Ameen Qudir

Published:
2017-06-12 17:19:41 BdST

ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম : চিকিৎসকদের প্রথম ও অনন্য ট্রেড ইউনিয়ন


 

 

 

ডা. রেজাউল করীম
__________________________

সাথী,
গত তিনমাসে অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী ও বন্ধু নানারকম উপদেশ ও পরামর্শ দিয়েছেন। অনেক নিন্দামন্দ, কথ্য-সন্ত্রাস ও নিরপেক্ষ সমালোচনাও শোনা গেছে।

চিকিৎসকদের এই সংগঠন তৈরী হয়েছিল রোমান্টিসিজম থেকে-শোষন-নীপিডনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম রোমান্টিসিজম উদ্বুদ্ধ করে। রোমান্টিক মন "আইডিয়া" তৈরী করে, কিন্তু বাস্তবের কঠিন ভূমিতে পদার্পন করে টিকে থাকতে হলে "আইডিয়ার" অন্তর্নিহিত নীতিকে সুস্পষ্ট করতে হবে।

 

আজ যারা নানা কঠিন সমালোচনায় বিদ্ধ করছেন, তাদের সমালোচনা দুরকম- কিছু অসহিষ্ণু ও অসংলগ্ন ব্যক্তিগত উপলব্ধিকেই সমষ্টির নীতি বলে চালানোর যারা চেষ্টা করছেন তাদের অভিপ্রায় নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশ থাকে না। এই অন্তহীন গ্লানিময় নরকযাত্রার সঙ্গী হওয়ার কোন বাসনা আমার নেই। কিন্তু বেশ কিছু আলোচনা-সমালোচনা, তীর্যক মন্তব্য ও পরামর্শ চেনা তিক্ত পথ পরিহার করে একটি আদর্শের কিছু অস্পষ্টতার প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছে। এইসব আলোচনা অতি অবশ্যই যথাযথ মনোযোগ দাবী করে। এক্ষেত্রে যেমন সাফাই দেওয়ার প্রয়োজন আছে, তেমনি কোন কোন সমালোচনা নতমস্তকে গ্রহন করাও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ।

 

মূল প্রশ্নের মূল্যায়ন ও নীতিগত অবস্থান নেওয়ার আগে নীতি ও যুক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারন করা প্রয়োজন । ক্ষুরধার ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি নীতি নির্ধারন করবে , না নীতির সপক্ষে যুক্তি খাড়া করা হবে সেটা প্রথমে ঠিক করতে হবে। এই আ্যরিস্টটলীয়ান তত্ত্বকে আর একটু পরিষ্কার করার জন্য একটি উদাহারন দেওয়া যেতে পারে। "আর্য জাতি ইহুদিদের থেকে উত্তম, মুসলমান হিন্দুর চেয়ে উত্তম, হিন্দু সবার চেয়ে উত্তম" এগুলি হল কোন কোন ব্যক্তিবিশেষ বা দলের নীতি। এই নীতি উদ্ভুত হয়েছে সংস্কার ও বিশ্বাস হিসেবে। এখানে নীতি স্বয়ং যুক্তির আধার, অন্যকোন যুক্তিজাল দিয়েও এই আদর্শগত অবস্থান খণ্ডন করা যাবে না। কিন্তু আ্যরিস্টটল যে তিনটি বিশেষ নীতিগত কল্যানের কথা বলেছেন, তন্মধ্যে এটি নিকৃষ্টতম। কারন, এই নীতিতে প্রথমেই কিছু গোষ্ঠীকে মূল লক্ষ্যের অংশীদার করা যাচ্ছে না। চিকিৎসক সংগঠনের ঘোষিত লক্ষ্য যদি হয় সমষ্টির কল্যান- তাহলে সেটা যুক্তি, সেই যুক্তির নিরিখে নীতির প্রতিমা নির্মান করতে হবে। সমষ্টির কল্যানে চিকিৎসক যদি নীতিগত অবস্থান গ্রহন করে তাহলে নীতি ও যুক্তির সুক্ষ্ম ব্যবধান আর তেমন পীড়াদায়ক হয় না- নীতি স্বয়ং যুক্তির দায়িত্ব পালন করে।

 

খুব স্বাভাবিক কারনেই মূল লক্ষ্য হিসেবে সার্বজনীন কল্যানের কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নানা সময়ে ব্যক্ত করা হয়েছে। সবার জন্য অভিন্ন, সমমানের, সুষম ও পরিকল্পিত স্বাস্থ্যবিধান কর্মসূচি সেই আদর্শের ফলশ্রুতি। একটি সাংগঠনের এই বৃহত্তর লক্ষ্যের অন্যতম প্রধান উৎসাহ হল- উপভোক্তা ও সেবাদানকারীর যে পারস্পরিক সম্পর্ক অনন্তকালের পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে একটি চিরায়ত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছিল, তা পূনরুদ্ধার করা। কেন তা বিষাক্ত হয়েছে, নীতিহীন স্বার্থপরতা কতটা উন্মার্গগামী হলে প্রতিষ্ঠান গৌন হয়ে যায়, ব্যক্তিগত কল্যান সমষ্টির কল্যানে তার দীর্ঘ্য ছায়া ফেলে, অবশেষে রাক্ষুসে রূপ ধরে সমষ্টির মর্যাদা গিলে খায় তা আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। ব্যক্তিগত চারিত্রিক স্খলন অনাবশ্যক ও অন্যায্যভাবে শুধু চিকিৎসকদের অবমূল্যায়ন করেছে তাই নয়, এই অধ:পতন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবক্ষয়ের বহিপ্রকাশ। আমাদের বহুতল বাড়ীর অজস্র ছোট ছোট পায়রার খোপের মত ক্ষুদ্র বাসস্থান আমাদের দৃষ্টিশক্তিকেও ব্যক্তিগত চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে- উন্মুক্ত আকাশ এখনো তার ঐশ্বরিক সৌন্দর্য নিয়ে ক্লান্তিহীন অপেক্ষার রয়েছে, কিন্তু আমাদের দৃষ্টি ক্ষীনকায়, অনুদার মন সে সৌন্দর্য উপভোগে অক্ষম। ব্যক্তির কল্যান তাই সমষ্টির কল্যানকে সহজেই পরাস্ত করেছে।

 

মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে বৃহতের জন্য ক্ষুদ্রকে বিসর্জন দেওয়ার আহ্বান অতিতাত্ত্বিকতায় আক্রান্ত বলে ভ্রম হবার আশঙ্কা রয়েছে-কিন্তু ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টি উত্তম, এই বিতর্কহীন সামাজিক অবস্থান নেওয়ার তাগিদ থেকে "চিকিৎসক সমাজ" নামক ছদ্ম সম্প্রদায়ের আবির্ভাব- যতক্ষন মূল আদর্শের সাথে তার বিরোধ থাকবে না, সাংগঠনিকভাবে তার অস্তিত্ব শুধু জিইয়ে রাখলে হবে না, তাকে শক্তিশালী করার প্রয়োজন আছে। কারন, এই মূল নীতি ব্যক্তির দ্বারা সাফল্যমণ্ডিত করা সম্ভব নয়, সমষ্টিগত ঐক্য সেখানে স্বাভাবিক। যারা ভ্রুকুন্চিত করে সংগঠনের প্রয়োজনকেই অস্বীকার করতে চাইছেন তারা আমাদের সাথে একমত না হতেও পারেন, কিন্তু আমরা নীতিগত অবস্থানের বদলে যৌক্তিক অবস্থানের পক্ষে বাজী রাখতে চাই। আমাদের যুক্তি আমাদের নীতির নির্ধারক ও চালিকাশক্তি।

 

সেই একই নৈতিক ও বৌদ্ধিক অবস্থান থেকে সংগঠনের একটি গনতান্ত্রিক রূপ নির্মান করতে চাই। সেই নির্মিতি অবশ্যই জাতীয় আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। স্বচ্ছ গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি নির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আছে- যেখানে সঙ্ঘের সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতিফলন সম্ভব- ট্রাস্টের সীমাবদ্ধতায় সেই গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ট্রাস্ট থেকে সোসাইটিতে উত্তরন তাই একরকম অনিবার্য। সোসাইটির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁডিয়েছিল "নাম"- বর্তমান সংগঠনের যে নাম পরিচিতি অর্জন করেছে রাতারাতি তাকে বিসর্জন দেওয়া সম্ভব ছিল না, আইন-আদালতের দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ার জন্য যা অতি প্রয়োজনীয় ছিল।
সাংগঠনিক গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পরিকল্পনা হিসেবে তাই আসন্ন সাধারন সভা ট্রাস্টের সভা বললে তা সত্যের অপলাপ হবে।

 

এই সাধারন সভা ট্রাস্ট থেকে সোসাইটিতে উত্তরণের প্রাথমিক পদক্ষেপ। আইনী প্রক্রিয়ার সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষে ট্রাস্ট কিভাবে পরিচালিত হবে ইত্যাদি বিষয়গুলি আইনজ্ঞ ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা যথাযথ সময়ে স্থির করবেন। আর পাঁচটি সংগঠনের মত একটি ত্রিস্তর সাংগঠনিক পরিকাঠামো আমরা নির্মান করতে চাই- সাধারন সভায় যা বিতর্কসাপেক্ষে গ্রহন ও বর্জনের অবকাশ আছে। কিন্তু ব্যক্তি যেন সমষ্টির চেয়ে বৃহৎ না হয়ে ওঠে তার সব রক্ষাকবচ যথাযথ গুরুত্বের সাথে সাংবিধানিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে সে অঙ্গীকার করে রাখতে চাই। সোসাইটির আইনী প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ কিন্তু তা সাধারন সভার আগে সম্পূর্ণ করার ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ আশাবাদী।

এই সংগঠনের পোষাক একটু পরিবর্তন হওয়া বিচিত্র নয় কিন্তু তার মালমশলা অপরিবর্তনীয়- দেশের ইতিহাসে এটি চিকিৎসকদের প্রথম ও অনন্য ট্রেড ইউনিয়ান হবে সে বিষয়ে কোন মতদ্ধৈততা নেই।
আইনী লড়াই যে সংগঠনের জন্ম দিয়েছে, তাকে শক্তিশালী ও দায়বদ্ধ সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সবার শুভেচ্ছা প্রার্থনা করি। সবাই আমাদের সাথে হাত মিলিয়ে চিকিৎসক আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করতে আসুন, এই বিনীত আমার আন্তরিক বিনীত নিবেদন।
সাম্মানিক সভাপতি
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম

____________________________

ডা. রেজাউল করীম । পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত চিকিৎসক । মানবসেবী। কবি ও কল্যাণ কলামিস্ট।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়