ডেস্ক
Published:2024-03-28 19:21:56 BdST
বাংলাদেশ দন্ডবিধি অনুযায়ী চিকিৎসকদের দায় মুক্তি
ডা. আজাদ হাসান
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য প্রশাসন বিশেষজ্ঞ লেখক
___________
সাম্প্রতিক সময়ে কর্মক্ষেত্রে রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার সময় কিংবা চিকিৎসাধীন রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সারা দেশে চিকিৎসকেরা হর হামেশাই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
এমন কি, যাঁরা সহিংসতার শিকার হয়েছেন তাঁদের মধ্যে যেমন আছেন অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, কনসালট্যান্ট, জুনিয়র কনসালট্যান্ট তেমনি রয়েছেন - উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা, ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার, মেডিকেল অফিসার, ইনডোর মেডিকেল অফিসার, ইন্টার্ন ডক্টর, এবং ডেন্টাল সার্জন। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়েছেন জরুরী বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক (ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসাররা)।
তাছাড়া নারী চিকিৎসকরাও বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের সহিংসতা হতে মুক্ত নন, তাই তারাও এখন নিরাপত্তা হীনতায় ভোগেন। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে নারীরা ভবিষ্যতে চিকিৎসা পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।
এতে করে চিকিৎসকদের মাঝে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা এবং ভীতির সঞ্চার হয়েছে। এ হেন অপতৎপরতার পরও রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততার ফলশ্রুতিতে চিকিৎসকের মাঝে এক ধরনের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে।
বাংলাদেশ দন্ডবিধি অনুযায়ী চিকিৎসকদের দায় মুক্তি দেয়া থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এ আইনটি মানা হচ্ছে না ফলশ্রুতিতে চিকিৎসকদের মাঝে এ বিষয় নিয়ে রয়েছে চরম ক্ষোভ এবং হতাশা।
★ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন স্থানে "ক্রিটিক্যালি সিক" বা "সংকটাপন্ন রোগীর" চিকিৎসা প্রদান করার পরও রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাসপাতাল ভাংচুর করা, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে শারীরিক ভাবে নাজেহাল বা অপদস্ত করা হয়েছে।
★ তা ছাড়া কোথাও কোথাও আইন শৃংখলা বাহিনী কর্তৃক অতি উৎসাহী হয়ে আইন না মেনে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে নিয়ম বহির্ভূতভাবে এরেষ্ট করা হয়েছে। ফলে, চিকিৎসকদের মাঝে এক ধরনের নিরাপত্তা হীনতা এবং চাপা ক্ষোভ বিরাজমান।
এবার তা হলে এ রকম পরিস্থিতিতে আইনের ধারায় কি বলা হয়েছে সেটা আলোচনা করা যাক।
অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রসংগে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩০০ থেকে ৩০৩ ধারায় মার্ডার সম্পর্কিত ধারায় উল্লেখ করা হয়েছেঃ
"কাউকে হত্যার উদ্যেশ্যে সরাসরি আঘাত করে হত্যা করাই হল "মার্ডার"।
দন্ডবিধির ধারা ৩০৪ঃ
Culpable Homicide: "যে ব্যক্তি মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়ে বা এমন শারীরিক আঘাত করার অভিপ্রায়ে মৃত্যু ঘটায় বা মৃত্যু ঘটাতে পারে এই জ্ঞানে যে সে এমন কাজ করে মৃত্যু ঘটাতে পারে, সে অপরাধী অপরাধ করে, তাহাই Culpable Homicide। অর্থাৎ যাকে সরাসরি মার্ডার বলা যাচ্ছে না কিন্তু মৃত্যু ঘটানোর উদ্যেশ্যে কোন কাজ করা হয় এবং মৃত্যু ঘটে। লক্ষ্য করুন, এখানে অসৎ উদ্যেশ্যের অভিযোগ বিদ্যমান থাকবে।
উপধারা ৩০৪ (ক): Negligence. সংশোধনী করে এটি জুড়ে দেয়া হয়েছে। তবে এই ধারায় মামলা করতে হলে অবশ্যই বিএমডিসি অনুমোদিত দক্ষ মেডিকেল বোর্ডের রেপোর্ট লাগবে। অন্যথায় এই ধারা প্রযোজ্য হবে না।
প্রসংগত উল্লেখ্য, মেডিকো-লিগ্যাল কেস এবং ক্রিমিনাল কেস কখনো এক হতে পারে না।
কারণ, ক্রিমিনাল কেসের ক্ষেত্রে ~
(১) যে বা যিনি ক্রাইম করেন তার ইনটেনশন থাকে ভিকটিমকে হত্যা করার।
(২) তিনি পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক ঠান্ডা মাথায় খুনের পরিকল্পনা করেন এবং সময় এবং সুযোগ মত তার বাস্তবায়ন করে থাকেন।
(৩) তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে অথবা অন্যের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে হত্যা কান্ডটি সংগঠিত করে থাকেন।
পক্ষান্তরে একজন চিকিৎসকের কাজের ধরণ/ন্যাচার হলোঃ
(১) একজন চিকিৎসকের ইনটেনশন থাকে তাঁর চিকিৎসাধীন রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা।
(২) একজন চিকিৎসক তার পেশাগত জ্ঞান, প্রশিক্ষণ, পেশাগত অভিজ্ঞতা এবং পেশাগত স্কিলের সাহায্য তাঁর রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ক্রিমিনাল অফেন্স /Culpable Homicide এবং মেডিকো-লিগ্যাল কেসের মাঝে "ক্লিয়ার কাট" (স্পষ্টতঃ) পার্থক্য রয়েছে। অতএব এই দু'টিকে কখনো একসাথে মিলিয়ে ফেলার অবকাশ নেই।
দন্ডবিধির ধারা ৮৮ঃ
ভাল উদ্যেশ্যে বা রোগ উপশমের উদ্যেশ্যে সম্মতিসহ কোন রোগীর অপারেশন করার সময় বা পরবর্তীতে যদি মৃত্যু ঘটে তবে সেটি অপরাধ হিসাবে গন্য করা যাইবে না।
দন্ডবিধির ধারা ৮৯ঃ
অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক বা মানসিক প্রতিবন্ধী কোন ব্যক্তি সম্মতি দিতে অসমর্থ হইলে এবং তাকে সুস্থ্য করার উদ্যেশ্যে (ভাল উদ্যেশ্যে) কোন অপারেশন করা হলে এবং সেটা করতে গিয়ে মৃত্যু ঘটলে তা কোন অপরাধ হিসাবে গন্য করা যাইবে না।
অর্থাৎ, ডাক্তাররা রোগীদের সুস্থ্য করার উদ্দেশ্যে সম্মতি নিয়ে অপারেশন করে থাকেন। এতে কোন ক্ষতি বা মৃত্যু হলে তা দন্ডবিধির ধারা ৮৮ ও ৮৯ দিয়ে চিকিৎসকদেরকে "দায় মুক্তি" প্রদান করা হয়েছে।
প্রসংগত উল্লেখ্য, উপধারা ৩০৪ (খ): উক্ত ধারাটি ড্রাইভিং এর কারনে মৃত্যু সম্পর্কিত।
দন্ডবিধির ধারা ৩০৪ (বি)- তে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয় আছে। প্রতিদিন সড়ক দূর্ঘটনায় কত প্রাণ যাচ্ছে এই । অথচ রহস্যজনক কারণে, উক্ত আইনে উল্লেখিত ধারা মতে ১ টি মামলা বা গ্রেফতারের ঘটনাও আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কারন কি?
অথচ দন্ডবিধির ধারা ৩০৪ কে বিকৃতভাবে অপব্যবহার করে ডাক্তারদের হয়রানী করার প্রকট প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা রীতিমতো অনভিপ্রেত এবং সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।
আর যদি এই ধারা প্রয়োগ করে কোন চিকিৎসককে এরেস্ট করতে হয়-সেক্ষেত্রে আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ মতামত লাগবে, এবং উপযুক্ত মেডিক্যাল বোর্ড কর্তৃক তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলেই কেবল এই ধারাটি প্রযোজ্য হবে। আর ধারা ৩০০-৩০৩ ব্যবহারের তো কোন প্রশ্নই আসে না।
বাংলাদেশ দন্ডবিধি: পেনাল কোড ১৮৬০, সেকশন ৮৮, ৮৯ ধারাঃ উক্ত ধারা মতে দেখা যাচ্ছে, আইনে বলা হয়েছে, "যদি কোন অসুস্থ রোগীকে ভাল করার উদ্যেশ্যে অপারেশন করা হয়, যার জন্য সেই রোগী বা রোগীর লোক লিখিত বা মৌখিক সম্মতি প্রদান করেছে এবং সেই অপারেশন করতে গিয়ে যদি কোন ক্ষতি বা মৃত্যু হয়, তবে তাকে অপরাধ বা মার্ডার হিসাবে গণ্য করা যাইবে না।"
অর্থাৎ রোগীর মৃত্যুর কারণে কোন তদন্ত ছাড়াই চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তারকে গ্রেফতার করার কোনো বিধান বাংলাদেশের আইনে নেই। তবে যদি উপযুক্ত তদন্ত বোর্ড কর্তৃক তদন্তের পরে প্রমাণিত হয় যে, উক্ত রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের দায়িত্ব অবহেলার কারণে বা ভুল চিকিৎসা প্রদানের কারণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে, তাহলে সেটা ‘প্রফেশনাল নেগলিজেন্স’।
তবে মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারেন। কোন মানুষই ভুলের উর্ধে নন। আর তাই কোন রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক যদি কোন রূপ দায়িত্বে অবহেলা কিংবা ভুল চিকিৎসা দিয়ে থাকেন বলে রোগীর আত্মীয়দের কাছে প্রতিয়মান হয়, সেক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ পার্টি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। সেটা বিচারের জন্যও দেশে প্রচলিত আইন বিদ্যমান আছে এবং সে আইন অনুযায়ী বিএমডিসি কর্তৃক বিচারের বিধান আছে। সে ক্ষেত্রে বিএমডিসির কাছে কমপ্লেইন করতে পারেন। অভিযোগ প্রাপ্তি সাপেক্ষে বিএমডিসির দায়িত্ব হলো, উপযুক্ত তদন্ত করে যাচাই করা যে এ ক্ষেত্রে আসলে কোনরূপ "প্রফেশনাল নেগলেজেন্সি" বা "ম্যালপ্রাকটিস" হয়েছে কিনা? এবং যদি তদন্তে কেউ দোষী প্রমাণিত হন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নিবেন।
কিন্তু তা না করে রোগীর মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসাবে নথিভুক্ত করা অন্যায়। ইচ্ছে করেই ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কাহিনী সংযোজন করে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা অন্যায্য এবং দূর্ভাগ্যজনক।
সম্প্রতি, দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যারা অন্যায়ভাবে চিকিৎসকদের গ্রেফতার করছে, তাদের বিরুদ্ধে অযোগ্যতার, অদক্ষতার, আইন না জানার বা উদ্দেশ্য মূলক ভাবে আইন না মানা, এমন কি মিথ্যা মামলা দায়ের করা এবং হয়রানী করা, এক ধরণের অন্যায় ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
সুতরাং দেশে চিকিৎসকদের জন্য নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করে হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র সমূহে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে আসুক এটাই সবার প্রত্যাশা।
★
আপনার মতামত দিন: