ডা. সোহানা শারমিন

Published:
2024-11-03 18:50:54 BdST

আমাদের শিক্ষক এফ করিম স্যার ও পিনপতন নীরবতা


 

ডাঃ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট,এসিস্টেন্ট প্রফেসর , ডালহাউসী ইউনিভার্সিটি, হ্যালিফ্যাক্স ,কানাডা

----------------------------

আমাদের সময়কার সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন সার্জারীর শিক্ষকছিলেন করিম স্যার।অনেকেই আড়ালে উনার নামের আগে জুড়ে দিতেন টাইগার অথবা বাংলার বাঘ।স্যারের উপস্থিতি ছিল কলেজের করিডোর,লেকচার গ্যালারি, হাসপাতাল এর ওয়ার্ড ও অপারেশন থিয়েটার এ। যখন ই স্যার আসতেন সাথে সাথে চারিদিকে কেমন যেন একটা পিনপতন নীরবতা সৃস্টি হয়ে যেত।এই পিনপতন নীরবতার একটি ক্লিনিক্যাল ভ্যালু ছিল। স্যারের প্রয়ানে কোন এক সিনিয়র ভাই এর কাছে শুনা একটি গল্প শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না।
করিম স্যার ছিলেন রাশভারী টাইপের মানুষ।একদিন সিএমসির অপারেশন থিয়েটার এ একজন আন্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা (Intestinal Obstruction)এর রোগীকে সার্জারি করার জন্য নিয়ে আসা হল।যথারীতি এনেস্থেসিয়া দেওয়ার পর স্যারের সিএ রোগীকে ড্রাপিং করেন। তখন করিম স্যার হ্যান্ড ওয়াশ নিয়ে অপারেশন থিয়েটার এ ঢুকে গাউন পড়ছেন।স্যার রুমে ঢুকার সাথে সাথে সবাই নিশ্চুপ।চারিদিকে পিনপতন নীরবতা।স্যার গ্লাভস পড়লেন। রোগীর পাশে দাঁড়ালেন। হাতে স্কালপেল নিলেন ইনসিশন দেওয়ার জন্য। চারিদিকে সুনসান নীরবতার মাঝে হঠাৎ “পিঁপ”করে একটা শব্দ হলো। স্যার স্কালপেল নার্স কে দিয়ে দিলেন, গ্লাভস খুলে ফেল্লেন।রুমের সবাই অবাক দৃস্টিতে তাকিয়ে রইলেন। স্যার বললেন অপারেশন ক্যানসেল। অবস্ট্রাকশন রিলিজিড।রোগীকে ওয়ার্ড এ পাঠিয়ে দাও।
আমরা সবই ডাক্তারদের Clinical আই এর গল্প শুনেছি।কিন্তু Clinical ইয়ার থাকলে যে ডায়াগনোসিস করা যায় সেটা করিম স্যার এই ঘটনা থেকে প্রমানিত হয়। পিন পতন নীরবতায় ডায়াগনোসিস বদলে গেল,রোগী মেজর অপারেশন থেকে বাঁচল।এই কিংবদন্তী সার্জন চলে গেলেন সুনসান নীরবতার জগতে, এই নভেম্বর মাসের দুই তারিখে।আল্লাহ উনাকে বেহেস্ত নসীব করুক। আমীন।

স্যার কর্মজীবনে চট্টগ্রাম এর জনগনকে নিরলস চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন,অনেক অনেক ডাক্তারদের কে প্রশিক্ষিত করেছেন এবং হাজার হাজার মেডিকেল ছাত্রদের পড়িয়েছেন।উনার অনেক ছাত্র ছাত্রী দেশে বিদেশে সুনামের সাথে এখনো চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

করিম স্যার সরকারী চাকুরী থেকে অবসর এর পর চট্টগ্রাম এর মানুষের সেবার জন্য নিজের সময় ব্যায় করেছেন।চট্টগ্রাম এর মা ও শিশু হাসপাতাল প্রতিস্ঠা করার জন্য, এই হাসপাতাল এর জন্মলগ্ন থেকেই স্যার কাজ করে গেছেন। আজকের মা ও শিশু হাসপাতাল একটি বিশাল ইনস্টিটিউট এ পরিনত হয়েছে।এখানে একটি মেডিক্যাল কলেজ ও পরিপূর্ন হাসপাতাল হয়েছে। সম্প্রতি মা ও শিশু হাসপাতাল এ ক্যানসার বিভাগ এর কাজও শুরু হয়েছে পুরোদমে।অচিরেই এখানে অত্যাধুনিক রেডিয়েশন মেশিন লিনিয়র এক্সেলেটর চালু হবে।

একই সময়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্তরেও ডিভিশনাল ক্যানসার সেন্টার এর কাজ চলছে। এখানেও অত্যাধুনিক রেডিয়েশন মেশিন বসানো হবে অতিসত্তর।

আমরা জানি ইদানীং স্তন ক্যানসার এ আক্রান্ত মহিলার সংখ্যা সারা দেশে ও চট্টগ্রামে দিন দিন বাড়ছে।কিন্তু চট্টগ্রাম বিভাগ এর লোকসংখ্যা অনুযায়ী ব্রেস্ট সার্জন ( ব্রেস্ট কনজারভিং সার্জারি এবং সেন্টিনাল নোড বায়অপসি যিনি করতে পারেন)এর সংখ্যা খুবই কম।এই সার্জিক্যাল টেকনিক এর মাধ্যমে পুরো স্তন না কেটে শুধুমাত্র টিউমার আক্রান্ত অংশটুকু ফেলে দেওয়া হয়। যার ফলে স্তন এর বেশীরভাগ অংশ রক্ষা করা যায়। এই মূহুর্তে চট্টগ্রাম এ অন্তত ৪-৫ জন ব্রেস্ট সার্জন দরকার।কিন্তু দুঃখজনক হলো কোন “ব্রেস্ট সার্জারি ফেলোশীপ”এখনো আমাদের দেশে শুরু হয়নি।
করিম স্যার এর স্মৃতিকে চিরজাগরুক করে রাখতে আমি “Professor Dr. F Karim Breast Surgery Fellowship”শুরু করার প্রস্তাব করছি।আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অনেক সেন্টারেই “ব্রেস্ট সার্জারি ফেলোশীপ” প্রোগ্রাম চলমান আছে।আমাদের তরুন সার্জনদেরকে কমপক্ষে ৩মাস থেকে ৬ মাসের প্রশিক্ষন এর জন্য ভারত অথবা অন্য কোন দেশে পাঠাতে পারলে ভাল হয়।

এই জন্য আমাদের সবার সম্মিলিত কন্ট্রিবিউশন এর মাধ্যমে একটি ট্রাস্ট তহবিল বা এনডাউমেন্ট ফান্ড গঠন করা যেতে পারে।এই ধরনের ফান্ড গঠন এর উদৌগটা সাধারনত পরিবার এর পক্ষ থেকে করতে পারলে ভাল হয়।পরবর্তীতে যে যার সাধ্যমতো ডেনেশন ফান্ড এ দিতে পারেন।ফান্ড এর পরিমান এমন হতে হবে যার লভ্যাংশ দিয়ে ৪-৫ জন সার্জন কে প্রতি ২-৩ বৎসর পর পর ব্রেস্ট কনজারভিং সার্জারি জন্য ফেলোশীপ দেওয়া যায়।
বাংলাদেশে এনডাউমেন্ট ফান্ড (Endowment Fund )কিভাবে সেটআপ করা যায় সেটা চট্টগ্রাম এর ইনভেস্টমেন্ট এক্সপার্টরা ভালো বলতে পারবেন।সবাই সম্মত হলে একটি সমাধান আশা করি বের হয়ে আসবে। তবে আমি মনে করি এই ব্যাপারে সবার আগে উদৌগ নিতে পারেন স্যার এর সুযোগ্য সন্তানেরা।

এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ এ্যালমনাই ও চট্টগ্রাম এর বিজিনেস কমিউনিটির দৃস্টি আকর্ষন করছি।

ব্রেস্ট কনজারভিং সার্জারী চট্টগ্রামে পুরোদমে শুরু হলে , চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্যানসার সেন্টার এবং মা ও শিশু হাসপাতাল এর লিনিয়র এক্সেলেরেটর মেশিন গুলো স্তন ক্যানসার এ আক্রান্ত রোগীদেরকে রেডিয়েশন থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করতে পারবে।

আসুন সবাই মিলে করিম স্যার কাজ কে স্মরনীয় করে রাখি এবং স্তন ক্যানসার এ আক্রান্ত রোগীদের সম্পূর্ণ চিকিৎসা সেবা যেন চট্টগ্রাম এর মাটিতে দেয়া সম্ভব হয় সেই ব্যাবস্থা করি।

 

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়