Ameen Qudir

Published:
2017-02-16 14:46:46 BdST

এই লেখাটি সকল চিকিৎসকের অবশ্য পাঠ্য : পড়তে ভুলবেন না: শেষ কিস্তি


 

 

ডাক্তার প্রতিদিন
_______________________________

 

প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য সেবা আইন ২০১৬ঃ একটি আইনগত সমীক্ষা । লিখেছেন চিকিৎসক পরিবারের সন্তান কাজী ওয়াসিমুল হক। লেখাটি তিনি তার পিতা প্রয়াত চিকিৎসক পিতা ডাঃ কাজী মোঃ শাহজাহানের (DMC K-26) স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছেন। ।লেখাটি সুলিখিত , সুব্যখ্যাত। সুপাঠ্য। দেশের সকল ডাক্তারের জন্য অবশ্য পাঠ্য। যখনই সময় হয়, পুরো লেখাটি পাঠ করা দরকার।

গতকাল অামরা লেখাটির প্রথম কিস্তি প্রকাশ করেছি। আজ দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি প্রকাশ করলাম।

অামরা লেখাটি সকলের পাঠের জন্য পেশ করলাম।


লোকসেবী আইনজীবী কাজী ওয়াসিমুল হক ডাক্তার প্রতিদিনের পাঠকদের কথা দিয়েছেন , তিনি নিয়মিত ডাক্তার অধিকার বিষয়গুলোতে লিখবেন। আইনী দিকে চিকিৎসক সমাজকে আপ টু ডেট রাখবেন।
_____________________________

 

 

কাজী ওয়াসিমুল হক

_______________________


এটা আপনাদের জন্য গুরুত্বপূর্ন, চিকিৎসকদের অবহেলা এই পরিচ্ছেদের ১৭(১) এ বর্নিত আছে

১৭। চিকিৎসা সেবায় অবহেলা বলিতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলিকে বুঝাইবেঃ
(১)। চিকিৎসক কর্তৃক যথাযথ দায়িত্ব পালনে অবহেলা-
ক. ভুল চিকিৎসা করা; খ. রোগ নির্ণয়ে ভুল করা; গ. ভুল ঔষধ প্রদান; ঘ. ভুল অঙ্গ অপসারণ;ঙ. ভুল বা অতিরঞ্জিত রিপোর্ট প্রদান;চ. একাধিক রোগীকে একত্রে পরীক্ষা করা;ছ. মাদকাসক্ত বা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় চিকিৎসা দেওয়া;জ. মারাত্মকভাবে সংকটাপন্ন রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসা আরম্ভ না করিয়া সম্মতির জন্য অপেক্ষা করা; ঝ. জরুরী ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রদানে অহেতুক বিলম্ব করা;ঞ. অপ্রয়োজনীয় প্যাথলজিক্যাল ও ডায়াগনষ্টিক টেস্ট দেওয়া; ট. ব্যবস্থাপত্রে অপ্রয়োজনীয় এবং বিভিন্ন কোস্পানীর একই ওষুধ বার বার প্রদান করা; ঠ. নিজ ক্ষেত্রের বা এখতিয়ারের বাহিরে চিকিৎসা দেওয়া;ড. কর্মস্থলে বিলম্বে আসা এবং কর্মঘন্টা পূর্ণ হইবার পূবের্ কর্মস্থল ত্যাগ করা বা বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকা; ঢ. চিকিৎসার নির্ধারিত প্রটোকল (Protocol) অনুসরণ না করা;ণ. চিকিৎসকের কাজ নিজে না করিয়া নার্স, আয়া, ওয়ার্ড বয় দ্বারা করানো;ত. প্রয়োজনের তুলনায় কম বা মাত্রাতিরিক্ত ঔষধ প্রদান; থ. ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকে (মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ) নির্দিষ্ট সময়ের বাহিরে সাক্ষাৎ দেওয়া।

‘অবহেলা’ হিসেবে যেসব জিনিস এখানে বর্নিত হয়েছে, তার কয়েকটি সম্পর্কে আগেই প্রথমদিকে একবার আলোচনা করা হয়েছে, যেসব আলোচনা করা হয়নি, সেসব নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।
অবহেলার কয়েকটি উপাদান একেবারে পরিস্কার, সেসবে ভুল বোঝাবুঝির বা অস্পষ্টতার কোন সুযোগ নেই, যেমন ভুল অঙ্গ অপসারণ।তবে কিছু ব্যাপার আছে যেখানে প্রশ্ন উত্থাপন করা চলে।

প্রথমেই আসে ভুল চিকিৎসা এবং রোগ নির্নয়ে ভুলের কথা কথা, হ্যা এসবে ভুল হতে পারে, কিন্তু সেই ভুল কি চিকিৎসকের অবহেলার কারনে হয়েছে নাকি রুগী ভুল বা অসম্পূর্ন তথ্য দেয়ার কারনে হয়েছে, সেটা কিভাবে বিচার বিশ্লেষন এবং প্রমান হবে?
ভুল ঔষধ প্রদান ব্যাপারটা আপেক্ষিক, পেসক্রাইব করা ঔষধ ভুল হতে পারে, চিকিৎসক যে রোগের লক্ষন মনে করে সেটা দিয়েছিলেন, বা রুগীর কথা শুনে যে রোগ আছে মনে করেছিলেন, যদি সেই রোগের জন্য সেটা ঠিক ঔষধ হয়ে থাকে?
‘একাধিক রোগীকে একত্রে পরীক্ষা করা’ ব্যাপারটাকে এই আইনে কেন অবহেলা বলা হয়েছে তা আমার কাছে ঠিক পরিস্কার না, যদি গোপনীয়তার কোন ব্যাপার স্যাপার না থাকে তাহলে সমস্যা কোথায়? বাই দি ওয়ে, কেউ কি খেয়াল করেছেন এখানে ‘স্বেচ্ছায়’ বা ‘যথোপযুক্ত কারন ব্যাতীত’ টাইপ কোন শব্দ নেই, মানে হচ্ছে, কোন চিকিৎসক রুগী দেখার সময় যদি অপর কোন রুগী চেম্বারে বা কক্ষে জোর জবরদস্তি করে ঢুকে বসে থাকে এবং ডাক্তার সাহেব তারপরও যদি আগের রুগীর চিকিৎসা চালিয়ে যান, তাহলে তিনি এই আইন অনুসারে ‘অবহেলা’ করবেন। জাস্ট কিউরিয়াস, এসব সম্ভাবনা কি বাংলাদেশে কেবল আমিই দেখতে পাই?
এর পর আসি অপ্রয়োজনীয় প্যাথলজিক্যাল ও ডায়াগনষ্টিক টেস্ট দেওয়া নিয়ে, এটা কারা স্থির করবেন যে কোনটা এই ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ছিল? চিকিৎসক রুগির রোগ বর্ননার উপর ভিত্তি করে সেসব দিয়েছেন নাকি নিজ লাভের জন্য সেসব দিয়েছেন সেটা কিভাবে প্রমান করা যাবে?
কর্মস্থলে বিলম্বে আসার ব্যাপারটা ক্রিটিক্যাল, কয়দিন? একবার হলেই এই আইনে আসবে নাকি নিয়মিতভাবে বিলম্বে আসলে? একই প্রশ্ন কর্মঘন্টা পূর্ণ হবার আগে কর্মস্থল ত্যাগ করা বা বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকা সম্পর্কে বলা চলে। সাইড প্রশ্ন, জরুরী কারনে কর্মস্থল ত্যাগ করা দরকার (বাচ্চা বা পিতা-মাতা অসুস্থ), যিনি অনুমতি দিবেন তিনি দিচ্ছেন না, বা তাকে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন কি হবে?

এই আইনের ১৭(৩) ধারায় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের অবহেলা সম্পর্কে বলা হয়েছে আর ১৭(৪) এ বলা হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সরকারের অবহেলা সম্পর্কে, এসব নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন মনে করছি, যার দরকার বা ইচ্ছা হবে মূল আইন দেখে নিবেন।
তবে এই আইনের অন্ধকূপ যদি কোথাও থাকে, তাহলে সেটা আছে ধারা ১৮ তে, দেখুন এখানে কি বলা হয়েছে!

১৮। চিকিৎসা সেবায় অবহেলা জনিত ক্ষতি বলিতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলিকে বুঝাইবেঃ

ক. শারীরিক ক্ষতি-অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারানো, দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি হারানো, স্বাভাবিক জীবনযাপনে অসমর্থতা ইত্যাদি;
খ. মানসিক ক্ষতি-মানসিক ভারসাম্য হারানো, প্রিয়জন হারানো, মানসিক চাপ তৈরী হওয়া ইত্যাদি;
গ. আর্থিক ক্ষতি-চিকিৎসা খরচ বৃদ্ধি, চাকরি হারানো, ব্যবসায় লোকসান ইত্যাদি যেইসব ক্ষেত্রে বতর্মান ও ভবিষ্যতের ক্ষয়ক্ষতিও বিবেচিত হইবে;
ঘ. সামষ্টিক ক্ষতি-রোগীর মৃত্যু, প্রজনন ক্ষমতা হারানো, দাম্পত্য জীবন নির্বাহে অসমর্থতা, সামগ্রীকভাবে সাংসারিক দায়িত্ব পালনে অসমর্থতা ইত্যাদি।

বাজী ধরে বলতে পারি বাংলাদেশের কোন চিকিৎসক এই ধারা দেখে বুঝতে পারেননি এটা তাদের জন্য কতখানি বিপদজনক একটা ধারা। সহজ করে বলি, উপরে যা কিছু দেখছেন, এসব কারনে আর্থিক ক্ষতিপূরন চেয়ে রুগীরা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে এবং এই মামলা দায়ের হবে সংশিষ্ট ‘যুগ্ম জেলা জজ’ এর নিকট, মনে বিপদ ঘন্টি বাজেনি তাইনা? স্বাভাবিক! এবার তাহলে বাজাই, জেনে রাখুন আর্থিক ক্ষতিপূরনের আদেশ দেবার ক্ষেত্রে যুগ্ম জেলা জজের ক্ষমতা অসীম, সহজ কথায় বলতে গেলে যুগ্ম জেলা জজ যেকোন অঙ্কের ক্ষতিপূরনের আদেশ দিতে পারেন!
বিপদজনক ব্যাপারটা হচ্ছে, অবহেলা জনিত ক্ষতি বলতে যা বোঝানো হয়েছে তার সবকিছু পরিস্কার বা স্থির না,

ক. শারীরিক ক্ষতি-অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারানো, দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি হারানো, স্বাভাবিক জীবনযাপনে অসমর্থতা ইত্যাদিঃ স্বাভাবিক জীবন যাপনে অসমর্থতার কথাই ধরুন, আমার স্বাভাবিক জীবন যাপন এবং আপনাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন এক না, কারটা কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে? মাপকাঠি কি? এই আইনে যদি কেউ ক্ষতিপূরন দাবী করে, তাহলে নিশ্চিত থাকতে পারেন কোলাব্যাঙ ও নিজেকে হাতি হিসেবে দাবী করবে।
খ. মানসিক ক্ষতি-মানসিক ভারসাম্য হারানো, প্রিয়জন হারানো, মানসিক চাপ তৈরী হওয়া ইত্যাদিঃ প্রিয়জন হারানোকে কিভাবে পরিমাপ করা যায়? অনেকে তো আছে নিজের মায়ের চেয়ে শাশুরী মরলে বেশী দুঃখিত হবে, অনেক সন্তান আছে বাপ মরলে রীতিমত পার্টি দেবে, এই আইনে তো মনে হচ্ছে মানবিক সম্পর্ক ব্যাপারটাকে পরিমাপ করার চেষ্টা চলছে, এই আইন চালু হলে চিকিৎসা অবহেলায় বাপ মরলে এত টাকা পাবে আর বৌ মরলে এত টাকা পাবে জাতীয় আইনী নজীর আমরা দেখতে পাব। ভাল কথা, মানসিক চাপ বা ক্ষতি ব্যাপারটাকে কিভাবে পরিমাপ করা হবে? আমার জানা মতে বিশ্বের কোন আইনী ব্যাবস্থায় এটা পরিমাপের কোন উপায় বলা হয়নি। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানসিক ক্ষতি-ভারসাম্য হারানো বা মানসিক চাপের ব্যাপারটা যে এই আইন অপব্যাবহারের প্রথম হাতিয়ার হয়ে উঠবেনা, সেটা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে ?
আর্থিক ক্ষতি-চিকিৎসা খরচ বৃদ্ধি, চাকরি হারানো, ব্যবসায় লোকসান ইত্যাদি যেইসব ক্ষেত্রে বতর্মান ও ভবিষ্যতের ক্ষয়ক্ষতিও বিবেচিত হইবেঃ সাথে আরো কিছু যোগ করা যেতে পারে, যেমন রুগীর মেয়ের বিয়ে না হওয়া, বিদেশে ভিসা না পাওয়া, প্রমোশন না হওয়া, পোষা প্রানীর মৃত্যু, কোন কিছু বাকী রাখা ঠিক হবেনা, ঢেলে দিন!
সামষ্টিক ক্ষতি-রোগীর মৃত্যু, প্রজনন ক্ষমতা হারানো, দাম্পত্য জীবন নির্বাহে অসমর্থতা, সামগ্রীকভাবে সাংসারিক দায়িত্ব পালনে অসমর্থতা ইত্যাদিঃ চিকিৎসার আগে রুগীর প্রজনন ক্ষমতা কেমন ছিল তার প্রমান কোথায় পাওয়া যাবে? দাম্পত্য জীবনে অসমর্থতা বলতে ঠিক কি বোঝায়, আমরা যা বুঝি তা তো আবার সবার জন্য এক না, কেউ শাড়ি কিনে দিতে না পারলে অসমর্থ আর কেউ পাজেরো দিতে না পারলে। আর যদি সামগ্রীক দায়িত্বের কথা বিবেচনা করা হয়, কোন ডাক্তার মনে হয় তাহলে আর বড়লোক রুগীদের চিকিৎসা করতে চাইবে না!

চিকিৎসকরা কি বুঝতে পারছেন আপনাদের কত গভীর গর্তে ঠেলে দেয়া হচ্ছে ? অস্পষ্ট এবং বায়বীয় সব কারনে আপনাদের বিরুদ্ধে যেকোন অঙ্কের মামলা দায়ের করা যাবে আর বিচারক যদি বুদ্ধিমান না হন বা চিকিৎসকদের প্রতি তার যদি কোন ক্রোধ থাকে, আক্ষরিক ভাবেই কোটি কোটি টাকা জরিমানার আদেশ জারী হতে পারে!

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ দাবী, অভিযোগ, প্রতিকার ইত্যাদি

এই আইনে জেলের বিধান নেই, তবে জরিমানার বিধান আছে। রুগী বা তার বৈধ প্রতিনিধি চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা সহায়ক কর্মচারী এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই আইনে আর্থিক ক্ষতিপূরন চেয়ে ঘটনার ০১ (এক) বছরের মধ্যে মামলা করতে পারবেন।
এই মামলা দায়ের করতে হবে যুগ্ম জেলা জজ আদালতে, জেনে রাখা ভাল টাকাপয়সার ব্যাপারে এই শ্রেনীর বিচারকের বিচারিক অধিক্ষেত্র অসীম, মানে আক্ষরিক ভাবেই কোন রুগী হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরন চেয়ে মামলা করতে পারবেন।
সাধারনত যা হয়, কেউ ক্ষতিপূরন চেয়ে কেস করলে তাকে কেসে ফাইলিং এর সময় একটা কোর্ট ফী দিতে হয়, যে যত বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরন চাইবেন তার কোর্ট ফী তত বেশী হবে, এই আইনে আবার কোর্ট ফীর ব্যাপারে বাদীকে চরম সুবিধা দেয়া হয়েছে, কেবল মাত্র ডিক্রি (মানে পক্ষে রায়) পেলে বাদীকে কোর্ট ফী দিতে হবে, মানে ঘড়েল টাইপ বাদী হলে খুব কম পয়সায় অভিযুক্ত চিকিৎসককে সাইজ করতে পারবে, আর এই আইন এত অস্পষ্ট এবং দোদুল্যমান যে আশঙ্কা করা চলে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে প্রায় সময় বাদী ছক্কা হাকাতে পারবে।
সরি, আসল দুঃসংবাদটাই দেয়া হয়নি, এই আইনে কেস খেয়ে তাতে জরিমানা দিলেই আপনার ভোগান্তি শেষ হবে না, যদি চিকিৎসকের বর্নিত অপরাধটি ফৌজদারী টাইপের হয় (বা সেরকম দাবী করা হয়), তবে সেই কথিত অপরাধে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ফৌজদারী আদালতেও মামলা চলবে বা অভিযোগকারী মামলা চালাতে পারবে, জী, একেই বলে রামেও মারে রাবনেও মারে!
তবে একটা কথা স্বীকার না করলে বা আপনাদের জানিয়ে না রাখলে অন্যায় হবে, এই আইনে আদালতে কেস দায়ের করলেই কোর্ট অভিযুক্তকে বেধে নিয়ে যেতে বলবেনা, এই আইনে কোর্টকে সরাসরি বলে দেয়া হয়েছে কেস দায়ের হবার পর প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে আগে আপোষ মীমাংসার চেষ্টা করতে (মানে আপোষ মীমাংসার জন্য কোর্ট সক্রিয় ভাবে চেষ্টা করবেন) আর সেই আপোষ মীমাংসা হবে লিখিত ভাবে। তবে যদি আপোষ-মীমাংসা না হয়, কেবল তখন আদালত অভিযোগটি নিষ্পত্তির জন্য গ্রহন করবেন।
তবে এই আইনের একটা বিশাল সমস্যার কথা বলি, যুগ্ম জেলা জজের রায়ের বিরুদ্ধে যদি দন্ডপ্রাপ্ত ব্যাক্তি কোন আপীল করতে চান, সেটা কোথায় করতে হবে তা কিন্তু এখানে বলা নেই। যুগ্ম জেলা জজই যদি এই ব্যাপারে প্রথম এবং শেষ ব্যাক্তি হয়ে থাকেন, তাহলে ‘খবর’ আছে!
এই আইনের ধারা ২৫ নিয়ে আমি কনফিউজড, এখানে ‘অভিযোগ গ্রহনকারী’ কাকে বলা হচ্ছে? অভিযুক্তকে নাকি? তাই যদি হয় তাহলে অপরাধ প্রমানের আগেই তার নাম দৃশ্যমান স্থানে টাঙ্গানো অনুচিত, যাই হোক, ধারা ২৫ ঠিক বুঝতে পারলাম না।

২৫। চিকিৎসা চলমান অবস্থায় রোগী বা তাহার প্রতিনিধি কতৃর্ক আনীত চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণকারীর নাম, পদবী, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর প্রতিষ্ঠানের দৃশ্যমান স্থানে টানাইয়া রাখিতে হইবে এবং অভিযোগের ভিত্তিতে গৃহীত ব্যবস্থা ও ফলাফল অভিযোগকারীকে অবহিত করিতে হইবে।

 

 

সরকারী চিকিৎসক যারা কেসের ব্যাপারে সরকারের অনুমতির কথা ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলেন, তাদের জন্য একটা দু;সংবাদ!

২৬। এই আইনে সরকারি চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে সরকার বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের পূর্ব অনুমোদনের প্রয়োজন হইবেনা।

সপ্তম পরিচ্ছেদ জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন

সরাসরিই বলি, যে সংস্থা একজন চিকিৎসকের লাইসেন্স স্থগিত বা ক্যান্সেল করে দিতে পারবে, এই আইন অনুসারে সেই সংস্থার মোট ৬ জনের মধ্যে টেকনিক্যালি কেবল একজনের চিকিৎসক হলেই চলে, দেখেন কাদের নিয়ে এটা গঠন হবে_

২৯। জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন নিম্নরূপে গঠিত হইবেঃ- (ক) একজন চেয়ারম্যান; (খ) চারজন সদস্য; এবং (গ) একজন সচিব, যিনি ন্যূনতম সরকারের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা হইবেনঃতবে শর্ত থাকে যে, চেয়ারম্যান হইবেন একজন কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি এবং চেয়ারম্যান ও সদস্যগণের মধ্যে অন্যূন একজন মহিলা হইবেন;আরও শর্ত থাকে যে, সদস্যগণের মধ্যে একজন অধ্যাপক পদ মর্যাদার চিকিৎসক হইবেন।

 

 

কিউরিয়াস, এখন তো কবিরাজরাও এই আইনে ‘চিকিৎসক’, তো উপরে বর্নিত অধ্যাপক মহোদয় কোন ঘরানার হবেন? MBBS ঘরানার হলে হাকিম এবং কবিরাজরা বৈষম্য বা ভুল বোঝাবুঝির শিকার হবেন না? উলটোও তো হতে পারে, তখন?
পয়েন্ট টু বি নোটেড, যে কমিশনের কাজ হবে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী ব্যাক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করন, তাদের লাইসেন্স স্থগিত এবং বাতিলকরন, যা করার জন্য প্রত্যেক সদস্যের সুগভীর চিকিৎসা জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, সেখানে এরা কিভাবে কি করবেন, এবং এরাই বা কেন করবেন? দেশে কি এসব দায়িত্ব সুষ্ঠভাবে পালন করার মত যোগ্য চিকিৎসক খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা?

৩০। (১) রাষ্ট্রপতি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণকে নিয়োগ করিবেনঃতবে শর্ত থাকে যে, সদস্যগণ হইবেন, যাঁহার-
(ক) চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি বা সমপর্যায়ভুক্ত বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান রহিয়াছে; বা (খ) আইন, মানবাধিকার, সামাজিক কর্মকান্ড, ব্যবস্থাপনা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, খাদ্য বিজ্ঞান অথবা জন প্রশাসনে কর্মের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও সুপরিচিতি রহিয়াছে; (গ) গরীব ও নিম্নআয় সম্পন্ন জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা, খাদ্য এবং পুষ্টি অধিকার উন্নয়নে ধারাবাহিক কর্মের অভিজ্ঞতা রহিয়াছে।

উপরে উল্লেখিত এই সব ‘মহান’ ব্যাক্তিদের দ্বারা গঠিতব্য এই জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন কি করতে পারবেন জানতে চাচ্ছেন? এই দেখুন_

৩২। কমিশন নিম্নবর্নিত কার্যসমূহ করিবে, যথাঃ-
(ক) এই আইনের প্রয়োগ;(খ) স্বেচ্ছা প্রণোদিত হইয়া বা অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত বা অনুসন্ধান;(গ) প্রয়োজনে জেলা ও উপজেলায় গমন করতঃ পক্ষগণকে নোটিশ প্রদান পূর্বক শুনানী গ্রহণ;(ঘ) এই আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগের উদ্দেশ্যে সরকারকে পরামশর্ প্রদান;(ঙ) যে কোন হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, ঔষধ কারখানা পরিদর্শন ও মান-উন্নয়নের নির্দেশ প্রদান এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদান করতঃ নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত প্রদান-
১. অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সতর্ককরণ;২. অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিলকরণ;৩. অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাকরণ;

জী, কেবল কোর্ট না, এই কমিশনও চিকিৎসকদের জরিমানা করতে পারবে, বেচারা চিকিৎসকরা, রামে মারে, রাবনে মারে, এখন মনে হচ্ছে বিভীষণও মারবে!

 

অষ্টম পরিচ্ছেদ চিকিৎসার রেকর্ড এবং তথ্য ভান্ডার

এখানে চিকিৎসকের উপর রুগীর চিকিৎসা সম্পর্কিত তথ্য সংরক্ষনের আদেশ চাপানো হয়েছে। তারমানে হয় রুগীকে প্রতিবার সব ফোটোকপি করে নিয়ে যেতে হবে অথবা চিকিৎসককে নিজ দায়িত্বে সব কপি বা স্ক্যান করে রাখতে হবে, বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়েছে জানি তবে চেম্বারে চেম্বারে ফটো কপিয়ার বা স্ক্যানার আসতে মনে হয় আরো অনেক বছর লাগবে, বাই দি ওয়ে, এসবের পেপার ভার্সন রাখার জন্য যে স্পেস লাগবে সেটা কি আসমান থেকে পড়বে? চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলি না হয় পারবে, ছোট খাট চেম্বার নিয়ে বসা চিকিৎসকরা? জাতি আরো জানতে চায় কয়জন হাকিম এবং কবিরাজ এই আইনে চাওয়া মতে এ পর্যন্ত রুগীর তথ্য সংরক্ষন করেছেন বা করতে পারবেন!


প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ গল্পে বর্নিত আছে আফগানিস্থানের এক খামখেয়ালী বাদশা (সম্ভবত আমান উল্লাহ) আদেশ দিয়েছিলেন সবাইকে টেবিল চেয়ারে বসে কাজ করতে হবে, লাভের মধ্যে কাঠমিস্ত্রি নিজেই গায়েব হয়ে গেল, সে নাকি টেবিল-চেয়ারে বসে র‍্যাদা চালাতে শিখেনি, কেবল আইন পাস করলেই চলেনা, আইনটা আদৌ বাস্তব সম্মত কিনা, সেটাও বিবেচনা করতে হয়।

নবম পরিচ্ছেদ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে রোগীর অধিকার সংরক্ষনের দায়-দায়িত্ব

কোন একজনের দায়িত্ব বাড়লো সেটা বোঝা যাচ্ছে _

৪৩। চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের একজন নির্ধারিত কর্মকর্তা - (১) রোগীর অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত ও প্রক্রিয়াকরণ করিবেন; (২) চিকিৎসা সেবার মান সংক্রান্ত অভিযোগ কতর্পৃক্ষের নজরে আনয়ন করিবেন; (৩) চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সকল চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ও প্রসাশনিক কর্মচারিকে এই আইনের বিধি-বিধান সম্পর্কে শিক্ষাদান ও নির্দেশনা প্রদান করিবেন।


সিনিয়র চিকিৎসক যারা এখনো ঝিমাচ্ছেন তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করছি, নিচের ধারাটিতে সবচাইতে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবেন আপনারা। আমার ব্যাক্তিগত মতে এই ধারা সম্পূর্ন অগ্রহনযোগ্য, প্রাইভেট প্র্যাক্টিসের সময় কোন চিকিৎসক কত টাকা ফী নেবেন সেটা তার একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার, এই ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ সম্পূর্ন অনভিপ্রেত।

৪৫। সরকার চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুসারে রোগীপ্রতি ফি নির্ধারণ করিবে।

আর যদি সরকার এটা রেখেই আইন পাশ করে ফেলেন তখন যা হবে, লিটনের ফ্ল্যাটের মতই মানুষ নামীদামী চিকিৎসকদের কাছে কেবল রেফারেন্সে যেতে পারবে, অন্য সময় সেই চিকিৎসক ‘ব্যাস্ত’ থাকবেন। এই বিধান রেখে আইন পাশ করলে বাশ ঠিকই খাবে, তবে সেটা চিকিৎসকরা না, জনগণ।
তবে নিচের ধারা দুটি সমর্থনযোগ্য!

৪৬। সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন প্রকার প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ই.সি.জি., ই.টি.টি., এম.আর.আই. ইত্যাদি পরীক্ষার সর্বোচ্চ মূল্য সরকার কতর্কৃ নির্ধারিত হইবে।
৪৭। কোন প্রতিষ্ঠান কতৃক কোন চিকিৎসককে যে নামেই হোক না কেন কোন কমিশন বা আর্থিক সুবিধা বা কোন উপহার প্রদান করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হইবে।

তবে এই আইনের সেরা অংশ হচ্ছে এটা!

৫০। সরকারি, বেসরকারি ও দাতব্য হাসপাতালে কর্মচারিগণের কোন প্রকার সংগঠন, যে নামেই হোক না কেন, থাকিতে পারিবে না।

কেন এই ধারার প্রতি সমর্থন জানালাম সেটা চিকিৎসকরা ভাল বুঝবেন, আমি আর হাটে হাড়ি ভাঙলাম না।
উপসংহারঃ কেবল চিকিৎসকদের উপর এই আইনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে যেয়েও লেখাটা এত বড় হয়ে গেল, চেষ্টা করেছি যথাসাধ্য সহজ রাখার জন্য, তবে ক্ষেত্র বিশেষে জটিল হয়ে গেলে সেজন্য আন্তরিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। আইন ব্যাপারটা আসলে জটিল।
প্রস্তাবিত এই আইনে উপরে উল্লেখিত মতামতসমূহ দিয়েছি একজন আইনজীবির দৃষ্টিকোন হতে, চিকিৎসকরা এই আইন অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবেন সেটাই স্বাভাবিক।

##
লেখাটা আমার প্রয়াত চিকিৎসক পিতা ডাঃ কাজী মোঃ শাহজাহানের (DMC K-26) স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত।
## প্রথমবার এই নোট প্রকাশের সময় প্রস্তাবিত আইনের লিঙ্কটা দেয়া হয়নি, আপনাদের সুবিধার্থে এবার দিয়ে দিলাম_
https://www.lc.gov.bd/reports/HS-23....

 

 

____________________________

যারা প্রথমাংশ পাঠ করতে চান তারা গতকালের ডাক্তার প্রতিদিনে নিচের লিঙ্কে লেখাটি পাবেন।

 

https://daktarprotidin.com/election/751/-%E0%A6%8F%E0%A6%87-%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%B8%E0%A6%95%E0%A6%B2-%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A7%8E%E0%A6%B8%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A0%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%AA%E0%A7%9C%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%AD%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%A8%E0%A6%BE

আপনার মতামত দিন:


নির্বাচন এর জনপ্রিয়