Ameen Qudir

Published:
2018-07-02 17:08:38 BdST

"কোথায় ডাক্তার? দরকারের সময় শুয়োরের বাচ্চাগুলোকে পাওয়া যায় না, শালা কামচোর!"


 



প্রীতম মন্ডল,ইনটার্ন চিকিৎসক।
___________________________

"কোথায় ডাক্তার? শালা দরকারের সময় শুয়োরের বাচ্চাগুলোকে পাওয়া যায় না। সব শালা কামচোর!" চিৎকার করতে করতে এমার্জেন্সিটে ঢুকলেন এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক। তাগড়াই চেহারা, পরনে জিন্স আর টি শার্ট। সঙ্গে মহিলা পুরুষ মিলিয়ে জনা দশ বারো লোক, তাদের মধ্যে কয়েকজন একটা মেয়েকে কোলে করে ধরে নিয়ে আসছে।

ইন্দ্রপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ছোট বিন্দুর মত হাসপাতাল, আরো ছোট তার পরিকাঠামো। একদিকে আউট ডোর, সেখানে দুটো মাত্র ঘর। অপরদিকে ১০ টা বেড নিয়ে ইনডোর। জানালা ভাঙা, নোংরা পরিস্কার করার মত লোক নেই, দেওয়ালের চুন খসে পড়েছে জায়গায় জায়গায়। আগে এখানে শুধু আউটডোর হত। গত ইলেকশনে জেতার পর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার মুখের বাণী কাজে পরিণত হয়ে এই আধ মরা পোড়ো বাড়িটা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মর্যাদা পেয়েছে। ডাক্তার মাত্র একজন। ডঃ রমেশ রায়। সবে মাত্র এম বি বি এস পাস করে চাকরিতে জয়েন করেছেন কিছুদিন হলো। গত বছর মা মারা যাওয়ার সময় হাসপাতালের বেডে শুয়ে হাত ধরে বলেছিল, " ডাক্তার হয়েছিস, গ্রামে যাস বাবা! ওদের একটু দেখিস।" মায়ের কথা গুলো এখনো চোখ বন্ধ করলে কানে বাজে রমেশের। কলকাতার ঝাঁ চকে চকে জীবন ছেড়ে মায়ের শেষ কথা রাখার জন্য এই এতদূরে গ্রামে আসতে একবারও দ্বিধা বোধ হয়নি তার। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস সময় সাপেক্ষে করুন রূপ নেয়, ইন্দ্রপুরে এসে সেটা খুব ভালো করে বুঝেছে রমেশ।চিকিৎসা করা যায়, চিকিৎসা করতেও চায় রমেশ, কিন্তু শ্মশানে বসে চিকিৎসা হয় না। একটা হাড় জীর্ন বাড়ি, না আছে প্রয়োজনীয় ওষুধ, না আছে যন্ত্রপাতি, না আছে পর্যাপ্ত স্টাফ, আর না আছে দরকারি সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা। ডাক্তারদের জন্য আলাদা কোনো ঘর ও নেই। নাইট ডিউটির সময় আউটডোর রুমেই রাত কাটাতে হয় রমেশকে। রুগী যে ভর্তি হয় না তা একেবারেই নয়, বরং ও এখানে আসার পর হাসপাতালের বেড খালি আছে, এমন সময় খুব কম ই দেখা গেছে। দুজন নার্স আর একজন ডাক্তার নিয়েই লড়ে যাচ্ছে ইন্দ্রপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র।

রাত তখন প্রায় দুটো বাজে। একটা রুগীর অবস্থা হঠাৎ খারাপ হয়ে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি গিয়ে তার জন্য দরকারি যা যা করার করে দিয়ে এসে সবে মাত্র রুগী পরীক্ষা করার খাটে গা এলিয়েছিলো রমেশ। গ্রীষ্মকাল, তারউপর বহু পুরোনো সিলিং ফ্যানটাও গেছে খারাপ হয়ে। ঘামে জামার সাথে সাথে খাটের চাদরটাও ভিজেছে খানিকটা। বাইরের হাঁক ডাক শুনে বিছানা থেকে উঠে দরজা ঠেলে বাইরে আসতেই লোকটাকে দেখতে পেল রমেশ। একজন নার্সের সাথে জোর গলায় কথা বলছেন," ডাকুন ডাক্তারকে, কোথায় সে ? এখানে পেশেন্টের অবস্থা খারাপ আর ও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে? সরকার এই জন্যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেয়?"
নার্স সুষমা ভদ্রলোককে শান্ত হতে বলে বললেন," আপনি একটু শান্ত হন, ডাক্তারবাবু এখুনি আসছেন।"
এতক্ষনে রমেশ চলে এসেছে এমারজেন্সি রুমে। আউটডোর রুমের ঠিক পাশের ঘরটাই এমারজেন্সি। রমেশকে দেখে ভদ্রলোক বললেন," এই যে ডাক্তার, তাড়াতাড়ি দেখ একে"
রমেশ দেখলো একটি বছর পঁচিশের ভদ্রমহিলা এমারজেন্সি বেডে শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে।ভদ্রমহিলার চোখ আধ খোলা, মুখের এক দিক দিয়ে লালা ঝরছে, দু হাত দুদিকে রাখা, পেশেন্ট সেমি কনসাস। ভাইটালস গুলো ঠিক নেই, পালস রেট অনেক কম। রুগীর অবস্থা ভালো নয় একদমই। রমেশ জিজ্ঞেস করলো, " কি হয়েছে এনার? কিকরে হলো এরকম?"
পাস থেকে একজন ভদ্রলোক বললেন," বিষ খেয়েছে।"
রমেশ আবার জিজ্ঞেস করলো," কখন খেয়েছে?"
"কালকের রাত্রে"
"কালকের রাত্রে খেয়েছে আর আপনারা এখন নিয়ে আসছেন? "
একজন ভদ্রলোক সামনের দুজনকে সরিয়ে আরেকটু সামনে এসে বললেন," কখন খেয়েছে তোর জেনে কি হবে শালা! তুই চিকিৎসা শুরু কর!"
রমেশ বলল," দাদা উত্তেজিত হবেন না, কি বিষ খেয়েছে বলতে পারবেন?"
" আরে বোকাচোদা, তোকে বলছি তো বিষ খেয়েছে। কি বিষ খেয়েছে, কখন খেয়েছে, এসব জেনে কি হবে তোর! তুমি ওষুধ দাও না শালা!" গলা চড়িয়ে চিৎকার করে বললেন ভদ্রলোক। ওনার পাস থেকে আরেকজন ভদ্রলোক বললেন," হ্যাঁ বলতে পারবো, এই নিন দেখুন" বলেই নিজের মোবাইল ফোনটা রমেশের সামনে ধরলো। রমেশ দেখলো ম্যালাথিয়ন। যাক, কারুর অন্তত বিষের বোতলের ছবি টা তুলে আনার মত বুদ্ধি আছে এদের মধ্যে। রমেশ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
বিষ খাওয়া রুগীর চিকিৎসা করতে গেলে কি বিষ খেয়েছে এবং কখন খেয়েছে সেটা জানা জরুরি। রমেশ বুঝলো এই ভদ্রমহিলার অবস্থা এমনিতে ভালো নয়। বিষ খাওয়ার পর অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে, এমন অবস্থায় বমি করিয়েও কোনো লাভ নেই, কারণ সমস্ত বিষটাই শরীরে মিশে গিয়ে পাকস্থলীতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। রুগীর ভাইটালস ও ফল করছে। এই পরিস্থিতিতে ভালো ইনটেনসিভ কেয়ার ছাড়া রুগী বাঁচানো অসম্ভব। এবং সেটা এই ইন্দ্রপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তো কল্পনার অতীত। রমেশ তবু আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি অক্সিজেন, ফ্লুইড এবং ওষুধের ব্যবস্থা করলো। রুগীর শারীরিক অবস্থার কথা পেশেন্ট পার্টির জানা দরকার। বিশেষ করে এরকম খারাপ পেশেন্ট এর ক্ষেত্রে তো বটেই। রমেশ বলল, " দেখুন, রুগীর অবস্থা খুব একটা ভালো বুঝছি না। হাসপাতালে আসতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। ওষুধ দিয়েছি, কিন্তু কি হবে আমি এখনই বলতে পারছি না। ওনার আই টি ইউ হলে ভালো হত। আমাদের এখানে আই টি ইউ নেই, আপনারা যদি বড় হাসপাতালে ওনাকে নিয়ে যান তাহলে ভালো হবে।"
"আই টি ইউ নেই মানে?" চিৎকার করে উঠলেন পেশেন্ট পার্টিদের মধ্যে একজন ভদ্রমহিলা," হাসপাতাল খুলেছেন, সরকারি হাসপাতাল এটা। দিদি বলেছে সব চিকিৎসা পাওয়া যায়। আপনি রেফার করে নিজের দায়িত্ব ঝাড়তে চাইছেন। এখানেই ট্রিটমেন্ট হবে আমার রুগীর। রুগীর কিছু হলে আপনাকে ছেড়ে দেব না বলে দিলাম"।
শিক্ষিত সমাজে অশিক্ষিত লোকের অভাব নেই। এরকম খারাপ রুগীকে রমেশ বাঁচাতে পারবে কি না সে জানে না কিন্তু এই ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি সারানো তার পক্ষে অবাস্তব। যতদিন না এই রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে, রমেশের মত হাজার চিকিৎসক বুকে ভয় আর হাতে নিজের প্রান নিয়ে অপমানিত হবে। ডাক্তারিতে অপমান সহ্য করার কোনো ট্যাবলেট থাকলে ভালো হতো।

রুগীর অ্যট্রপিন চলছে। এত রাতে উত্তেজিত পেশেন্ট পার্টির সাথে লড়াই করার ক্ষমতা রমেশের সিলেবাসের বাইরে, তার থেকে রুগীর জন্য মৃত্যুর সাথে লড়াই করা সহজ। কিছুক্ষন পর পেশেন্ট পার্টির মধ্যে একজন এসে বলল," এই শালা ডাক্তার কি ওষুধ দিয়েছিস! আমাদের রুগী এরকম ছট ফট করছে কেন?"
আসলে এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। ডাক্তারি পরিভাষায় এটাকে অ্যট্রপিন সাইকোসিস বলে। রুগী ছট ফট করে, হাত পা ছোঁড়ে, ভুল বকে। এটা ট্রিটমেন্ট পর্যায়েরই একটা ধাপ। এরককম অবস্থায় কিছু সিডেটিভ ড্রাগ দিয়ে রুগীকে ঘুম পাড়ানোটাই নিয়ম। কারণ অ্যট্রপিন বন্ধ করা মানেই বিপদ। করলে যদিও বা বাঁচার চান্স ছিল, সেটাও আর থাকবে না। রমেশ নার্স কে একটা সিডেটিভ দিয়ে দিতে বলল।

সিডেটিভ দেওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই রুগী চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ল। হাত পা নাড়ার সাথে চোখটাও বন্ধ। তখন ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেছে, রমেশ একটু বিশ্রামের জন্য নিজের ঘরে এসে খাটে বসল। গা দিয়ে দর দর করে ঘাম ঝরে পড়ছে। জল তেষ্টা পেয়েছে খুব। পাশের টেবিলে রাখা জলের বোতল থেকে কয়েক ঢোক জল খেয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো রমেশ। জীবন একটা ক্রসওয়ার্ড পাজল এর মত, প্রত্যেকদিন একটা ধাপ পেরোলেই আরেকটা ধাপে পৌঁছনো যায়। পরেরটা আরো কঠিন। রমেশ বেশ বুঝতে পারে, স্টেথোস্কোপের ভার বহন করা অতো সহজ নয়। রীতিমত লড়াই করে হাঁটতে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ হয়ে আসে রমেশের, সাড়ে পাঁচ বছরের জমে থাকা ঘুম চোখে নোঙর ফেলে আসতে আসতে।

হঠাৎ ওর রুমের দরজা সশব্দে খুলে যায়। রমেশ চমকে উঠে দেখলো তিনজন লোক চিৎকার করতে করতে ওর ঘরে ঢুকেছে। একজন ওর জামার কলার ধরে টানতে টানতে বলল," বেরিয়ে আয় শালা! বেরিয়ে আয় ঘর থেকে।"
রমেশ কিছু বোঝার আগেই ওকে ওরা ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এলো। দেওয়ালের সাথে ঠেসে ধরে গালে একটা সজোরে চড় মারলো ওদের মধ্যে একজন। একজন আচমকা পেটে একটা লাঠি। রমেশ ওদের ঠেকানোর চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলো না। চেঁচিয়ে একজন বলল," বোকাচোদা, শালা কি ওষুধ দিয়েছিস আমাদের রুগীকে! এই তো একটু আগে হাত পা নাড়ছিলো, চোখ খুলে তাকাচ্ছিল। এখন চুপ মেরে গেছে কেন?"
"খানকির ছেলে এই ডাক্তারি করছিস! এরা সব শালা টুকে টুকে পাস করেছে। মাস গেলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নেবে আর বসে বসে রুগী মারবে!" পাশ থেকে আরেকজন লোক বলল কথাগুলো।
ভদ্রলোক রমেশের গলা টিপে ধরে আছে, কথা বলতে পারছে না ও। কোনো রকমে নিজেকে ছাড়িয়ে সে বলল," আপনারা ভুল ভাবছেন, ওনাকে শান্ত করার জন্যই ওষুধ দেওয়া হয়েছে।"
"শান্ত করার জন্য ওষুধ! বাঁড়া আমরা কিছু বুঝিনা নাকি! ওর যদি কিছু হয়, শালা তোকে এখানেই কেটে ফেলে রেখে যাবো বলে দিলাম" চোখ রাঙিয়ে কথা গুলো বলে ওরা তিনজন ওয়ার্ডে রুগীর কাছে চলে গেল।
রমেশ হাঁফাতে হাঁফাতে কোনোরোমে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল ভেতর থেকে। মারামারি করার জন্য সে এখানে আসেনি, মার খাওয়ার জন্যেও নয়। এই তথাকথিত মানুষগুলোর সাথে লড়াই করতে ও পারবে না।তাই এই গন্ড গ্রামে হাড় গিলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে নিজেকে বাঁচানোর জন্য পালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। পেট'টা চিন চিন করছে রমেশের। পেটের ডান দিকে হাত রেখে কোনোক্রমে বিছানায় বসল পা ঝুলিয়ে। বুকটা কেমন ভারী হয়ে গেছে। মায়ের উপর খুব রাগ হলো রমেশের। এই জন্য ওর মা ওকে গ্রামে আসতে বলেছিল? মার আর গালাগালি খেতে? সাড়ে পাঁচ বছরের পরিশ্রমের ফল কি পেটে লাথি খাওয়া? নাকি গালে চড় খাওয়া? অপমানিত বুকের পাঁজর চিরে জল নামলো রমেশের চোখে। কেঁদে ফেলল সে। সূর্য উঠে আকাশ পরিষ্কার হলেও, রমেশের কান্না ওই ছোট্ট ঘুপচি আউটডোর রুমের চার দেওয়াল ভেঙে বাইরে আসেনি, আসেনা, আসবেওনা কোনদিন।

এরপর পাঁচ দিন কেটে গেছে। জমে মানুষে টানা টানির পর ভদ্রমহিলা এখন স্টেবল। বলা যায় বিপদমুক্ত। আজই ওকে ছেড়ে দিয়েছে রমেশ। সকাল প্রায় দশটা বেজে গেছে। রমেশ নিজের ঘরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। ভদ্রমহিলাকে ওর বাড়ির লোক নিয়ে চলে যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা নিজে হাঁটতে পারছেন এখন। ওর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একজন লোক ওকে উদেশ্য করে বললেন, " ভগবান ওকে ভালো করে দিলেন। ওর যদি কিছু হতো, তোকে দেখে নিতাম!"

রমেশের এখন আর ভয় করছে না। বুকটা আগের থেকে অনেকটা শক্ত। অপমান গুলো খুব সহজে হজম হয়। ওরা চলে যাওয়ার পর রমেশ নিজের পকেট থেকে ওয়ালেটটা বের করে মায়ের ছোট্ট ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসল একবার। আউটডোরের সামনে রুগীর লম্বা লাইন পড়ে গেছে। আর দেরি করলে চলবে না।
_______________________________

প্রীতম মন্ডল। ইনটার্ন চিকিৎসক। কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, কলকাতা।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়