Ameen Qudir

Published:
2019-09-19 21:14:47 BdST

চিকিৎসক সংকট: তথ্য জানতে জেলায় জেলায় গিয়ে শোচনীয় যা দেখলেন ৩৯ বিসিএস উত্তীর্ণরা


 ছবি প্রতিনিধি দলের সৌজন্যে পাওয়া

রিপোর্ট : ডা. রাফা বিনতে নূর : সংবাদ সূত্র : ডা. রাজন সিনহা
________________________________

 

ভ্রমণকাহিনী শুনলেই দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে আনন্দময় কিছু মূহূর্ত। ভ্রমণকে বেছে নেয় সবাই একটুখানি অবসর কাটাতে, ব্যস্ত জীবনের অবসাদমুক্তির পথ হিসেবে। কিন্তু সব ভ্রমণকাহিনী কী এক হয়? আমাদের ভ্রমণটা কিন্তু একটু ভিন্নরকম।
দিনকাল চলছিল গতানুগতিক ধারায়। আশা-দুরাশা সবকিছু তালগোল পাকিয়ে জবুথবু হয়েই যেন বসেছিলাম সবাই। এখানে ওখানে বহুখানে যাই, অনেক কিছু বুঝতে পারি আবার পারি না। সেই ৩০ এপ্রিল রেজাল্ট থেকে শুরু হয়েছে।
হঠাৎ একদিন একটি চিঠি হাতে (ভার্চুয়ালি) এসে পড়লো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটা কড়া চিঠি। সারসংক্ষেপ—আগের চিঠির উত্তর পাওয়া যায়নি। ১৫/০৯/১৯ এর মধ্যে যদি এই চিঠির রিপ্লাই ও সংশ্লিষ্ট মহলগুলো দিতে অপারগ হয় তাহলে ধরে নেওয়া হবে তার প্রতিষ্ঠানে নতুন সংখ্যক চিকিৎসকের প্রয়োজন নেই!
কী ভয়াবহ! এ রকম চিঠির উত্তর আবার দিবে না—এ কি করে হয়!


প্রায়ই খবরের কাগজ ও টেলিভিশন সংবাদে দেখি, অমুক উপজেলায় চিকিৎসক সংকট। তমুক উপজেলায় চিকিৎসকের অভাবে রোগীদের হয়রানি। ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদে জানতে পারি উপজেলায় বড্ড বেশি চিকিৎসক সংকট।
এর মধ্যে আবার এ চিঠি। প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন পদ সৃজন করার উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ চিঠি। এদিকে আমরা আট হাজার ৩৬০ জন উত্তীর্ণ হয়ে বসে আছি। কিন্তু পদ ফাঁকা না থাকায় আমাদেরকে চাকরি দেওয়া যাচ্ছে না।
সঙ্গত কারণেই মনে হলো, একবার নিজেরাই ভ্রমণে বেরিয়ে যাই! তরুণ এক চিকিৎসক গোষ্ঠী সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে বেরিয়ে পরলাম, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম জেলায় জেলায়।
গন্তব্য সিভিল সার্জন অফিস। উদ্দেশ্য চিকিৎসক সংকটের প্রকৃত চিত্র নিজেদের চোখে দেখা, নিজেদের কানে শোনা। স্বাস্থ্যব্যবস্থার তীব্র সংকটের খণ্ডচিত্র অনুধাবন করা।

সঙ্গে নিলাম, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠির একটি কপি, আমাদের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি এবং আরো কিছু কাগজপত্র। শুরু হলো আমাদের যাত্রা।
অনেক জল্পনা-কল্পনা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। ধারণা করেছিলাম, জেলায় জেলায় গিয়ে নিশ্চয় মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো ওই চিঠির আদেশ বাস্তবায়নের জোর তৎপরতা দেখতে পাবো। কিন্তু বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন, যা সত্যিই হতাশাজনক।
প্রশাসনিক সংস্কার সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সর্বশেষ অনুমোদিত বিভাগ ময়মনসিংহ দিয়েই ব্যতিক্রমী এ ভ্রমণের বর্ণনা শুরু করা যাক।
ঢাকার খুব কাছে, মোটেও প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকা নয়। গেলাম ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন অফিসে। গিয়ে তো আক্কেলগুড়ুম! এরকম কোনো চিঠির হদিস তারা জানেনই না! কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম। এ নিয়ে আমরা বেশি অগ্রসর হয়ে গেছি কিনা—তাও বুঝতে পারলাম না। চিঠিই পাননি বলে এ সংক্রান্ত কাজের অগ্রগতির খবরও তাই খুব একটা পেলাম না।
তবে নেত্রকোনা সিভিল সার্জন অফিসের চিত্র আবার ভিন্ন। চিঠির ব্যাপারে তারা অবগত। জানতে পারলাম, মান্ধাতার আমলের জনবল কাঠামো দিয়ে এখনো উপজেলাগুলো ধুঁকে ধুঁকে চলছে। তার মধ্যেও আবার ব্যাপক সংখ্যক পদ ফাঁকা।
তারা অকপটে স্বীকার করলেন প্রচুর চিকিৎসক প্রয়োজন। শুধুমাত্র সদরেই ১২টি পোস্ট খালি আছে। ৮টা সম্পূর্ণ ফাঁকা আর বাকি ৪ জন নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজে সংযুক্ত। প্রতি কনসালটেন্টের জন্য তো সর্বনিম্ন একজন হলেও মেডিকেল অফিসার প্রয়োজন। নতুবা কি করে একজন কনসালটেন্ট রাউন্ড দিবেন কিংবা অপারেশন করবেন!
ব্যাপারগুলো আরো খোলাসা হলো জামালপুর গিয়ে। এই জেলায় মোট পদ রয়েছে ১৭৭টি। তার মধ্যে কর্মরত চিকিৎসক আছেন ৮৬ জন। শূন্য পদ রয়েছে ৯১টি। আবার ৩টি উপজেলা ৩১ শয্যা হতে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। অথচ জনবল সেই ৩১ শয্যাবিশিষ্টই রয়ে গেছে। এখানে আরো ১৮টি নতুন পদ সৃজন এমনিতেই প্রয়োজন।
এ হিসাবে এই জেলায় সর্বমোট শূন্য পদের সংখ্যা দাঁড়াবে ১২৯। এতো সংকটের মধ্যেও আবার প্রেষণে/অন্যত্র কর্মরত চিকিৎসক ৩৮ জন! খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে ১৭ জনসহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব হেল্থ টেকনোলজি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রভৃতি জায়গায় এই ৩৮ জন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন।
দিনে দিনে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কম্প্লেক্সে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন নতুন মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়েছে। বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো বেড়েছে। কিন্তু সেই ২০০৮ সালের জনবল কাঠামোতেই সবাই আটকে আছে। পদ সৃজন হয়নি। স্বাস্থ্য খাতের বিদ্যমান সংকট ঘোচাতে হয়নি বড় কোনো নিয়োগ। এসব নতুন চাহিদাগুলো মেটাতে উপজেলা/ইউনিয়ন সাবসেন্টার থেকে এটাচমেন্টে চিকিৎসকদের নিয়ে আসা হয়। কাগজে-কলমে পদ পূর্ণ থাকলেও আদতে চিকিৎসকরা উপজেলায় কাজ করতে পারছেন না।
সূত্রে জানা গেছে, প্রতি মাসেই নাকি শূন্য পদ পূরণের চাহিদা চেয়ে চিঠি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। কিন্তু এগুলোর কিছুই কাজে দেয় না। এবারের চিঠিটাও কি তাহলে ও রকমই? উত্তর জানতে দ্বিগুণ উদ্যমে খোঁজ নিতে আমরা এবার রাজশাহী বিভাগে।
ময়মনসিংহ বিভাগের সমন্বয়কারী ছিলেন ডা. রাফসান আব্দুল্লাহ ও ডা. এস এম শহীদুর রহমান। জেলা প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন ডা. মো. মনিরুজ্জামান, ডা. আদনিন মৌরিন. ডা. মনোয়ার মো. ভূইয়া পুলক।
লেখা প্রতিনিধিদলের পক্ষে: ডা. রাফা বিনতে নূর।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়