Ameen Qudir

Published:
2017-05-30 17:43:32 BdST

সংবাদ সম্মেলনে যে কথা শুনতে চায় ডাক্তারসমাজ


 

 

 

ডা. বাহারুল আলম
________________________________

৩০মে/২০১৭ বিএমএ র সংবাদ সম্মেলনে চিকিৎসকদের অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে কঠোর অবস্থানে থেকে রাষ্ট্র ও তার নির্বাহী বিভাগ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-এর প্রতি চাপ প্রয়োগ – এ সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ ।
.
সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএমএ–এর সাহসী অবস্থান - চিকিৎসকদের ঐক্য, দৃঢ়তা ও আস্থা অর্জনে সহায়ক হবে ।

ক্রমাগত চিকিৎসক লাঞ্ছনার ধারাবাহিকতায় হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনা বিএমএ-কে আন্দোলনের কথা ভাবতে , কর্মসূচী দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। রাজধানীতে চিকিৎসক নির্যাতনের এ ধরনের ঘটনা তৃণমূল বা প্রান্তিকে বিগত দিনগুলোতে অনেক ঘটলেও, রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার দাবী করার তাগিদ এর আগে বিএমএ এত জোরালোভাবে অনুভব করে নি। তারকা চিকিৎসক ডা এবিএম আবদুল্লাহ লাঞ্ছিত হওয়ায় সমগ্র দেশে এ ঘটনা স্ফুলিঙ্গের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে। অপরদিকে বিএমএ-ও জরুরি সভায় তড়িৎ কর্মসূচি ঘোষণা করে।

চিকিৎসকদের সকল অধিকারহীনতা ও বঞ্চনার বিপরীতে আছে রাষ্ট্র ও তার নির্বাহী বিভাগ মন্ত্রণালয়। এর বিপক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে অতীত বিএমএ দুঃখ পেত, লজ্জা পেত। রাষ্ট্র ও তার নির্বাহী বিভাগের বিপরীতে সংবাদ সম্মেলন করা বর্তমান বিএমএ-র জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। একদিকে বঞ্চিত, লাঞ্ছিত রোগী ও চিকিৎসক সমাজ, অপরদিকে রাষ্ট্র ও তার নির্বাহী বিভাগের চরম ব্যর্থতা।

এ চ্যালেঞ্জকে আত্মস্থ করে সংবাদ সম্মেলনে সরকারকে দাবী মানার হুশিয়ারি দিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার মধ্য দিয়েই বিএমএ চিকিৎসকদের কাছে আস্থাশীল হয়ে উঠবে। সরকারের প্রতি কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করতে না পারলে সমঝোতা, আলাপ-আলোচনায় চিকিৎসকদের অধিকার অর্জন হওয়ার সম্ভাবনা বা বাস্তবতা একেবারেই ক্ষীণ।

*দায়মুক্তিসহ রাষ্ট্রের যে সকল আইন চিকিৎসকদের পেশাগত অধিকার ও মর্যাদা অস্বীকার করে, ফৌজদারি আইনে ফৌজদারি অপরাধী হিসাবে বিচার করে- এসবের বিরুদ্ধে বিএমএ-কে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। রাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিতে হবে, চিকিৎসা একটি মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞান ভিত্তিক কার্যক্রম। এখানে কোন ফৌজদারি অপরাধ সংগঠিত হয় না।

*যে হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ , সিসিইউ নাই, সেখানে রোগীর মৃত্যুতে চিকিৎসকের লাঞ্ছনা অবধারিত। মুমূর্ষু রোগী যে সকল হাসপাতালে ভর্তি হয় সে সকল হাসপাতালে জরুরিভাবে আইসিইউ, সিসিইউ চালু করতে হবে। অব্যাহত শারীরিক লাঞ্ছনার কারণে চিকিৎসকরা এখন মুমূর্ষু রোগী চিকিৎসা করতে ভয় পায়। এ মনস্তাত্ত্বিক অমানবিক অবস্থা সৃষ্টি করার জন্য রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন অভিযুক্ত হবে না – এটি স্পষ্ট করে প্রচার মাধ্যম ও নাগরিকদের অবহিত করতে হবে।

* ৩১ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অর্গানোগ্রামে কোন জরুরি বিভাগ না থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রণালয় জরুরি বিভাগ চালু রাখার বাধ্যবাধকতার কারণে অনেক চিকিৎসক শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে। এ সকল অমানবিক, অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান থেকে কথা বলতে হবে।

* তৃণমূলে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে, তা মান্ধাতা আমলের পশ্চাৎপদ, অনাধুনিক। সেখানে রোগীকে পরিপূর্ণ চিকিৎসা দেওয়া অসম্ভব। চিকিৎসকদের নিরাপত্তা বিশেষ করে নারী চিকিৎসকদের নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ। বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে চিকিৎসা দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি , টেকনোলজিস্ট, মতামত দেওয়ার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়হীনতা। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন আছে সনোলজিস্ট নাই, এক্সরে মেশিন আছে- রেডিওলজিস্ট নাই। অপারেশন থিয়েটারে অজ্ঞান করা মেশিন আছে -অজ্ঞানবিদ নাই। ইউনিয়ন সাব সেন্টারের অবস্থা গেরস্থের গো-শালার চেয়েও ভগ্ন। বস্তুত সেখানে কোন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাই নাই।

রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক সৃষ্ট উপজেলা পর্যায়ের এ ভয়াবহ চালচিত্র তাদের -কে বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না। বিএমএ তার অবস্থান থেকে এর আমূল পরিবর্তনের জন্য দৃঢ় তার সাথে কথা বলবে।

*চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারকে বাস্তব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হতে বাধ্য করতে হবে। রাষ্ট্রকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, আক্রমণকারী সন্ত্রাসী যে মাত্রায় অপরাধী , চিকিৎসককে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ সমদোষী এবং এ নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে তাদের কোন জবাবদিহিতা নাই। জরুরিভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা স্বাস্থ্য-পুলিশ গঠন করে অবশ্যই হাসপাতাল বা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ।
*কেবল আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নয়, সুষ্ঠু ও কার্যকর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিরাপত্তার পূর্বশর্ত। সংবাদ সম্মেলনে সরকারকে হুশিয়ার করে দিতে হবে, রোগী ও স্বজনদের অসন্তুষ্টির কারণে চিকিৎসক লাঞ্ছিত হলে, তাৎক্ষনিকভাবে চিকিৎসকরা কর্মস্থল থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিবে।

*রোগীর তুলনায় চিকিৎসক, নার্স , ওয়ার্ডবয়, আয়া, পরিচ্ছন্ন কর্মীর সংখ্যা কম হওয়ার কারণে চিকিৎসা ও সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে রোগীদের অসন্তুষ্টি ও ক্ষোভ রোগীর স্বজনরা প্রশমন করে চিকিৎসককে লাঞ্ছিত করে। চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে এ আক্রমণাত্মক ঝুঁকির পরিসমাপ্তি টানতে হবে।

*ইউনিয়ন সাব-সেন্টার থেকে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত সকল হাসপাতালের অবকাঠামো রোগী অবস্থানের জন্য অপ্রতুল। এ অব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সৃষ্ট। রাষ্ট্রকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, শয্যা সংখ্যার বাইরে কোন রোগী ভর্তি- চিকিৎসকদের নিরাপত্তার কারণে বিএমএ মেনে নেবে না । অচিরেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলে, শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করে এ সংকটের অবসান রাষ্ট্রকে করতে হবে।

*বিএমএ-কে আরও কঠোর অবস্থান থেকে ঘোষণা করতে হবে, সমগ্র দেশে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়-বাণিজ্য ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এরূপ অপ্রয়োজনীয় যন্ত্র ক্রয়ে বাধ্য করা হয়। যন্ত্র ক্রয় বা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে কঠোর শাস্তি নেমে আসে চিকিৎসকের উপর।(পাবনার সিভিল সার্জন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ)। মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় মুনাফার লোভে ৩/৪ গুন বেশী মূল্যে ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয় করে বাজেট নিঃশেষ হয়ে যায় এবং অল্পদিনে যন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়লে চিকিৎসকরা নাগরিকদের রোষানলে পড়ে , লাঞ্ছিত হয়। এ দুর্বৃত্তায়িত কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করে দিতে হবে।

*কোন হাসপাতালে ঔষধ সহ চিকিৎসার উপকরণ যথেষ্ট নয়। ঔষধ ক্রয়ের জন্য রোগীর স্বজনদের স্লিপ দিলেই চিকিৎসকরা লাঞ্ছিত হয়, অপমানিত হয়। বহির্বিভাগে রোগীদের উপস্থিতির আনুপাতিক হারে কোন ঔষধের সরবরাহ নাই। আন্তঃবিভাগের শয্যা সংখ্যা ও রোগী অবস্থানের আনুপাতিক-হারে ঔষধ বরাদ্দ হয়। সে অপ্রতুল ঔষধ থেকে বহির্বিভাগে রোগীদের ঔষধ প্রদান করা হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।

এ অমানবিক কার্যক্রমের জন্য মন্ত্রণালয়ের কোন জবাবদিহিতা নাই, অথচ অপ্রতুল ঔষধের রোষানল চিকিৎসকদের পোহাতে হয়। সংবাদ সম্মেলনে তর্জনী উঁচু করে রাষ্ট্রকে সাবধান করে দিতে হবে, ‘রোগীদের স্বার্থে ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে, চিকিৎসকদের দিয়ে ‘এ কাজ আর করানো যাবে না। যতটুকু ঔষধ ও উপকরণ তত-সংখ্যক রোগী- ততটুকুই চিকিৎসা’।

 

* তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কোথাও যন্ত্র আছে ,টেকনোলজিস্ট নাই। আবার টেকনোলজিস্ট আছে , বিশেষজ্ঞ নাই। কোথাও আবার বিশেষজ্ঞ , টেকনোলজিস্ট আছে, যন্ত্র নষ্ট। মেরামত করার কোন ব্যবস্থা নাই, পড়ে থাকে অনন্তকাল ধরে। এ কারণে রোগীকে হাসপাতালের বাইরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হলে চিকিৎসকের উপর অবিশ্বাস, অসন্তুষ্টির জন্ম হয় এবং প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত অপদস্থ হতে হয়। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের এ অব্যবস্থার কারণে ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে একটি অপরাধী দালাল চক্র গড়ে উঠেছে। যার পুরো দায় পড়ে চিকিৎসকদের উপর । এদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ছাড়া চিকিৎসকদের আর কোন উপায় নাই। চিকিৎসকদের এ অসহায়ত্বের অবসানকল্পে বিএমএ-কে কঠোর অবস্থানে থেকে কথা বলতে হবে সংবাদ সম্মেলনে।

 

*স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ক্রমান্বয়ে আমলাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। জনপ্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ তো আছেই, পদন্নোতির ক্ষেত্রেও চিকিৎসকরা আমলাদের সাথে বৈষম্যের শিকার। সিনিয়র প্রফেসর, কনসালটেন্টদের মন্ত্রণালয়ে যেভাবে অমর্যাদায় গ্রহণ করা হয়, তাতে মনিব-চাকরের দৃশ্যই ফুটে উঠে। বিএমএ-কে স্পষ্ট করে উচ্চারণ করতে হবে, চিকিৎসকরা কখনই জনপ্রশাসনের খবরদারী মেনে নিতে পারে না/মানবে না এবং আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর করতে হবে।

 

*বিএমএ-কে শক্তভাবে বলতে হবে , এ ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার অবসানকল্পে “কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয়”-এর বিকল্প নাই। রাষ্ট্রকে অবশ্যই এটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় আমলার অনুপ্রবেশের প্রয়োজনে যে বিভাজন , তার সব একীভূত করে চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় জনপ্রশাসনের কোন আমলা থাকতে পারবে না’ -এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে হবে এবং ৮ম পে স্কেল সহ পদমর্যাদা ও পদন্নোতির সকল অসঙ্গতির বিলুপ্তি ঘটাতে হবে।

 

বঞ্চনার এক মহাসমুদ্র হল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। রাষ্ট্রের কাছে সমাধানের সঞ্চালনার তীর ছুঁড়ে দিয়েই বিএমএ-কে সংবাদ সম্মেলনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।
_____________________

ডা. বাহারুল আলম। লোকসেবী পেশাজীবী নেতা ও চিকিৎসক। সহসভাপতি, খুলনা বিএমএ।

আপনার মতামত দিন:


নির্বাচন এর জনপ্রিয়