Ameen Qudir

Published:
2018-06-06 18:08:01 BdST

ডাক্তার ফটিক : "মা,এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি "




ডা. মোঃ বেলায়েত হোসেন
____________________________


ফটিকের ইন্টার্নি চলিতেছে।মাত্রই ডিউটি শেষ করিয়া ক্লান্ত শ্রান্ত ফটিক আনমনে কি জানি কি ভাবিতে ভাবিতে হাসপাতাল হইতে বাহির হইতেসিলো,এমন সময় তাহার সহিত এক অচেনা ব্যক্তির সংঘর্ষ ঘটিলো।ফটিকের দিকে কিঞ্চিত অবাক দৃষ্টিপাত করিয়া নবাগত জিজ্ঞাসা করিলেন,"প্রিন্সিপাল স্যারের রুম কোথায় বলতে পারো?"ফটিক অবজ্ঞার দৃষ্টি হানিয়া অনির্দিষ্ট দিকে আঙুল তুলিয়া বলিল,'ওই দিকে।'স্বভাবতই আগন্তুক বুঝিতে না পারিয়া পুনরায় শুধাইলো,"কোন দিকে?"ফটিক এইবার মোবাইলে ফেসবুক ব্রাউজ করিতে করিতে তাহার দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়াই কহিল,'জানি না।'আগন্তুক কিছু না বলিয়া ফটিকের নাম ফলকের দিকে তাকাইয়া আর কিছু না বলিয়া প্রস্থান করিলো।

পরদিন।ফটিক ইন্টার্ন রুমে বসিয়া কোন ললনাকে পটাইবার নিমিত্তে ম্যাসেঞ্জারে আবেগের পুরোটা ঢালিয়া দিতেছিলো,এমন সময় মাহফুজুর রহমানের গানের ন্যায় প্রিন্সিপাল স্যারের তরফ হইতে দূত আসিয়া শুধাইলো,"প্রিন্সিপাল স্যার ডাঃ ফটিক কে ডাকিতেছেন।"ফটিক প্রায় তাহার মনস্কামনা পূরণ করিয়া ফেলিতেছিলো,এমন সময় এইরূপ উৎপাত কাহারইবা ভাল্লাগিবে।কিন্তু এই অমোঘ ডাক এড়াইবার উপায় ছিলো না,তাই ভগ্ন মনোরথে ফটিক প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের পানে চলিল।

সেইখানে তাহার জন্য এক চমক অপেক্ষা করিতেছিলো,যাহা সে কস্মিনকালেও ভাবে নাই।দেখিলো,যাহাকে সে গতকল্য ধাক্কা দিয়াছিলো,সেই ব্যক্তি প্রিন্সিপাল স্যারের সহিত বসিয়া হাসিতে হাসিতে জলখাবার গ্রহণ করিতেছেন।তাহাকে দেখিয়া প্রিন্সিপাল স্যার আঙুল নির্দিষ্ট করিয়া সেই অপরিচিত কে শুধাইলেন,"এই সেই গুণধর?"
ঘাড় ঘুরাইয়া অচেনা ব্যক্তিত্ব ফটিককে দেখিয়া স্মিত হাসিলেন,তাহাতে প্রিন্সিপাল স্যার যা বুঝিবার বুঝিয়া লইলেন।
ফটিককে ডাকিয়া বলিলেন,"এই ভদ্রলোক গতকাল তোমায় কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলেন ফটিক?"
ফটিক মাথা উপর নিচ করিয়া সত্যতা স্বীকার করিলো।
স্যার কহিলেন,"তুমি জানো উনি কে?উনি তোমাদের মেডিসিনের নতুন প্রফেসর।তোমার সময়ই হইলো না তাকে আমার রুমের রাস্তা দেখানোর?আচ্ছা যাও।"
এই বলিয়া তাহারা এমনভাবে নিজেদের মাঝে গল্পে আবার মশগুল হইয়া গেলেন,যেন ফটিক নামের কাহারো অস্তিত্ব এই বিশ্বসংসারে নাই,কখনো ছিলোও না।

এইরূপ করিয়া ফটিক ইন্টার্নী শেষ করিলো,ব্যাপক পড়ালেখা করিলো এবং ফলস্বরুপ এফ.সি.পি.এস. পার্ট ওয়ান সম্পন্ন করিলো।আহা কি কপাল তাহার,ট্রেনিং করিতে যাইয়া সে নিজেকে সেই পথভোলানো প্রফেসর স্যারের ইউনিটে আবিষ্কার করিলো।তাহার অন্তরে ক্ষীণ আশা ছিলো যে স্যার তাহাকে ভুলিয়া গিয়াছেন,কিন্তু প্রথম দিনেই "আরে আমার হ্যামিলনের বাশিওয়ালা যে,আমাকে পথ ভুলিয়ে কোথায় নিতে চেয়েছিলে সেদিন বলো তো দেখি" বলিয়া সম্বোধন করিয়া তাহার সেই আশার গুড়ে বালি ঢালিয়া দিলেন।ফটিক ভাগ্যবান ছিলো,কারণ স্যার তাহাকে খুব বেশি ঘাটান নাই,ঘাটাইলে তাহার কপালে দুর্গতি অবশ্যম্ভাবী ছিলো।

যাহা হউক,ফটিক মন দিয়া তাহার ট্রেনিং করিতে লাগিলো।শুধু ট্রেনিং করিয়া তো আর দিন গুজার হইবে না,তাই ফটিক বিভিন্ন স্থানে খ্যাপ মারিতে লাগিলো।কিছুদিন ভালো কাটিলেও,টানা ট্রেনিং এবং খ্যাপের চক্করে পড়িয়া তাহার অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হইতে লাগিলো।
ফটিক তখন ভয়াবহ বিষণ্ণতায় ডুবিয়া গেলো।একে যথাসময়ে কোর্স সম্পন্ন করার অদৃশ্য চাপ,অপরদিকে অর্থ উপার্জনের তাড়না।বাড়িতে যেইখানে তাহার আর্থিক সহায়তা করিবার কথা,সেইখানে তাহার নিজেরই দিনাতিপাত করা মুশকিল হইয়া পড়িতেছে।প্রেম ও প্রেমিকা-উভয়ই যে কখন কোথায় হারাইয়া গিয়াছে,বোধকরি ফটিক নিজেও তাহা বলিতে পারে না।

বিশেষত,সিম্পল এমবিবিএসের মতো বালাই আর নাই।তাহার দিকে প্রফেসর উপেক্ষার দৃষ্টিপাত করেন,আর রোগী তো তাহাকে ডাক্তারের পর্যায়েই ফেলিতে চায় না।ফলাফল তাহার না হয় চেম্বারে পসার,না হয় সময়মত পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল লাভ।এহেন টানাপোড়নের মাঝখানে পড়িয়া ফটিক একেবারে দিশেহারা হইয়া পড়িলো।

এইরূপ অবস্থায় একদিন ফটিককে আজিজের এক অন্ধকার কক্ষে প্রবল জ্বরাক্রান্ত অবস্থায় আবিষ্কার করা হইলো।সে জ্বরের ঘোরে কেবলি প্রলাপ বলিতেছিলো,
"একটা খ্যাপও মেলে না
এইবারও পাশ হইলো না"

পাশের কক্ষের ছেলেপুলে মিলে তাহাকে এহেন অবস্থায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করাইয়া দিলো।তাহার উথাল পাথাল জ্বর আরো অবাধ্য হইলো।বোধকরি শরীরের উপর অবিরাম অত্যাচারের কারণে শরীরও বিদ্রোহী হইয়া উঠিয়াছিলো।স্যাররা নানা প্রকার পরীক্ষা করাইলেন,ঔষধ পরিবর্তন করিলেন,কিন্তু তাহার জ্বর কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে তো আসিলোই না,উপরন্তু আর নানাবিধ উপসর্গ আসিয়া যোগ হইলো।ইহার মাঝেই কিছু সময়ের জন্য ফটিক সম্পূর্ণ সচেতন হইয়া উঠে,তাৎক্ষণিক ধড়মড় করিয়া বিছানায় উঠিয়া বসে।এদিক ওদিক চাহিয়া কাহাকে যেন খুঁজিতে থাকে,না পাইয়া আবার বিছানায় শয্যা গ্রহণ করে।
এমনই একদিন,স্যার রাউন্ডে আসিয়াছেন,ফটিক শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলো,"স্যার আমার কি হয়েছে?আমার ছুটি হবে কবে?আমি বাড়ি যাব।কতদিন হয় মা কে দেখি না।"
স্যার স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে তাকাইয়া বলিলেন,
'এই তো,তোমার জ্বরটা কমুক।আমরা তোমাকে ছেড়ে দেবো।আর বেশিদিন না,ধরো আর সপ্তাহ খানেক।'
ফটিক কি বুঝিলো কে জানে,খানিক মাথা নাড়াইয়া আবার পাশ ফিরিয়া শুইয়া পড়িলো।আহা বেচারা,অসুস্থ হয়ে একেবারে নিজের ডাক্তার পরিচয় পর্যন্ত ভুলিতে বসিয়াছে।একেবারে শিশুর মতো আচরণ করিয়া উঠে মাঝেমধ্যে।

দিন যায়।ক্রমেই ফটিকের অবস্থা আরো অবনতির দিকে যাইতে থাকে।ইতোমধ্যে ফটিকের মাতাকে ঢাকায় খবর পাঠাইয়া আনানো হইয়াছে।মাতা আসিয়া উচ্চস্বর বিলাপ করিতে লাগিলেন,উপস্থিত চিকিৎসক বহুকষ্টে তাহার শোকোচ্ছ্বাস নিবৃত্ত করিলে,তিনি হাসপাতালের শয্যার উপর আছাড় খাইয়া পড়িয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিলেন, "ফটিক! সোনা! মানিক আমার!"
ফটিক যেন অতি সহজেই তাহার উত্তর দিয়া কহিল, "অ্যাঁ"।
মা আবার ডাকিলেন, "ওরে ফটিক, বাপধন রে!"
ফটিক আস্তে আস্তে পাশ ফিরিয়া কাহাকেও লক্ষ্য না করিয়া মৃদুস্বরে কহিল, "মা,এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।"

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "ছুটি" গল্প অবলম্বনে)

____________________________

ডা. মোঃ বেলায়েত হোসেন
শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ
০২ ব্যাচ।

 

 

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়