Ameen Qudir

Published:
2018-02-06 17:54:41 BdST

হাঁপানি নিয়ে স্মৃতি: কিছু প্রচন্ড কষ্ট ও মুক্তি পাওয়ার কথা


 

 

অধ্যাপক ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস
_____________________________

যাঁরা সুস্থ হয়ে জন্মান,সুস্থ থাকেন তাঁরা একদিক দিয়ে খুবই ভাগ্যবান। কেননা,অনেকদিন এই পৃথিবীর রূপ রস আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। নিজের খুশিমত জীবনে চলতে পারেন।জন্মগত ভাবে রোগ নিয়ে যাঁরা আসেন,বিশেষতঃ যেগুলো দুরারোগ্য অথবা জীবনে চলতে চলতে রোগে আক্রান্ত হন,তাঁদের কাছে বাকি জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে।পরিবারের মানুষজনেরা এক অসুস্থ মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে ‘ক্রমাগত এক ডিপ্রেশন’এ আক্রান্ত হন।স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ তখন হারিয়ে যায়।হয় রুগী,অথবা আপনজন আড়ালে চোখের জল মোছেন।

 

যদি সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ থাকেন,তাঁর সাথে আমার জন্মের আগে থেকেই একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে আছে। নইলে জন্মের মুহূর্ত থেকে আমার শ্বাস নিতে এক কষ্ট হয় কেন ? একজনকে এই পৃথিবীতে জন্মাতে দিলাম কিন্তু শ্বাস নিতে দেব না !এ কি রকম রসিকতা ! খুব ছোটবেলার যে স্মৃতি মনে আছে, সবুজ রঙের ‘ব্রঙ্করডিল’ সিরাপের তেতো স্বাদ,’ওয়াইসোলোন’ ট্যাবলেটের বিটকেল বমি উদ্রেককারী ওয়াক্ ওয়াক্।সঙ্গে বেড়ে চলা বুকের সাঁই সাঁই,বাবার উদ্বিগ্ন মুখ আর চোখ মুছতে মুছতে আমার অবুঝ মায়ের আমার বুকে গরম তেল ডলে দেওয়া।দুই পাশে উদ্বিগ্ন দিদি আর ভাইয়ের মুখ। এই সব নিয়ে ছিল আমার ছোট বেলা,কৈশরকাল।সেই সময় হাঁপানি রোগের এত ভাল ইনহেলার বাজারে আসেনি।যেটুকু বেরিয়েছে,আমার বাবার কিনে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না।

Image result for হাঁপানি

 

 

সেই ছোট্ট থেকে এটা বুঝেছি যতদিন বাঁচব,আমাকে ওষুধ নিয়ে শ্বাসনালি খুলে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।আইসক্রিম আমার খুব প্রিয়।ছোটবেলায় ’ওয়াইসোলোন’ ট্যাবলেট খেয়ে লুকিয়ে আইসক্রিম খেতাম।ওতে রাতের শ্বাসকষ্ট আটকানো যেতো না।মা তাঁর দমচাপা কষ্টে বলতেন ‘কেন এসব খাস বাবা !’আমার অবুঝ উত্তর ‘সবাই খায় যে’। ওরকমই এক খুব ছোট বেলায় চিংড়ী মাছ খেয়ে জেঠুর সঙ্গে দার্জিলিং মেলে উঠে ছিলাম।ভয়াবহ শ্বাসকষ্টের জন্য ট্রেন থেকে নামিয়ে আমাকে নিউ জলপাইগুরির রেল হাসপাতালে ভর্তী হতে হয়েছিল।তারপর থেকে আজ পর্যন্ত,প্রায় চল্লিশ বছর চিংড়ী মাছ খাই নি।


এই সব ঝঞ্জাটে হাপাতে হাপাতে ওষুধ খেতে খেতে বড় হতে হতে বুঝলাম বাড়ির সবাইকে অস্থির করা ঠিক নয়।তাই কৈশর থেকেই আমার রাতজাগা শুরু।রাতে শ্বাসকষ্ট বেশি হয়।বললাম ‘রাতে পড়তে হবে’।এতে হলকি রাত জেগে আমি কেবল অঙ্ক করতাম আর দুনিয়ার সাহিত্য পড়তাম।বড়দের লেখা গুলো বেশি করে পড়তাম। ফলতঃ আমার সময়ে অঙ্কে আমি উচ্চমাধ্যমিকে পশ্চিমবঙ্গে সব চেয়ে বেশি নম্বর পেলাম।পৃথিবীতে এটাই আমার একমাত্র অহঙ্কারের জায়গা। প্রেসিডেন্সিতে ম্যাথ অনার্সে ভর্তী হলেও ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার জন্য ডাক্তারীতে ঢুকতে হল।

হাঁপানি আমাকে তখন তীব্রভাবে ভালবেসে ফেলেছে।ইনহেলার পাওয়া যায়,কিন্তু হোস্টেলের খরচা মিটিয়ে সেটা কেনার ক্ষমতা ছিলনা। বেটনিসল অ্যাসথালিন (ডাক্তারী পড়তে গিয়ে বুঝেছি এসব ক্ষতি করে..কিন্তু উপায় নেই) আমার নিত্য সঙ্গী।বেশ মনে আছে গ্লোবে ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই’ দেখতে দেখতে পাঁচটা অ্যাসথালিন ট্যাবলেট খেয়েছিলাম। সে অর্থে,সত্যিকারের বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ইনহেলার আমি নিতে শুরু করেছি পিজি করার সময়। নিজের পয়সায় কিনে।অনেক দেরি হয়ে গেছে তখন। তবে তখন থেকে শ্বাস নেওয়া আমার কাছে বেশ সহজসাধ্য। ভালই লাগে,অন্য সুস্থ পাঁচজনের মত শ্বাস নিতে পারি।


এইবার প্রেম ! হ্যাঁ,প্রেম। আমারও প্রেমের ইচ্ছে ছিল ! কিন্তু সে আর হল কই !কোন মেয়ে এমন সবসময় হাঁপাচ্ছে,কাশছে ছেলের সাথে প্রেম করবে ! তাই ‘সামাজিক বিবাহ’ ।পাত্রী(আমি একটি পাত্রীই দেখেছিলাম) দেখতে গিয়ে আমি সটান বলেছিলাম “আমার হাঁপানি রোগ আছে,রোজ ইনহেলার নিতে হয়..আপনি এই রোগ সম্পর্কে খোঁজ নেবেন..তারপর আপনার মতামত দেবেন।নয়ত আপনাকে আমার দারুন পছন্দ হয়েছে’।বাড়িতে মা সব শুনে বললেন ‘আমি পছন্দ করে এলাম,আর তুই এসব বললি..তুই বদ্ধ উন্মাদ’। রাতে খাবার টেবিলে মা বললেন “তোর থেকেও তোর ভাবী বৌ বেশি পাগল।তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।ফোনে ঐ বাড়ি থেকে জানাল”।আমি হতবাক।

এখন আস্তে আস্তে ইনহেলার এর ডোজ বাড়াতে হচ্ছে। অনেক বছর হল না ! এতদিন আমার চলারই কথা নয়।এখন ছোটবেলার রাত ফিরে আসতে চায়। যেদিন ফিরে আসতে চায়,আমি লাফিয়ে উঠে আরো ইনহেলার নেই।মাঝরাতে মেয়ের ঘরে উঁকি মারি।পাগলী আমার সমানে অঙ্ক কষছে।ঠিক আমার মত। তবে ওর শ্বাসকষ্ট হয় না।আমি পেছনে দাঁড়িয়ে চুপি চুপি ওর কো-অর্ডিনেট জিওমেট্রি করা দেখি।ওকে টের পেতে দেই না। আস্তে আস্তে বেরিয়ে ডাইনিং স্পেসে মায়ের ছবির নিচে দাঁড়াই।মা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
মনে মনে বলি,’এই মা ! দেখছ,ছোটবেলার মত হচ্ছে।কত কিছু পড়া হয়নি।আবার রাত জেগে পড়াশোনা শুরু করি ‘। বিছানায় শুই।মাথার কাছের টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে “বিষাদ সিন্ধু” পড়তে শুরু করি। দু পাতা পড়তেই,মেয়ে পাশে এসে বসে।বইটি হাত থেকে নিয়ে পেজ মার্কার রেখে বন্ধ করে।চুলে হাত বোলায় ও। বলে “তুমি এবার ঘুমোও”। আমি আস্তে বলি “তোর মা জেগে ওঠে নি তো?” মেয়ে মাথা নাড়ে।

আমিও চোখ বুঝি।
__________________________________

- অধ্যাপক ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস, কলকাতার প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক; কবি লেখক ও চিন্তক।

আপনার মতামত দিন:


প্রেসক্রিপশন এর জনপ্রিয়