে!
শুধু তাই নয় তারা চিকিৎসার ভুলও ধরতে পারে!
সুতরাং তোমার চিকিৎসক না হলেও চলবে!

তুমি অন্যকোন পেশা বেছে নাও!
মনে রেখো এদেশে চিকিৎসা পেশা ব্যাতিরেকে আর সব পেশাই সম্মানের, আর সব পেশাই নিরাপদ নিশ্চিয়তার।

তোমার জন্য অগ্রিম শুভ কামনা।
_________

পুনশ্চঃ
তোমাকে ভয় দেখানো বা আতঙ্কিত করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
জীবন থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতা।
মোটামুটি সব চিকিৎসকের জীবনের গল্পটাই এমন!!
আশ্চর্য হলেও এটাই সত্য।
সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তোমার জীবনের সোনালী সময়টা কালোমেঘে ঢেকে যাওয়ার আগেই তোমাকে সতর্ক করতে এই অতীব ক্ষুদ্র প্রয়াস!!
_____________________________

ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ
সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ;স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক;চিকিৎসক পরিষদ, বিএসএমএমইউ।

সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ শাখা ,দিনাজপুর।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়