Ameen Qudir

Published:
2018-11-24 22:47:13 BdST

মানসিক রোগগুলো কেমন রহস্যময়


 

 

ডা. মো. সাঈদ এনাম
____________________________

সেল্ফি শব্দের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। নিজেই নিজের ছবি তুলাকে সেল্ফি বলে। শখের বশে অনেকে সেল্ফি তুলেন। আনন্দঘন মুহুর্তটাকে ধরে রাখেন ক্যামেরায়, স্টিল ছবির মাধ্যমে, শেয়ার করেন ফেইসবুকে নিকট বন্ধুদের সাথে। এতে মন্দ ভাবার তেমন কিছু নেই। তবে 'সেল্ফ টক' বা 'একা একা কথা বলা' এই শব্দটার সাথে আমরা তেমন কেউ পরিচিত নই। কিন্তু এ রকম ঘটনা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি।

এতক্ষনে যারা একটু নড়ে চড়ে বসেছেন তাদের জন্যে একটু খুলেই বলি, 'সেল্ফ টক' আসলে কি? একা একা কথা বলা বা নিজে নিজে কথা বলা কে বলে সেল্ফ টক। মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়া বা ঘোরতর মানসিক রোগে রোগীরা এমন করেন। তারা একা একা কথা বলতে থাকেন অনবরত। তাদের কথা গুলোর মধ্যে তেমন একটা সামঞ্জস্যতা নেই। এ দেখে কারো মনে হয়তো উয়তো উঁকিঝুঁকি দেয়, তারা কেনো এমন করেন!

একা একা কথা বলা টুকটাক আমরা মাঝেমধ্যে অনেকেই হঠাৎ বলি উঠি। রাগে দুখে ক্ষোভে আমরা অনেম সময় একা একা বলে ফেলি, চিৎকার করে উঠি। শিশুরাও খেলতে গিয়ে খেলনার সাথে বা তার পুতুলের সাথে একা একা কথা বলে অনবরত । তবে এসব কথা গুলোর মধ্যে পারিপার্শ্বিক সামঞ্জস্যতা আছে। সুতরাং এটাকে মানসিক রোগের লক্ষন বলা যাবেনা।

বাংলাদেশে ঘোরতর মানসিক রোগীদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনবরত কথা বলতে দেখা যায়। এ ধরনের রোগীদের তাচ্ছিল্য করে পাগল ডাকা হয়। মুলত এ সম্পর্কে আমরা জানিনা বলেই এমন ডাকি।

আসুন জেনে নেই, কেনো মানসিক রোগীরা একা একা কথা বলতে থাকে?

মানসিক রোগীরা এমন করেন কারন তাদের অডিটরি হ্যালুসিনেশন। অডিটরি হ্যালুসিনেশন হলো অবাস্তব কিছু শুনতে পাওয়া। অর্থাৎ অস্তিত্ব নেই এমন কিছুর শোনা। ব্যাপার টা স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে অনেক সময় হতে পারে।

এই যেমন ধরুন আপনি গভীর চিন্তায় মগ্ন, হঠাৎ শুনলেন কে আপনার নাম ধরে ডাকলো, কিংবা কিসের আওয়াজ জানি কানে আসলো। আপনি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন কেউ নেই। এটি শ্রুতি ভ্রম। মাঝেমধ্যে গভীর রাতে এরকম আওয়াজে অনেকে ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠেন কে... কে... বলে। ভুত ভুত বলে দৌড় দিয়ে হাত পা ভাংগেন নিজের বা অন্য কারো। দিনে গল্প করে বেড়ান, কাল রাতে ভুত ডেকে তাড়া দিয়েছে।
আসলে এটা অকস্মাৎ অডিটরি হ্যালুসিনেশনের ফলেই হয়। অঘুমা রোগ, দুশ্চিন্তা, টেনশন, ডিপ্রেশন, এনজাইটি এসবে এরকম হতে পারে।

কিন্তু মানসিক রুগীদের ক্ষেত্রে এই অডিটরি হ্যালুসিনেশন অনবরত হতে থাকে। তারা অনবরত শুনতে থাকেন, তাদের কেউ ডাকছে, তাদের সাথে কেউ কথা বলছে, কিংবা তাদের নিয়ে কেউ কথা বলছে। তাই তারা এসব কথার উত্তর দিতে থাকেন অনবরত । এসব উত্তর আর কথাবার্তা সাধারণত অগোছালো অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিংবা টুকটাক সামঞ্জস্যতাপূর্ন।

যারা মদ পান করেন, গাঁজা, হিরোইন, ইয়াবা সেবন করেন তাদেরও অনেক সময় অডিটরি হ্যালুসিনেশন হয়।

হ্যালুসিনেশন এর প্রকারভেদ:

হ্যালুসিনেশন অনেক ধরনের হয়ে থাকে। অবাস্তব কিছু দেখাও হ্যালুসিনেশন। যেমন দেখলেন আপনার সামনে হঠাৎ মানুষের এক ছায়া এসে দাড়িয়েছে। সে কথা বলছে, ইশারা করছে। একে ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন বলে। কিংবা দেখলেন আপনার মৃত মা বাবা, দাদা দাদী বা মৃত কোন প্রিয়জন আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। অথবা এমন ও হতে পারে আপনি দেখলেন, আপনি প্যারিসের রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বাদাম বিক্রি করছেন। দৃষ্টির সীমানার বাইরে কিছু দেখা সাইকিয়াট্রিস্ট দের ভাষায় বলে এক্সট্রা ক্যাম্পেইন হ্যালুসিনেশন।

আবার রিফ্লেক্স হ্যালুসিনেশন বলে ইন্টারেস্টিং এক রকম হ্যালুসিনেশন হয় মানসিক রোগীদের। এটা হলো চোখের সামনে লাল নীল রঙ এর আলো বা কিছু একটা ভাসলো ওমনি কানের মধ্যে ভেসে আসলো মিউজিক।

নিজেই নিজের দেহকে সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পাওয়াকে বলে অটোস্কোপিক হ্যালুসিনেশন। এগুলো সকলই ঘোরতর মানসিক রোগে হয়। তবে ডিপ্রেশন, এনজাইটি, মানসিক চাপ, অঘুমা এসবেও হতে পারে।

ডিমেনসিয়া বা পারকিনসন রোগেও এমন হতে পারে।
যেমন অনেক সময় ডিমেনসিয়ার পেশেন্ট এসে বলেন, কাল রাতে আমি আমার বড় ছেলেকে ঘরে ঘুরতে ফিরতে দেখলাম। অথচ তার বড় ছেলে হয়তো অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। ডিমেনশিয়া আক্রান্তরা সাধারণত ঘরের বয়োবৃদ্ধ মুরুব্বী ষাট পঁয়ষট্টি বয়সের উর্ধ্বে হন।
উনাদের এমন আচরণ আর কথা বার্তায় অনেকে অনেক সময় ভুল করে তাদের পাগল হয়ে গেছেন ভাবেন বা ভীমরতি রগে পেয়েছে ভাবেন । ডিমেনসিয়াতে এটা হয় কারন তাদের হ্যালুসিনেশন হয়। এমন কি ডিমেনসিয়া রোগে অনেক সময় ডিলিউসন হয়। ডিলিউসন হলো ভ্রান্ত বিশ্বাস। তারা অনেক সময় উলটো পালটা কথা বলেন, কাজকর্ম করেন বসেন, সন্দেহ করেন।

পারসিকিউটরি ডিলিউসন এর জন্যে ডিমেনসিয়া আক্রান্ত পরিবারের বয়োবৃদ্ধরা অনেক সময় বলেন, তার সকল সম্পত্তি তারই ছেলে মেয়েরা আত্মসাৎ করতে চাচ্ছে, এমন কি তাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছেন।

একবার এক ডিমেনসিয়া পেশেন্ট কে তার ছেলেরা অনেকটা বেঁধে জোর করে নিয়ে আসলেন আমার চেম্বারে। বললেন, 'বাবা পাগল হয়ে গেছেন, ভীমরতি তে পেয়েছে'। তিনি নাকি ছেলের বউকে জড়িয়ে ধরেছেন।

আসলে বৃদ্ধা ছিলেন ডিমেনসিয়ার পেশেন্ট। জিগ্যেস করায় তিনি ঘটনার তেমন কিছুই তিনি মনে করতে পারলেন না। 'লস অব ইনহিবিশন' এর জন্যে তিনি এমনটি করেছেন। নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে অপ্রীতিকর কোন আচরন করাই লস অব ইনহিবিশন। সাধারণত ফ্রন্টো-টেমপোরাল টাইপের ডিমেনসিয়াতে ব্রেইনের ফ্রন্টাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে এমন হয়।

হ্যালুসিনেওশন কেনো হয়?

মানসিক রোগ বা স্কিজোফ্রেনিয়াতে অনবরত হ্যালুসিনেশন হয় কারন ব্রেইনের কোথাও কোথাও অতি ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিশন আবার কোথাও কোথাও অতিরিক্ত ডোপামিন রিসেপ্টরের উপস্থিতির জন্যে। এ নিয়ন্ত্রণে সাইকিয়াট্রিস্ট রা ডোপামিন রিসেপ্টর ব্লকার ঔষধ দেন। ফার্মেসিতে হেলোপেরিডল, ওলানজাপাইন, রেসপেরিডন, কিউটিয়াপাইন, ক্লোজাপিন ইত্যাদি অনেক রকম ডোপামিন রিসেপ্টর ব্লকার পাওয়া যায়। এ ওষুধ সেবনে অবিশ্বাস্য রকম ভাবে হ্যালুসিনেশন বন্ধ হয়ে যায়। রোগীদের একাএকা কথা বলা কমে আসে। এক সময় সে সাধারণ মানুষের মতই সুস্থ হয়ে উঠে।

বিষয়টি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর চেম্বারে কিংবা একটি মানসিক রোগ হাসপাতালে গেলে অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করা যাবে। যে রোগী টি এক মাস আগেও অসংলগ্ন কথা বার্তা আর আচারন নিয়ে আসছিলো, যাকে অনেকটা ধরে বেঁধে মেরে চেম্বারে আনা হয়েছিলো, এক মাস পর সে কি সুন্দর সুস্থ..! দিব্যি সবার সাথে চলাফেরা করছে, গালগল্প করছে, কাজকর্ম করছে। হাসছে..., কি সুন্দর নিষ্পাপ তাঁর হাসি।

মানসিক রোগ গুলো সত্যিই অদ্ভুত। হাত পা, চোখ নাক কান সবই ঠিক আছে কিন্তু কোথায় যেনো একটু গরমিল। যার জন্যে সবকিছুতে গরমিল।

আল্লাহ তায়লা অসীম ক্ষমতাবান। তিনি কিনা করে দেখাতে পারেন।
_________________________________

ডা. মো. সাঈদ এনাম

সাইকিয়াট্রিস্ট
ডি এম সি, কে-৫২

মেম্বার, ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন

মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন

লাইফ মেম্বার, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ওব সাইকিয়াট্রিস্ট।

আপনার মতামত দিন:


প্রেসক্রিপশন এর জনপ্রিয়