SAHA ANTAR

Published:
2021-12-18 23:51:42 BdST

কিংবদন্তি চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায়কে নিয়ে দু' দুটি বায়োপিক হচ্ছে


 

অন্তর সাহা কলকাতা / সংবাদ সংস্থা

দু’টি ছবি তৈরি হতে চলেছে বিধানচন্দ্র রায়কে নিয়ে।


২০২২ কি চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায়ের দখলে?

বৃহস্পতিবার এমনই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে দু’টি খবর। পশ্চিমবঙ্গের রূপকারকে নিয়ে দু'টো জীবনী চিত্র হতে চলেছে। একটির প্রযোজক এসভিএফ। অন্যটি রানা সরকার। স্বাভাবিক ভাবেই সিনে মহলের কৌতূহল, বিধান তা হলে কার?  যোগাযোগ হল রানার সঙ্গে। রানার জবাব বিধানচন্দ্র গোটা বাংলার, বাঙালির। পাশাপাশি এও দাবি তাঁর, চলতি বছরের জুলাই মাসে তিনিই প্রথম ফেসবুকে ঘোষণা করেছিলেন, কেউ পশ্চিমবঙ্গের এই চিকিৎসককে নিয়ে জীবনীচিত্রর কথা ভাবেন না! কেবল তিনিই ভেবেছেন। রানাই বিধানচন্দ্র রায়কে নিয়ে ছবি বানাবেন।


এ বার বছর শেষে এসভিএফের ঘোষণা, বিধানচন্দ্র রায়কে নিয়ে ছবি বানাতে চলেছে তারাও। অর্থাৎ, রানার এই ভাবনায় ভাগ বসাতে চলেছে প্রযোজনা সংস্থা।


শুধু ছবির নাম ঘোষণা করেই থামেনি শহরের প্রথম সারির প্রযোজনা সংস্থা। জানিয়েছে, বিধান চন্দ্র রায় এবং চিকিৎসক নীলরতন সরকারের মেয়ে কল্যাণী সরকারের প্রেম তাদের ছবির মূল বিষয়। এই ছবিতে থাকবে কলকাতার উপকণ্ঠে নদিয়া জেলায় গড়ে ওঠা কল্যাণী উপনগরীর কথাও। যা বিধানচন্দ্র রায় তৈরি করেছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য। তবে কবে থেকে শ্যুটিং, কাকে মুখ্য চরিত্রে দেখা যাবে, পরিচালনাই বা কে করবেন? সে কথা সংস্থা এখনও জানায়নি।

এখানেই বাজি মেরেছেন রানা। তাঁর কথায়, ‘‘বিধানচন্দ্র রায় বাঙালির কাছে আবেগ। তাই শুধুই তাঁর প্রেম জীবন নিয়ে ছবি বানানো উচিত নয় বলেই মনে করি। সেই জায়গা থেকেই আমি কোনও সামান্য নয়, বিধান রায়ের উপরে প্রামাণ্য ছবি বানাব।’’ একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন ছবির অভিনেতা, পরিচালকের নামও। রানার ছবিতে ‘বিধানচন্দ্র রায়’ অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ‘কল্যাণী’ প্রিয়াঙ্কা সরকার। ছবিটি পরিচালনা করবেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। প্রযোজক জানিয়েছেন, ‘লহ গৌরাঙ্গের নাম’-এর শ্যুট শেষ হলেই সৃজিত শুরু করবেন জীবনীচিত্রের শ্যুট।


এক ব্যক্তিকে নিয়ে দুই প্রযোজনা সংস্থার টানাটানি। টক্কর? মানতে নারাজ রানা। তাঁর যুক্তি, একে ‘সুস্থ প্রতিযোগিতা’র তকমা দেওয়াই ভাল। তিনি লিখেওছেন সে কথা, ‘শ্রীকান্তদা (মোহতা) ও মণিদা (মহেন্দ্র সোনি) আমাদের বন্ধু। তাই এই কাজ নিয়ে এসভিএফের সঙ্গে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। বরং একটা প্রতিযোগিতা থাকুক, কে, কতটা বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে।’

প্রশ্ন তবু রয়েই যাচ্ছে, বন্ধুত্বের খাতিরে অনির্বাণকে রানার ছবিতে অভিনয়ের অনুমতি দেবে এসভিএফ? জবাব দিয়েছেন রানা। বলেছেন, ‘‘এর উত্তর দেবে সময়। তবে আমরা জানতাম না, অন্য প্রযোজনা সংস্থাও একই বিষয় নিয়ে ছবি বানাতে চলেছে। তাই প্রথম থেকেই আমাদের পছন্দ অনির্বাণ। পরে এই নিয়ে কোনও সমস্যা তৈরি হলে তখন আমাদেরও সেই মতো হয়তো ভাবনায় বদল আসবে।’’

কেন বিধান অনির্বাণ কিংবদন্তি 


-ডা. সুব্রত ঘোষ এর লেখা য় বিস্তারিত তথ্য

ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। চিকিৎসক রূপে তিনি ছিলেন ধন্বন্তরি। এই কিংবদন্তী চিকিৎসক শিক্ষাবিদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও রাজনীতিবিদ্-ও ছিলেন। বাংলার রাজনীতির এক টালমাটাল সময়ে তিনি টানা ১৪বছর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীত্ব করেছিলেন। প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষের পর তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গকে নবরূপে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ১৯৬১ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান “ভারতরত্নে” ভূষিত হন।

জন্ম ও বংশপরিচয়

বিহার রাজ্যের পাটনার বাঁকিপুরে ১৮৮২এর ১লা জুলাই বিধান চন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা প্রকাশ চন্দ্র রায় সরকারি কর্মচারি ছিলেন। মাতার নাম অঘোরকামিনী দেবী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবথেকে ছোটো ছিলেন বিধানচন্দ্র। পিতা প্রকাশ চন্দ্র ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত ছিলেন।

শিক্ষা ও যৌবন

স্থানীয় গ্রাম্য পাঠশালায় তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর পাটনার টি.কে. ঘোষ ইনস্টিটিউশন এবং পাটনা কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এরই মাঝে ১৮৯৬ এ প্রায় বিনা চিকিৎসায় মা’কে হারান তিনি। পরের বছরই তিনি এফ.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পাটনা কলেজে গণিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। ১৯০১ সালে গণিতে সাম্মানিক সহ বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা চলে আসেন। পিতার সামান্য মাইনের চাকরিতে সংসার কোনোরকমে চলত। প্রবল অর্থাভাবের মধ্যে দিয়েই পরাশোনা চালিয়ে গিয়েছেন বিধান চন্দ্র।

ডাক্তারি পড়বার আলাদা কোনো আগ্রহ ছিল না তাঁর। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ফর্মের জন্য আবেদন করেছিলেন। ডাক্তারির ফর্ম আগে আসায় আবেদন করে পূরণ করে পাঠিয়ে দিলেন। শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফর্ম যখন এলো, তখন তিনি ডাক্তারিতে ভর্তি হয়ে গেছেন।

দারিদ্র্যের কারণে ধনী রোগীর বাড়িতে মেল নার্স হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন অধ্যাপকরা। তখনকার দিনে বারো ঘণ্টার ডিউটিতে পারিশ্রমিক আট টাকা। প্র্যাকটিস জমাবার প্রথম পর্বে বিধান চন্দ্র কলকাতায় পার্ট টাইম ট্যাক্সি চালাতেন। জানা যায়, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এমবি পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন কিংবদন্তী এই চিকিৎসক। ১৯০৬ এ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এল এম এস এবং দু’বছর পর মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে এম ডি ডিগ্রি লাভ করেন।

এরপর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে মাত্র ১২০০ টাকা সম্বল করে ইংল্যান্ডে গিয়ে মাত্র দু’বছরের মধ্যে মেডিসিন ও সার্জারির চূড়ান্ত সম্মান এম আর সি পি এবং এফ আর সি এস প্রায় একসাথে অর্জন করেন। ১৯১১-এ দেশে ফিরে আসেন তিনি।

কর্মজীবন

১৯১২ থেকে ১৯১৯ কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে অ্যানাটমি বিভাগে শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি ডাক্তারি প্র্যাকটিস শুরু করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সদস্য, রয়্যাল সোসাইটি অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন ও আমেরিকান সোসাইটি অফ চেস্ট ফিজিশিয়ানের ফেলো নির্বাচিত হন। চিকিৎসায় অসামান্য দক্ষতার জন্য মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর প্রশস্তি ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। সাধারণ মানুষের সাথে সাথে তাঁর রোগীদের তালিকায় ছিলেন বিখ্যাত সব ব্যক্তিত্বরা।

চিকিৎসায় ধন্বন্তরি

জনশ্রুতি আছে, তিনি নাকি রোগীর মুখ দেখে তার রোগ নির্ণয় করতে পারতেন। ডাক্তারি পেশাকে কখনোই ব্যবসার চোখে দেখেননি তিনি। তাঁর অসামান্য কীর্তির এরকম অনেক উদাহরণ আছে। তাঁর রোগীর তালিকায় ছিলেন- দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মোতিলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধী, বল্লভ ভাই পাটেল, মৌলানা আজাদ, জওহরলাল ও তাঁর কন্যা
ইন্দিরা প্রমুখ।

তাঁর গুণের প্রশংসক ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এবং ব্রিটেনের প্রাইম মিনিস্টার ক্লেমেন্ট এটলি। মহাত্মা গান্ধীর অনশনের সময়ে প্রত্যেকবার বিধান চন্দ্র রায় পাশে ছিলেন চিকিৎসক হিসেবে। জওহরলাল নেহেরু ও তাঁর কন্যাকে অসুস্থতার সময়ে সেবা করে চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেছেন বিধান চন্দ্র। দেশের বাইরে প্রায় বার্মা থেকে বালুচিস্তান পর্যন্ত তাঁর ডাক্তারির পরিধি ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হঅয়ার পর প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে দু’ঘন্টা দুস্থ রোগীদের বিনামূল্যে দেখতেন, ওষুধ কেনার টাকা না থাকলে তিনি দিয়ে দিতেন।

 

বিধানচন্দ্র রায়ের পৈত্রিক স্মৃতি দর্শনে লেখক

রাজনীতি ও মুখ্যমন্ত্রিত্ব

দেশবন্ধুর উৎসাহে ১৯২০তে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন বিধান চন্দ্র। কিছুদিনের মধ্যে আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে কংগ্রেসে যোগদান করেন। ১৯৩১-এ গান্ধীজির ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করে কারাবরণ করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর উত্তরপ্রদেশের গভর্নর হওয়ার জন্য তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু প্রস্তাব দিলে অসুস্থতার কারণে তা হয়নি।

জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব বিধান রায়কে দেওয়ার কথা লর্ড মাউন্টব্যাটেন জওহরলাল নেহেরুকে বলেছিলেন। এরপর কংগ্রেস দলের প্রতিনিধিত্বে ১৯৪৮ সালের ১৪ই জানুয়ারি থেকে মৃত্যুকাল অবধি ১৪ বছর তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গের রূপকার

স্বাধীনোত্তর ভারতে বাংলার টালমাটাল পরিস্থিতি ছিল। ১৯৪৮-এ উদ্বাস্তু সমস্যা রাজ্যে ভয়াবহ আকার নিয়েছিল, সেইসময় বিধান রায় তাদের দিয়েছিল অন্ন ও বাসস্থানের প্রতিশ্রুতি। বহু পতিত জমি উদ্ধার করে বাসস্থানের জন্য গড়ে তুললেন সল্টলেক, লেক টাউন, কল্যাণী উপনগরী প্রভৃতি। বেকারদের জন্য কর্মনিয়োগের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

বাংলায় শিল্পের জন্য প্রতিষ্ঠা হল দুর্গাপুর ইস্পাতনগরী, চিত্তরঞ্জন রেলইঞ্জিন কারখানা। দার্জিলিং-এ দেশের মধ্যে প্রথম পর্বতারোহণ শিক্ষাকেন্দ্র তৈরি হল। কলকাতার পর হলদিয়া বন্দর গড়ে ওঠা, এমনকি ফারাক্কা ব্যারেজ গড়ে ওঠার পেছনেও বিধান চন্দ্রের ভূমিকা ছিল।
তাঁর চোদ্দো বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রচুর উন্নতি সাধন হয়েছিল। এই কারণে তাঁকে “পশ্চিমবঙ্গের রূপকার” নামে অভিহিত করা হয়।

শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অবদান

বিধান চন্দ্র রায় ১৯৪২-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৪৩-৪৪ তিনি সেখানকার উপাধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ, পুরুলিয়া, রহড়া, নরেন্দ্রপুরে আশ্রমিক পরিবেশে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে।

সংস্কৃতিতেও তাঁর অবদান কম নয়। সত্যজিত রায়ের চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালি’ অসমাপ্ত অবস্থায় দেখেন এবং ছবিটির সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করেন। বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শংকরের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকীতে রচনাবলী ছাপানোয় উদ্যোগী হন।

মৃত্যু:

দীর্ঘ কর্মজীবনে তাঁর দু’বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, তৃতীয়বার আর ধাক্কাটা সামলাতে পারেননি। ১৯৬২এর ১লা জুলাই মৃত্যু বরণ করেন তিনি। মানুষের মুখ দেখে নাড়ির খবর বলতে পারা এই চিকিৎসক নিজের আসন্নপ্রায় মৃত্যুর কথা বুঝতে পেরেছিলেন।

উপসংহার

মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে কলকাতার উপনগরী সল্টলেকের নামকরণ করা হয় বিধাননগর। বরণীয় এই ব্যক্তিটির জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে, ১লা জুলাই। চিকিৎসাক্ষেত্রে তাঁর অবিস্মরণীয় কৃতিত্বের জন্য এই দিনটি “চিকিৎসক দিবস” হিসেবে পালিত হয়।

লেখকঃ চিকিৎসক এবং সমাজকর্মী।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়