Ameen Qudir
Published:2018-02-03 19:28:19 BdST
রোগীকথনকোন ডাক্তর দিসে? ফারমেসিতে ওসুদ বেছে যে ডাক্তর হেয় দিসে
ডা. ছাবিকুন নাহার______________
বছর সাতেক আগের কথা। মিটফোর্ড হাসপাতালে ট্রেইনি হিসাবে কাজ করি। নাইট ডিউটি করছি। রাত তখন তিনটা কি চারটা। উথাল পাতাল পেট ব্যাথা নিয়ে এক রোগী এলো। বয়স কতইবা? বড় জোড় বাইশ তেইশ। হিস্ট্রি নিয়ে জানা গেলো আড়াই কি তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। বাচ্চা নষ্ট করার জন্য ঔষধ খেয়েছে। তারপর থেকেই ব্যাথা।
সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলিতে এডমিশান নাইট কী জিনিস তা কেবল সংশ্লিষ্টরাই জানে। ইমার্জেন্সি অপারেশন ও অন্যান্য ক্রিটিক্যাল কেসগুলো ম্যানেজ করে একদল কমরেডস মাত্রই রেস্ট রুমে গেছে। আরেকদল জেগে আছি অতন্দ্র প্রহরী হয়ে। তার মধেই তার আগমন। রাতের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে ভেঙ্গে যেতে লাগল রোগীর চিৎকার এবং আমাদের হুড়োহুড়িতে।
- কি ঔষধ খেয়েছেন?
- কইতে ফারিনা।
- কে দিল ঔষধ?
- ডাক্তর দিছে।
- কোন ডাক্তর দিসে?
- ফারমেসিতে ওসুদ বেছে যে ডাক্তর হেয় দিসে।
আরেকজন বল্ল, 'আরে হেয় ডাক্তর না। আগে মাছ বেছত। ফরে ওসুদের দোহানে কাম লইসে। মালিকরে আগায় পিছায় দেয়। মাঝে মাঝে দোহানের মালিক না থাকলে হেয় নিজেও ওসুদ বির্কি (বিক্রি) করে।'
কী আর করা! যে দেশে ফার্মেসিম্যানের হেল্পিং হ্যান্ড ডাক্তার সেখানে এরকম রোগী আসবেই। রাত দুটা তিনটা ব্যাপার না।
ভাবলাম, এবরশিফিসেন্ট ঔষধ খেয়েছে, হয়তো এবরশন প্রসেস শুরু হয়েছে, তাই ব্যাথা। ইন্টারনাল এক্সামিনেশন করে দেখা গেল জরায়ুর মুখ শক্ত করে বন্ধ। কপালে ভাঁজ পরল, এত্ত ব্যাথা কেনো? মিলছে নাতো! পালস একটু বেশি কিন্তু ব্লাডপ্রেশার তো ঠিকই আছে। পেইন কিলার ও অন্যান্য ঔষধ দিলাম। সূক্ষ্ম একটা চিন্তার রেখা তখনো কপালে লেগেই রইল।সকাল তো হয়েই এলো। মর্নিং সেশন শুরু হবে একটু পর। সেখানে সারাদিন রাতের এডমিটেড রোগী সম্বন্ধে পুংখানুপুংখ জানানো হবে। তারপরই তো রাউন্ড শুরু হবে। তখন দেখি ম্যাডাম কী বলেন।
প্রফেসর ম্যাডাম রোগীর পেটে হাত দিয়েই বল্লেন, এখনি ওটিতে ঢুকাও। খুব সম্ভবত রাপচার্ড ইউটেরাস। ইতোমধ্যে পেট ফুলে গেছে। পালস একশর উপরে, ব্লাড প্রেশার লো। রোগী ক্ষনে ক্ষনে বমি করার চেষ্টা করছে। মুখ রক্তশূন্য, সাদাটে।
দশ মিনিটের মধ্য অপারেশন শুরু হলো। পেট খুলে তো অবাক! লিটার খানেক রক্ত ঝপাৎ করে ছড়িয়ে পরল মেঝেতে। বড় বড় রক্তের চাকা সরিয়ে দেখাগেলো একটা বাচ্চা রক্তে মাখামাখি, চার মাসের মতো হবে। অথচ রোগী বলছিল, দুই আড়াই মাস! জরায়ু ফেঁটে চৌচির! ফাঁটা জরায়ুর ফাঁক গলে বাচ্চা টুক করে বেরিয়ে গেছে। অভিমান করে। অভিমান তার হতেই পারে। কী বলেন পাঠক?
বাচ্চা তো আর নিজ ইচ্ছায় আসে না। কত পদ্ধতিই তো আছে বাচ্চা না নেয়ার। আচ্ছা মানলাম অনিচ্ছায় এসে গেছে, তো নিরাপদ অনেক উপায় তো আছেই বাচ্চা নষ্ট করার। ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া যেতো। কোন পদ্ধতি নিবেন না... বাচ্চাকাচ্চা আসবে...ফার্মেসিম্যান ঔষধ দিবে...টুক করে গিলে ফেলবেন... ঝামেলা শেষ। না এতটা সহজ ভাবার কারণ নেই। উপরোক্ত রোগী হয়তো তাই ভেবেছিলো। তারপর তো রানী কুঠির বাকী ইতিহাস...
তাই বলি কি, সমস্যা তো হতেই পারে। আমরা তো মানুষ, রোবট তো না। প্রতিটা সমস্যারই সমাধান আছে। যার যা কাজ তার কাছে যান। সঠিক এবং বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেন। জীবন তো একটাই। এই একটা জীবনকে এত হেলাফেলা করা কি উচিৎ?
যদি ডাক্তারের কাছে যেতেন, ডাক্তার নিশ্চয় বলতেন, চারমাসের বাচ্চা কোন কারণ ছাড়া নষ্ট করা যাবে না। আর নষ্ট করার যদি কারণও থাকে তবে ঔষধ খেয়ে নষ্ট করা যাবে না। এতে জরায়ু ফেঁটে যাওয়ার চান্স থাকবে। আর যার আগের বাচ্চা সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে হয়েছে তারতো ঔষধ খেয়ে বাচ্চা নষ্ট করা আর আজরাইল কে দাওয়াত দিয়ে বাসায় নিয়ে আসা সমান কথা।
আপনি কাউকে আপ্যায়ন করবেন আর সে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে তা তো হয় না। সে প্রতিদান হিসাবে আপনাকে আকাশের তারা বানিয়ে দিতে পারে। সেখানে বসে আপনি দেখলেন আপনিহীনা আপনার সাজানো গোছানো পরিকল্পিত সংসার। লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে আপনার বেডরুমে অন্যকেউ। সবাই হাসিখুশি। জামাই তো আরো বেশি খুশি! এত্ত খুশির মাঝেও আপনার রেখে আসা সন্তানের চোখে বানভাসি জলের বন্যা, যে বন্যার শুরু আছে শেষ নেই।
_________________________
ডা. ছাবিকুন নাহার,
মেডিকেল অফিসার,
ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
আপনার মতামত দিন: