Ameen Qudir

Published:
2017-03-15 18:48:44 BdST

গনশত্রু হইবে না কি সাক্ষাৎ ভগবান হইবে


 
ডা. রেজাউল করীম
_____________________________


অনেকেদিন পর কুইন ভিক্টোরিয়ার স্মৃতি সৌধ দেখতে গেছিলূম। মার্বেল বিছানো রাস্তায় কোনক্রমে এগিয়ে চলেছি, হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, একজন ঘাড়ের উপর এসে পড়ল। কোন রকমে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেলুম। দেখলূম মুণ্ডিতমস্তক দিব্য কান্তি পুরুষ গায়ের ধুলোবালি ঝেড়ে সদ্য উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তর্জন করছেন। "রে পাপিষ্ঠ, অকালকুষ্মাণ্ড, বরাহনন্দন। তোর চক্ষুযুগল কি গৃহবন্দি করিয়া পথে নামিয়াছিস, নাকি কুলটা রমনীর মত আমার দেহস্পর্শবাসনায় মরুতসন্তানদের ন্যায় উল্লম্ফন করিয়াছিস"।

 

বললাম- মাপ করবেন। আপনাকে দেখতে পাইনি। কিন্তু, মনে হয় আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি শ্রী ক__
তিনি একটু নরম হয়ে হাতের মুদ্রায় আমাকে থামিয়ে দিলেন। "বৎস, আমি বর্তমানে অজ্ঞাতবাসে। তুমি ও নাম উচ্চারণ করিও না। বিশেষ, সে নসিরাম বাবুও নাই, সে প্রসন্ন গোয়ালিনী ও নাই। হা, কোথা সে ক্ষীরনবনী, কোথা আমার সে কমলাশ্রম। সবই গিয়াছে"।
এই বলে তিনি নিকটবর্তী বৃহৎ কাষ্ঠে উপবেশন করে মনোকষ্ট নিবারনের জন্য সুবৃহৎ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তাঁর বেশবাস পরিপাটি, মুন্ডিত মস্তকে জাজ্বল্যমান শিখা, কপালে চন্দনতিলক, চোখ করমচার মত রক্তবর্ণ। কাল হোলি গিয়েছে- অহিফেনের সাথে বোধহয় ধুতরো মিশিয়ে সেবন করেছেন।


আমি বললাম- প্রায় শতাধিক বর্ষ পর আপনাকে দেখে যারপরনাই প্রীত হলাম, মহাশয়। আপনার আগমনের কি বিশেষ কোন উদ্দেশ্য আছে?
ক: বৎস, সমতটে শুনিলাম বাঘ্রাচার্য্য বৃহল্লাঙ্গুল্লের রাজত্ব চলিতেছে , তাই চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভণ্জনার্থ এইস্থানে আসিলাম। আমি "ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট বিল 2017" র পরবর্তী অবস্থা দেখিবার নিমিত্ত আসিয়াছি।
আমি বললাম: আপনিই না চিকিৎসকদের তিন প্রতারকের এক প্রতারক বলেছিলেন, কেন জানতে পারি কি?
ক। এই কথাটাই আমি দধিনবনিসণ্চয়কারিনী প্রসন্ন গোয়ালিনীকে বলিয়াছিলাম। দুগ্ধ-দধি-ক্ষীর-নবনী গোমাতার স্তন্যজাত। সে নবনী তোর হইল কি প্রকারে? তুই কোন অধিকারে আমার নিকটে মূল্য প্রার্থনা করিস? চিকিৎসক ভিষগাচার্য্য শুক্রের নিকট জ্ঞান অর্জন করিয়া কোন অধিকারে মৃল্য প্রার্থনা করে? তাহাদের জ্ঞান ঈশ্বরদত্ত তাহা বিক্রয় করিয়া উপার্জন অন্যায়, অধর্ম।

 

আমি মৃদু প্রতিবাদ করে বললাম- মহাশয়, চিকিৎসক গৃহ প্রতিপালন কি করে করবে, মূল্য ছাড়া এ পৃথিবীতে কি কিছু পাওয়া যায়?
ক। আমি কি প্রকারে সংসার প্রতিপালন করি? আমার নাতিবৃহৎ সংসারে আমি ছাড়াও তিনটি মার্জার শিশু আছে। ঈশ্বর কি আমাকে নিরাহারী রাখিয়াছেন?
আ। আপনার চলে কি করে? শুনেছি ভিক্ষা---
ক। প্রসন্ন মাগী বলিয়াছে বুঝি, অনৃতভাষিনী,দাসীকন্যা । আমি কোর্টে হলফনামা পেশ করিয়া বলিয়াছিলাম, আমার পেশা ব্রাক্ষ্মণ ভোজনের নিমন্ত্রণ গ্রহন।


আ। মহাশয়, এ কি অবিচার !। সবাই নানারকম ব্যবসা করছে, শুধু চিকিৎসকরা ---
তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে থাকলেন- যতক্ষন রোগীর পরিচর্যা করিবে, নিরাময় করিবে ততক্ষণই তুমি পীড়িতের ঈশ্বর। নিরাময় হইয়া গেলে তুমি নিশ্চিত পিশাচযোনি প্রাপ্ত হইবে। ইহাই তোমাদের ভবিতব্য। প্রাগযৌতিষ থেকে সমতট, এমনকি বংগালেও এই নিয়ম অনন্তকাল চলিতেছে।
আ। মহাশয়, চিকিৎসক, বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র অংশমাত্র, অথচ, সর্বত্র তারা কেন নিন্দিত হবে। আমাদের এর বিরুদ্ধে কিছু একটা করতে হবে।
ক। বৎস, তুমি সদ্যোৎপাদিত ছাগশিশুর ন্যায় উল্লম্ফন করিতেছ। চিকিৎসককুল অতি বুদ্ধিমান। তাহারা সবাই শাল্মলীতরুর ন্যায়, কেহ কাহারো সন্নিকটে থাকে না। যাহারা ক্ষুদ্র তাহারা যোটবদ্ধ হয়। পিপীলিকা যূথবদ্ধ, কিন্তু সিংহ তাহার সহধর্মিণী ও সন্তান ভিন্ন অন্য কাহাকেও সঙ্গী করেনা। সুতরাং, যুথবদ্ধ চিকিৎসক স্বর্ণ-প্রস্তরের ন্যায় অলীক।

আ। হাসপাতালে ধর্মঘট করে এর প্রতিকারের চেষ্টা করব। মানুষকে বূঝতে হবে সরকার তার নিজের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে চিকিৎসকদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙছে।
ক। তুমি মৃগশিশুর ন্যায় অবোধ। শোন, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান দুইপ্রকার- আপেল জাতীয় আর তরমুজ জাতীয়। একদল বাহিরে মনোহর, ভেতরে মিষ্টি, কখনো একটূ দড়কচা মারা, স্থানে স্থানে পচা ও হইতে পারে।। সব প্রাইভেট হাসপাতাল এই গোত্রের। সেখানে চিকিৎসক শিখণ্ডী মাত্র। লোকসেবা নিমিত্ত মাত্র- সে ব্যবসার ফল রাজনৈতিক ও ব্যবসাদারের সমান অংশীদার। তোমরা যাহা দেখিতেছ, তাহা ঘটিতেছে না। যাহা ঘটমান, তাহা দৃষ্টিগোচর নহে। বাঁটোয়ারার অসাম্য নিমিত্ত জগতের সর্ব যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আবার সন্ধি হইবে, আবার বংশিধ্বনি নিনাদিত পুষ্পিত প্রভাত আসিবে, আবার একাসনে বসিয়া তাহারা পরস্পরের পানে সপ্রেম নির্নিমেষ তাকাইয়া থাকিবে।

কথায় কথায় ভুলিয়াছি। দ্বিতীয় প্রকার চিকিৎসালয় তরমুজ জাতীয়। ইহা সরকারী। বহিরঙ্গে নধর, সবুজ। অন্তরে রঙিন, খাইতেও সুস্বাদু, কিন্তু তাহা খাইয়াও সুজনে নিন্দা করিবে। তাহা নিন্দা করিবার ক্ষুধা বিনা সব ক্ষুধা নিবারন করে । নিরাময় করিতে পারিলেও নিন্দা হইবে, না পারিলে গলাধাক্কা খাইবে। চিকিৎসক ও তাহা হইতে সবিশেষ অর্থ লাভ করিতে পারিবে না।


আ। তাহলে, এর কোন প্রতিকার নেই।
ক। আমরা বঙ্গবাসী, ব্যবসায় আমাদের প্রপিতামহের পেশা। ভর্জিত বেসনের ব্যবসা করিয়া আমার জৈষ্ঠা ভগিনী কোটিপতি হইয়াছে। বৎস, তুমিও তাহাই করিতে পার। তুমি ধবলী চরাইয়াও জীবিকা নির্বাহ করিতে পারিবে।
চিকিৎসাবিদ্যা দুগ্ধ,দধি,নবনী সম- ইহা গাভীর সম্পত্তি। ইহা বিক্রয় ক্রাইম এগেনস্ট হিউম্যানাটি। তোমরা স্থির কর, গনশত্রু হইবে না সাক্ষাৎ ভগবান স্বরূপ হইবে- ক্ষুধার অন্নের অভাব হইবে না, চাল,কলা,মূলোর নিত্য নৈবেদ্য মিলিবে।

______________________________

ডা. রেজাউল করীম । বাংলা র প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক। সুলেখক। সুপন্ডিত।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়