Dr. Aminul Islam

Published:
2020-11-02 01:37:43 BdST

এডিকশন :একজন "ড্রাগ এডিক্টেড "রোগীর সাথে কথোপকথন



ডা. সুকুমার সুর রায়


______________________________


চেম্বারে একজন "ড্রাগ এডিক্টেড "রোগীর
সাথে নিম্নরূপ কথোপকথন হয়। নাম ঠিকানা গোপন রেখে কথোপকথনটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
একজন হাড্ডি কংকালসার মানুষ চেম্বারে প্রবেশ করতেই তাকে স্বাগত জানানো হলো।
ডাক্তার ঃ এসো এসো, বস। তোমাকে তুমি বললাম।
উ: জ্বি ছার।
প্র: নাম বল।
উ: নজরুল ইসলাম ।
প্র: বাড়ি কোথায়?
উ: সিলিমপুর ছার।
প্র: সিলিমপুর টা কোথায়?
উ: ইস্টিশনের উত্তুরমুরা সিমেন্ট মিলের বোগলে।
প্র: বয়স কত?
উ: অনুমান আটতিরিশ।
প্র: পেশা কি?
উ: ইশটিশনের লেবার ছার।
প্র: সাথে আর কেউ এসেছে?
উ: জ্বি না, একলাই আইচি।
প্র: কি সমস্যার জন্য এসেছো?
উ: কাশ,... প্যাট কামড়ায়।
প্র: ডাক্তারের কাছে সব সত্যি কথা খুলে বলতে হয় জানোতো?
উ: জ্বি।
প্র: সরাসরি জিজ্ঞেস করি। কোন রকম নেশা করো?
উ: জ্বি।
প্র: কি কি নেশা করো?
উ: গাঁজা, ইয়াবা, হিরুইন।
প্র: কতদিন হলো ?
উ: পাঁচ /ছয় বছর ।
প্র: সব নেশা এক সাথে করো?
উ: না, যহুন যেডো জোগার অয়।
প্র: কোথায় পাওয়া যায়?
উ: সব ঠেন, ইস্টিশনে বেশি, টাউনেও পাওয়া যায়।
প্র: কারা বিক্রি করে?
উ: ছোট ছোট খুচরা ব্যাচাল আচে, এহাকজনের চালান দুই তিন আজার ট্যাহা। দশ/ বারো পুইর‍্যা কইর‍্যা ব্যাচে।
যারা খোর তারাও ব্যাচে।
ছোট ছোট ম্যালা মহাজন আচে, বড় গুলান
চিনিন্যা।
প্র: এই তিনটার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোনটা চলে?
উ: হিরুইন।
প্র: দাম কি রকম?
উ: পুইর‍্যা তিনশো ট্যাহা।
প্র: ইয়াবার দাম?
উ: তিনশো ট্যাহার বড়ি আচে আবার দুইশো ট্যাহার বড়িও আচে।
প্র: কেন? ভেজাল আছে নাকি?
উ: জ্বি।
প্র: কিভাবে ব্যবহার করো?
উ: সিগারেটের আংতার উপুড় থুইয়া নিচে আগুনের তাও' দিয়া কাগজের নল দিয়া
বিড়ির মত টাইন্যা খাতি অয়।
প্র: এত টাকা কোথায় পাও?
উ: সারাদিন কাম হইর‍্যাও দাম অইবো না, চুরি ছাড়া বুদ্দি নাই ছার।
প্র: বাড়িতে কে কে আছে?
উ: বাপ, মাও, বউ, এক গেদি, দুই গ্যাদা।
প্র: ছেলে মেয়েদের বয়স কত? কি করে?
উ: বড় গ্যাদা আটারো বছর, ঢাহা গার্মেন্টসে কাম করে। গেদি কেলাশ নাইনে, ছোট গ্যাদা কেলাশ টু'য়ে পড়ে।
প্র: বাপ মা, বউ কিছু বলে না?
উ: পরথম পরথম কান্দাকাটি কইরচে, আহুন কুনু কতা কয় না। ফিরায়া তাকায় না।
প্র: খাবারের ব্যবস্থা কিভাবে হয়?
উ: বউডো ভালো, ভাত ঢাইক্যা থুয়্যা দেয়।
প্র: এই যে তোমার ছেলে গার্মেন্টসে কাজ ক'রে টাকা পাঠায়, সেই টাকা দিয়ে নেশা
করো, ভালো লাগে?
উ: নিরুত্তর।
প্র:তোমার মেয়েটার বিয়ের ব্যাপারে সমস্যা হবে না?
উ: জ্বি স্যার, মাইনষে কইবো নেশাখোরের ম্যায়া!
প্র: তোমার আত্মীয়স্বজন, সমাজের লোক কিছু বলে না?
উ: সামনাসামনি দেহা অলি তাকায় না, ওতে ঘাতে কয় নেশাখোর।
প্র: আচ্ছা, এই অবস্থা থেকে তোমার ভাল হতে ইচ্ছা করে না?
উ: জ্বি ছার, ইচ্চা অয়, কিন্তুক এহাবারে পারিনা।
প্র: কেন পারো না?
উ: ছার, এডো এইরহম নেশা! যে কি কমু!
প্র: কিরকম?
উ: ধরেন, নেশার টাইমে এক ঘরে এক বস্তা ট্যাহা, আরাক ঘরে এক পুইর‍্যা হিরুইন থুইয়া আমাক যুদিল কন, যে কোন এক ঘরে ঢোকো - ' আমি পুইর‍্যার ঘরে ঢুকমু।
প্র: আচ্ছা, এই যে তোমরা নেশা কর, এই জিনিষ জোগাড় করো, পুলিশের ভয় নাই?
উ: পুলিশের হাতে ধরা পইর‍্যা চার মাস জেল খাইট্যা কয়াকদিন আগে বাইর হইচি ছার।
প্র: কিভাবে ধরা পরলে?
উ: এক সাতে কয়াকজন নেশা করতিচিলাম।
প্র: কোন মহাজন ধরা পরে নাই?
উ: জ্বি ছার, ধরা পড়লি কি অইবো? ট্যাহা দিলি সাতে সাত ওগরে ছাইড়্যা দেয়।
আমাগোরে ট্যাহা নাই জন্যি চালান দিয়্যা
দিলো। যারা বড় মহাজন তাগোরে ব্যাকমালাক পুলিশ চেনে।
প্র: জেল খানায় কি নেশার জিনিষ পেয়েছো?
উ: যাগরে ট্যাহা আচে, তাগরে অসুবিদা নাই, নতুন স্যান্ডেলের মদ্যে, পাঁউরুটির মদ্যে,
আরো নানান কায়দায় ওরা পাইয়্যা যায়।
যহুন কোটে হাজিরার দিন নিয়া যায়, তহুনও ট্যাহা দিলি পুলিশ বাইর‍্যাই দিয়্যা দেয়। ট্যাহা না থাকলি উপায় নাই ছার।
প্র: জেলের চার মাস নেশা ছাড়া থাকতে পারলে?
উ: জ্বি ছার।
প্র: জেল থেকে বের হয়ে আবার শুরু করলে?
উ: জ্বে ছার।
প্র: তোমাকে 'রিহ্যাবে' ভর্তি রাখতে পারলে ভাল হওয়ার একটা চান্স আছে।
উ: রিহ্যাবেও বর্তি হচিল্যাম ছার। তিন মাস আচিল্যাম
প্র: সেখানে কি নিজের ইচ্ছায় গিয়েছিলে?
উ: নিজেই গেচিল্যাম, পরে আব্বা গেচিলো।
প্র: সেখানে তিন মাস নেশা ছাড়া কেমনে কাটালে?
উ : বাড়ানের রাস্তা আচিলো না ছার! যুদিল দরজা খোলা পাইত্যাম, ঝাইর‍্যা দৌড় দিত্যাম ছার!
প্র: তাহলে তোমার মুক্তির পথ কি?
উ: জানিনা, কোন বুদ্দি নাই ছার?
প্র: না! কোন বুদ্ধিই নাই। তোমার সাথে তোমার পরিবার, তোমার আত্মীয়স্বজন, সমাজের লোক, রাস্ট্রের পুলিশ, কেউ নাই।
এমনকি আমি ডাক্তারও তোমার সাথে নাই।
তোমার একজনও ভাল বন্ধু নাই।
তুমি যাদের সাথে ওঠা বসা কর, তারা হয় খোর, না হয় এর ব্যাবসা করে। তারা কখনো চাইবে না তুমি সুস্থ হও। তোমার স্ত্রী, ছেলে মেয়ে, বাপ মা, কাউকেই তুমি বন্ধু মনে করো না। তোমার একমাত্র বন্ধু - ' এক
পুরিয়া হেরোইন'।
তুমি একটা 'শেয়ালের গর্তে' ঢুকে পড়েছো।
এই গর্তে ঢোকা যায়, বের হওয়া যায় না। এই গর্তে কখনো আলো ঢোকে না। এখানে সূর্যোদয় হয় না, সূর্যাস্তও হয় না। এখানে নদীর কুলুধ্বনী নাই, পাখির কলকাকলি নাই, ফুলের সুবাস নাই, শিশুর মুখের আধফোটা বোল নাই, প্রিয়তমা স্ত্রীর বাহুডোর নাই, স্নেহময়ী মায়ের আঁচল নাই, বাবার আদরের শাসন নাই, ছোট ছেলেটির তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া নাই।
তোমার মাথার চুলে তোমার মেয়েটির ভালবাসার হাতের বিলি কাটা নাই, তোমার কাঁধে তোমার বড় ছেলেটির কাঁধ মেলানো নাই।
সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে, তুমি নিজেকে ' ' শেয়ালের গর্তের ' শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছো -- 'এক পুরিয়া পাউডারের 'দুর্নিবার নেশায়।
এখন শেষ পরিণতি হল, গর্তের শেষ মাথায় তুমি মরে পরে থাকবে , পঁচে, গলে, তোমার শরীর মাটির সাথে মিশে যাবে, কয়েকখানা হাড্ডি অবশ্য চিহ্নস্বরূপ অবশিষ্ট থাকবে। সে কথা অবশ্য কেউ জানবে না।
উ: তাইলি উপায় কি ছার?
প্র: কোন উপায়ই অবশিষ্ট নাই। তবে কিছু আশার কথা আছে। তুমি নিজ ইচ্ছায় রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে গিয়েছিলে এবং সেখানে তিনমাস একটানা নেশা ছাড়া ছিলে। জেলখানায় একটানা চার মাস নেশা ছাড়া থাকতে পেরেছো।
আমার এখানে একাই নিজের ইচ্ছাতেই এসেছো, এগুলি হল ইতিবাচক দিক এবং আশার দিক। এখন শুধুমাত্র তোমার উপরে সব কিছু নির্ভর করছে।
উ: আমি কি করমু ছার?
প্র: তোমাকে একটা যুদ্ধ করতে হবে। দ্বন্দ যুদ্ধ।
এই যুদ্ধটা এমনই যে, হয় মারতে হবে, না হয় মরতে হবে, মাঝামাঝি কোন পথ নাই।
তোমার শত্রু হল ' পুরিয়া '।
যুদ্ধ করে তাকে মারতে মারতে পিছু হটে গর্তের বাইরে আলোর দিকে বেড়িয়ে আসতে হবে। তাহলেই তুমি জিতে যাবে।
মানুষের পক্ষে জেতা সম্ভব! মানুষ কত অসাধ্যসাধন করেছে।সে তুলনায় তোমার এরকম যুদ্ধ জয় তেমন কঠিন কিছু না।
উ: ছার, আপনে যে লেকছারখান দিল্যান, হুইনতে খুব সোন্দর হোনা গ্যালো।
আমার যহুন নেশার সমায় অইবো, আপনের এই লেকছার দিয়্যা কাম অইবো না ছার! হাত্তি দিয়্যা টাইন্যাও আমাক ধইর‍্যা রাইকপ্যার পাইরব্যান না।
প্র: হ্যা, তাতো ঠিকই।
তোমাকেতো আমি হাতি দিয়ে আটকাতে যাবো না।
আর সবার মত আমিওতো তোমার সাথে নাই।
তুমি যদি যুদ্ধ করতে চাও, তোমাকে একাই তা করতে হবে।
যে জিনিষ তোমাকে হাতির চেয়ে বেশি শক্তি দিয়ে টানে, তোমাকে তার চেয়েও বেশি শক্তি খাটিয়ে পেছন দিকে ফিরতে হবে।
আগে তোমাকে সিদ্ধান্তটা নিতে হবে যে, তুমি যুদ্ধটা করবে কিনা? যুদ্ধ শুরু করতে পারলে, আমি তোমাকে সহযোগীতা করবো। তোমার শারীরিক কিছু সমস্যা আছে, সে গুলির চিকিৎসা করবো তারপর তোমার মুক্তির যুদ্ধের সহযোগী হবো।
যুদ্ধে কি নামবে?
উ: জ্বে ছার।
--- ঠিক আছে এসো ............

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়