Ameen Qudir

Published:
2017-05-25 17:32:31 BdST

অক্সফোর্ড,দুই টাকার ছাগল, মহাজ্ঞানী সাংবাদিক, .মুর্খশিরোমনি, কঠোর আইন ও একটি নির্মোহ পর্যবেক্ষণ


 

 

 

ডা. জামান অ্যালেক্স
_______________________________

 

৬ ই মে, ২০১৫, স্থান-সেন্ট্রাল হাসপাতাল।এক ভদ্রমহিলাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হল।প্রয়োজনীয় মেজর একটি অপারেশন সম্পন্ন হল।পরদিন সকালে উনাকে পোস্ট-অপারেটিভ ওয়ার্ড থেকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়।ঘন্টাখানেক পর তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, সমস্ত ব্যবস্থা নেয়ার পরও মিনিট দশেকের মাঝেই উনি মারা যান।মাইন্ড ইট, ৬ তারিখে হেঁটে হেঁটে যে ভদ্রমহিলা এলেন, ৭ তারিখে উনি মারা গেলেন...

এই যে রোগীটি মারা গেলেন, সেজন্য কিন্তু সেন্ট্রাল হাসপাতালে কোনো ভাংচুর হয়নি, কোনো চিকিৎসককে পেটানো হয়নি, ভুল চিকিৎসার অভিযোগে কোনো মামলা হয়নি....

ঐ ভদ্রমহিলার ছেলে ছিলেন চিকিৎসক, আমার কলিগ।উনি জানতেন অপারেশনটির পর কারো কারো ক্ষেত্রে এরকম শ্বাসকষ্ট(Massive Pulmonary Embolism) হতে পারে, অনেকে মারাও যেতে পারেন.....

ঘটনাটি দু'বছর আগের। আমার সেই কলিগ এখন কিছুদিন পর পর ফেসবুকে তার মায়ের সাথে তোলা ছবি শেয়ার করে, হয়ত তার কল্পনার রাজ্যে তার মা এখনও বেঁচে আছে....

#এবং_প্রাচ্যের_অক্সফোর্ডঃ...

এবার বলুনতো, একই ঘটনা যদি ঢাকা ইউনিভার্সিটির কোনো ছাত্রের মায়ের ক্ষেত্রে ঘটত, তবে তার কনসিকোয়েন্স কি হতো?

উত্তরটা অজানা নয়, কয়দিন আগেই আমরা তার নমুনা দেখেছি।হাসপাতাল ভাংচুর হয়েছে, ৭০-৮০ জন ছাত্র
নামের কিছু কলঙ্কিত সন্ত্রাসী একত্রিত হয়ে চিকিৎসককে পিটিয়েছে, অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়া হয়েছে, "ডেঙ্গুর রোগীকে ক্যন্সারের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে"-এই মিথ্যা ধোঁয়া তুলে বরেণ্য চিকিৎসককে অযথা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে...

ঢাকা ইউনিভার্সিটিকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয়।এই কি তার নমুনা! যারা এই কাজগুলো করলো তারা কি একবারও চিন্তা করেছিলো যে তারা প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের প্রতিনিধিত্ব করছে?তাত্ত্বিকভাবে যদি ধরেও নেই চিকিৎসায় ভুল হয়েছে, তবুও কি কোনো যুক্তিতে চিকিৎসক পেটানো বা ভাংচুর করা সমর্থনযোগ্য?

যারা এই কাজটি করল তাদের জন্য ডেল কার্নেগীর একটা কথা মনে পড়ছে-"ভদ্র আচরণ করতে শিক্ষা লাগে, অভদ্র আচরণ করতে অজ্ঞতাই যথেষ্ট..."

#দুই_টাকার_ছাগলঃ....

গ্রাম এলাকায় একটা কথা প্রচলিতঃ"লাখ টাকার ফসল খায় দুই টাকার ছাগলে"...

দিনের পর পর কিছু ছাগল এসে সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল ভাঙচুর করে,তাদের দেখে আমার সর্বদা এ বাক্যটিই মাথায় আসে।এ পর্যন্ত ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি এভাবে হয়েছে( সূত্রঃ মঙ্গলবার, ২৩ মে,২০১৭, দৈনিক ইত্তেফাক) ....

চিকিৎসায় অসন্তুষ্টি থাকতে পারে, তার জন্য আইনগত ব্যবস্থা থাকার পরও যারা এসব ভাংচুর করে ভিডিও ফুটেজ ধরে ধরে এদের আইনে সোপর্দ করা উচিত।কাউন্টার অ্যাটাকে যেতে হবে, বাঙালি শক্তের ভক্ত, নরমের যম। মনে রাখতে হবে--"ভ্রষ্ট বাঙালিকে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ উপায় তার গালে শক্ত ক'রে একটি চড় কষিয়ে দেয়া....."

#মহাজ্ঞানী_সাংবাদিকঃ....

রোগী মারা গেল, কিছু মূর্খ হাসপাতাল ভাংচুর করল, আরেক মূর্খের দল পত্রিকায় লিখলো, 'ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু...'

যে প্রশ্নটা করতে চাচ্ছি তা হল- রোগীর সেই ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে ঐ মহাজ্ঞানী সাংবাদিকরা কোথায় ছিলেন? আমরা চিকিৎসকরা না হয় ভুল করি, যারা ভুল চিকিৎসার খবর ছাপালেন, তারা যদি আমাদের একটু শুধরে দিতেন, তবে কৃতার্থ হতাম, একটি প্রাণ বেঁচে যেতো...

আমি জানি অনেক সাংবাদিক যথেষ্ট রেসপন্সিবল, কিন্তু গুটিকয় যে সাংবাদিক দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে "ভুল চিকিৎসা"র নিয়মিত গীত গান তারা কি একবারও চিন্তা করেন যে তারা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কি ক্ষতিটা করছেন?

Mark Twain বলেছিলেন— "If you don't read the newspaper, you're uninformed. If you read the newspaper, you're mis-informed...
"....

মার্ক টোয়েন খামখেয়ালী টাইপ লোক ছিলেন।যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে কি আমি এখন ধরেই নিব যে মার্ক টোয়েন যথার্থ কথাই বলেছিলেন?

#মূর্খশিরোমণি!!!..

টকশো আমি সাধারণত দেখি না।কেনো দেখি না সে প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদের উক্তিটি দেইঃ "বাঙলাদেশের প্রধান মূর্খদের চেনার সহজ উপায় টেলিভিশনে কোনো আলোচনা অনুষ্ঠান দেখা।ওই মুখমন্ডলিতে উপস্থাপকটি হচ্ছেন মূর্খশিরোমণি...."

আমি এখন বুঝি হুমায়ুন আজাদ কেনো একথা বলেছিলেন।বারবার উপস্থাপিকা লাইভে সংযুক্ত অধ্যাপক ডাঃআবদুল্লাহ স্যারকে "ডাঃ আবদুল্লাহ" নামেই ডেকে গেলো।কিভাবে একজন মানী লোককে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয় তা কি উপস্থাপিকার অজানা? মানী লোককে সম্মান দিতে আমাদের এত অনীহা কেনো? মানুষকে অভদ্রতার শিক্ষা দেয়াই কি এখন চ্যানেলগুলোর মূল কাজ?

নাম ধরে ডাকাই এই চ্যানেলগুলোর প্রোটোকল, এ ধরনের ভ্রান্ত যুক্তি দয়া করে দেবেন না।যদি তাই দেন, তবে চ্যানেলগুলোর প্রোটকল ঠিক করুন।গুণী লোকের কদর দিতেই হবে, সে যেই হন না কেনো...

#কঠোর_আইনঃ

The Times of India তে একবার একটি খবর চোখে পড়ল--"In Gujarat, 3 yr jail for slapping a doc..."

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে চিকিৎসকদের উপর হাত তোলার সাজা ছিল ৭ বছরের জেল।যদি আমার ভুল না হয়, তবে ২০১৪ সালে সাজা দ্বিগুণ করা হয়েছে...

অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথাটি আমার এখনও মনে আছে, "If you think to assault a nurse, doctor or ambulance officer,we'll give you upto 14 years to think again.... "

বছরের পর বছর আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত চিকিৎসক প্রহৃত হয়।শুধুমাত্র গত ছয় মাসেই অর্ধশতাধিক চিকিৎসক ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে(সূত্রঃ ২৩ মে, ২০১৭, দৈনিক ইত্তেফাক)। গুজরাটের মত এরকম একটি শাস্তিও কি আমাদের দেশে দেয়া হয়েছে? কুইন্সল্যান্ডের কাছাকাছি কোনো আইনও কি আমাদের নীতিনির্ধারকরা তৈরি করতে পেরেছেন?কেন পারেন নি? সমস্যাটা কোথায়?

"Sometimes it's very hard to move on, but once you move on, you will realise it was the best decision you have ever made...."

নীতিনির্ধারকদের অনুরোধ করি, এবার একটি কঠোর আইন তৈরিতে মুভ করুন।এমনভাবে আইন করুন যাতে চিকিৎসকদের উপর যেসব বর্বররা আক্রমণ করে তারা যাতে জামিনটাও না পায়.....

#ইমার্জেন্সী_রেসপন্স_টিমঃ

চিকিৎসা সেবায় কেউ নিজেকে প্রতারিত মনে করলে BMDC তার সমাধান দেয়।ভালো কথা।তবে একটা ব্যাপার জানার ছিলো--BMDC এর রেজিস্টার্ড ডাক্তাররা যখন প্রহৃত হন বা বিপদে পড়েন তখন তাদের সাহায্যার্থে এই প্রতিষ্ঠান কোনো চিকিৎসককে কখনও কি আইনী সহায়তা দিয়েছে? নাকি BMDC এর কাজ খালি সাধারণ জনগণকে সহায়তা দেয়া?

আমি যেটা বুঝি সেটা হলো- চিকিৎসকদের প্রয়োজনে একটি "ইমার্জেন্সী আইনী রেসপন্স টিম" এখন সময়ের দাবী।সারাজীবন বই খাতায় মুখ গুঁজে সময় পার করা এই লোকগুলো আইনী জটিলতা বোঝে কম। হাইপোথেটিক্যাল এই ব্যাপারটাকে তাই এখন বাস্তবে রূপ দিতে হবে....

#একটি_নির্মোহ_পর্যবেক্ষণঃ.....

একটা অবজারভেশন না বলে পারছি না।জুনিয়র চিকিৎসকরা মার পর্যন্ত খান।সিনিয়র চিকিৎসকদের কখনও খুব একটা উচ্চবাচ্য করতে দেখিনি।কিন্তু আমাদের সিনিয়ররা, শিক্ষকরা যখনই বিপদে পড়েছেন, এই জুনিয়ররাই সবসময় সরব হয়েছেন। জুনিয়র চিকিৎসকদের এই ভালোবাসার মূল্যায়ন কিন্তু সবাইকে করতে হবে.....

#মোম_ও_সুতোঃ..

সাধারণ জনগণদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলা প্রয়োজন.....

মোমবাতির ভিতর সুতোটা একদিন মোমকে প্রশ্ন করলো ,"আমি পুরে যাচ্ছি, কিন্তু তাতে তুমি গলে যাচ্ছো কেন?"

মোম হেসে উত্তর দিল,"যাকে অন্তরের মাঝে রাখলাম, তাকে একা কিভাবে পুড়ে যেতে দেই বলো?"....

আপনারা যখন অসুস্থ হন, মোমের সলতের ন্যায় পুড়তে থাকেন, আমরাও কিন্তু তখন ব্যথিত হই, আমাদের অন্তরটিও তখন মোমের ন্যায় গলতে থাকে। এটি আপনাদের বুঝতে হবে।আমাদের বাহ্যিক কাঠিন্যতা দেখেন, অনুরোধ করব অন্তরটাও দেখুন....

যে কঠিন কঠিন কথাগুলো বলেছি সেগুলো আপনাদের (সাধারণ জনগণদের) জন্য নয়।যারা ভাংচুর করে, চিকিৎসক পিটিয়ে সাধারণ জনগণদের চিকিৎসায় বাঁধার সৃষ্টি করে, এই কাঠিন্যতা তাদের জন্য....

#পরিশেষঃ....

বেলাশেষের গ্লানির কথা বলে লেখার ইতি টানবো....

ছবিতে দেখলাম অধ্যাপক ডাঃএবিএম আবদুল্লাহ স্যারের মত লোক আদালতে রুমের বাইরে বেঞ্চিতে চিন্তিত মনে বসে রয়েছেন। বেলাশেষে এদেশের মানুষকে কি দিলেন আর তার বিনিময়ে কি পেলেন-ব্যথিত চিত্তে হয়ত সেই হিসেব কষছেন। একুশে পদক প্রাপ্ত এই লোকটিকে পুলিশের খাতায় পলাতক হিসেবেও দেখানো হলো।কি বিচিত্র এই দেশের মানুষ!!!

আরো কিছু কথা বলতে চেয়েছিলাম, বাদ দেই, কিছু সন্ত্রাসীকে ঠান্ডা করতে যে দেশে আবদুল্লাহ স্যারের মত লোককে অপরাধী বানানো হয়, সেই দেশে বেশী কথা নিরর্থক। দস্তয়োভস্কির একটা কোটেশন জানি, সেটা বলে বিদায় নেইঃ

"Pain and sufferings are always inevitable for a large intelligence and a deep heart. The really great men must, I think, have great sadness on earth....."

_______________________________

ডা. জামান অ্যালেক্স । দেশের একজন জনপ্রিয় কলাম লেখক।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়