Ameen Qudir

Published:
2019-08-01 05:36:47 BdST

ফেসবুক দেখে ডেঙ্গুর টোটকা চিকিৎসা দেবেন না: জীবন বিপন্ন হবে :বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক


ডা. জামান অ্যালেক্স
___________________________

দিনকাল খুব একটা সুবিধার না। চেম্বারে ভয়ে ভয়ে রোগী দেখি। আর রোগীটা যদি হয় ডেঙ্গুর -তবে তো কথাই নেই, ভয়ের ষোলকলা পূর্ণ হয়। রোগী ও রোগীর লোকজন যদি রোগ সম্পর্কে আমার থেকে বেশী জানে, তবে সেখানে চিকিৎসা দেয়াটা টাফ্। গত একমাসে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা করতে করতে আমি বুঝতে পারলাম এই রোগ সম্পর্কে রোগীর তুলনায় আমি মোটামুটি শিশু পর্যায়ে আছি...

যাই হোক, মূল ঘটনায় আসি। চেম্বার শেষ পর্যায়ে, রাত দশটার মত বাজে। চেম্বার শেষে এক কাপ চা খাওয়া পুরোনো অভ্যাস। চা খাওয়ার শেষ পর্যায়ে স্মার্ট এক জোড়া তরুণ-তরুণীর আগমন। রাত দশটায়ও তরুণীর চোখে সানগ্লাস, এতো রাতে চোখে সানগ্লাস দেয়ার কারণটা বুঝতে পারলাম না। কনজাংটিভাইটিস আছে হয়তো...

তরুণীর ডোমিন্যান্ট এবং ঝনঝনে কথায় চিন্তায় ছেদ পড়লো...

--ডক্টর, ও আমার হাসব্যান্ড।ওর ডেঙ্গু ধরা পড়েছে...
--ডেঙ্গু হয়েছে কিভাবে বুঝলেন?
--(সপ্রতিভ কণ্ঠে)জ্বর ছিলো ওর, নিজেই হাসপাতালে নিয়ে প্লাটিলেট আর এন এইচ ওয়ানটা করালাম। এন এইচ ওয়ান পজিটিভ...
--ওটা এন এইচ ওয়ান না, এন এস ওয়ান..
--ও আচ্ছা..

ভুল ধরে দেওয়াতে তরুণী বোধ হয় আহত হলেন। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে হাতে ভাঁজ করে রাখলেন। আমি লক্ষ্য করলাম উনার চোখে কোন কনজাংটিভাইটিস নেই। ঝনঝনে কথায় আবার চিন্তায় ছেদ পড়লো...

--ডক্টর, গতকাল প্লাটিলেট ছিলো এক লাখ চল্লিশ হাজার, আজ দেখি এক লাখ সাইত্রিশ হাজার! এক দিনে ৩০০০ প্লাটিলেট নাই! শরীরও দুর্বল।কি একটা অবস্থা বলেন দেখি! তিন মাস হলো মাত্র আমাদের বিয়ে হয়েছে, আমার তো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে! তাই দেরী না করে চলে আসলাম আর কি...

নতুন বিয়ে, তার উপর স্বামীর ডেঙ্গু, চিন্তিত হবারই কথা। সময় নিয়ে রোগী দেখলাম, প্রেসক্রিপশন লিখলাম, সবশেষে প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং করলাম...

কাউন্সেলিং শেষ করে রোগী বিদায় দিতে গিয়েই বিপদ শুরু হলো। কথায় বলে, Danger comes when danger is feared. রোগীর স্ত্রী আবার তার সানগ্লাস পড়ে অ্যাটাকিং মোডে ডেঙ্গু নিয়ে তার জ্ঞানের ঝাঁপি আমার সামনে খুলে বসলেন...

--ডক্টর, আপনি তো পেঁপে পাতার জুস খাওয়া নিয়ে কিছুই বললেন না...
--পেঁপে পাতার জুস!
--জ্বি, ফেসবুকে তো দেখলাম পেঁপে পাতার জুস খেলে প্লাটিলেট বাড়ে! জুসটা দিনে কয় গ্লাস করে খাওয়াবো?
--ইয়ে, মানে, ফেসবুকে বলে দেয়া নাই...
--নাহ, আসলে একারণেই মূলত তো আপনার কাছে আসা...
--পেঁপে পাতার জুস কয় গ্লাস করে খাওয়াবেন--সেটা জানতে আমার কাছে এসেছেন?
--জ্বি, বাকী চিকিৎসা তো সব ফেসবুকেই লেখা আছে...

মানুষ অধিক শোকে পাথর হয়, তরুণীর কথা শুনে আমার লোহা হবার দশা...

--আর কি কি পাতার কথা বলা আছে ফেসবুকে? কাঁঠাল পাতা? কাঁঠাল পাতার জুসের কথা বলা নাই?
--(চিন্তিত হয়ে) উমম্, কাঁঠাল পাতার কথা তো ফেসবুকে চোখে পড়ে নাই। ডক্টর, এটাও কি প্লাটিলেট বাড়ায়?

স্বামী মহাশয় এতোক্ষণ চুপ ছিলেন। পাশ থেকে এবার তিনি গোঙানি দিয়ে বললেন, "কাঁঠাল পাতার জুস খেতে পারবোনা... "

--বেদেনার রস খাওয়ালে কেমন হয় স্যার?
--বেদেনা!! এটা আবার কি?
--আরেহ ডালিম ডালিম। ডালিমের রস খাওয়াই? ফেসবুকে দেখলাম-সেটাও তো প্লাটিলেট বাড়ায়...
--ওহ আচ্ছা, ডালিমের রস প্লাটিলেট বাড়ায়!! ছোকলা, ডালিমের ছোকলার ব্যাপারে ফেসবুকে কিছু বলা নাই?

স্বামী মহাশয় আবার অস্ফুট গোঙানি দিয়ে বললেন, "ডালিমের রসও খাবো না, ছোকলাও খাবো না, আমার এমনিতেই কষার প্রবলেম..."

স্ত্রী স্বামীর দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলেনঃ" চুপ করো। লাগলে খেতে হবে না!! বাচ্চা নাকি তুমি! আজব..."

তরুণী আবার আমার দিকে তাকিয়ে কথা শুরু করলেন...

--স্যার, ফেসবুকে দেখলাম ডেঙ্গু হলে পালং শাক নাকি উপকারী। পালং শাক আনতে বাজারে লোক পাঠিয়েছিলাম। লোক বাসায় এসে জানালোঃবাজারে নাকি পালং শাক এর খুব ক্রাইসিস, পাওয়া যাচ্ছে না। এখন কি করি, বলেন তো? আমার তো খুব টেনশন হচ্ছে...

--(আমি একটু উদাসীন হয়ে)পালং শাক যেহেতু নাই, ঘাস খাওয়াতে পারেন, কচি সবুজ ঘাস, একই গোত্রীয়, সবই ঘাসপাতা। দুই চিমটা বিট্ লবণ আর এক গ্লাস পানি দিয়ে ব্লেন্ডার মেশিনে ব্লেন্ড করে দিবেন। আপনিও খেতে পারেন, আগে থেকে একটু সাবধানতা আর কি ...

স্বামী নিচের দিকে মাথা দিয়ে ডানে বামে ঘুরিয়ে আবার গোঙানি দিয়ে বললোঃ" ঘাসের জুস খাবো না..."

এতোক্ষণে তরুণী এবার একটু সন্দিহান হলেন। কিছুটা রাগী রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেনঃ" আর ইউ সিরিয়াস?নাকি আপনি আমার সাথে জোক করছেন?"...

আমি তরুণীর রাগী রাগী চোখকে উপেক্ষা করলাম। সব রাগী চোখকে প্রশয় দিতে নেই। আমি তরুণটির দিকে তাকালাম। তরুণটির জন্য আমার খারাপই লাগলো। খারাপ ঠিক না, করুণা বলা চলে। বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন মাস, জীবনের নতুন এক শুরু বলা যায়, বাকী জীবন তো পড়েই আছে। না জানি বেচারাকে এই জীবনে এক ফেসবুকের বরকতে আরো কত কিছু হজম করতে হয়....।
__________________________

ডা. জামান অ্যালেক্স । সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়