Ameen Qudir

Published:
2019-07-09 01:48:25 BdST

পল্লী চিকিৎসক পান খান, এম বি বি এস মার খান


 

 

ডা. সাঈদ এনাম
_________________________

ডা. তুলি সদ্য এম বি বি এস পাশ করে মফস্বলে তার বাবার চেম্বারে বসা শুরু করে দিয়েছেন। তার বাবা একজন নাম করা চিকিৎসক। তুলি বড় হয়েছে তার বাবার নামডাক শুনে শুনে। সবাই খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখে তুলির বাবাকে, তুলিদের পরিবারের সবাইকে। অনেক বাঘা বাঘা প্রফেসর এর প্রেশক্রিপশন কে তুলির বাবা তার টেবিলের এক কোনে রেখে, "ভাই রাখুন এসব ঔষধ আর পরীক্ষানিরীক্ষা। আমি দেই, খান তারপর দেখেন" এসব বলতে শুনেছে। এবং আশ্চর্য ক্ষেত্র বিশেষে রুগীদের নাকি সুস্থও হতে দেখেছে সে।

তাই ছেলেবেলা থেকেই তাঁর বাবার প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসা।

বাবা দেলোয়ার আলি রশিদ তার চেম্বার সাজিয়েছেন সুন্দর করে। চকচকে ডিজিটাল সাইনবোর্ড। একপাশে তিনি বসেন আরেক পাশ ঠাসা ঔষধে। ডা. ডি.এ. রশিদ চৌধুরী মেডিকেল। তারা চৌধুরী বংশের না। কিন্তু তার বাবা এটা ব্যবহার করেন।

সেই মেডিকেল সেন্টারে রাতদিন রুগী তে গাদাগাদি। পাশেই দিয়েছেন ডা. তুলির চেম্বার। সে শুধু মহিলা রুগী দেখে। উচ্চতর পড়াশুনা করছে তাই সপ্তাহে দুতিন দিন দেখে।

ডা. তুলি একটা বিষয় খেয়াল করলো, তার বাবার চেম্বারে শো খানেক রুগী লেগেই থাকে কিন্তু তার কাছে দু' চার জনের বেশি হয়না। তার বাবা যে আহামরি কিছুদেন তাও নয়। বিষয়টি তার খুব খারাপ লাগে। অপমানিত বোধ করে, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলেনা।

তার বাবা একজন পল্লী চিকিৎসক, চিকিৎসা বিদ্যায় তার কোন জ্ঞান নেই। তারপর ও শত শত রুগী। রুগীতে রুগীতে ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি মারামারি।

একদিন এক রুগী এসে তুলির চেম্বারে মহা তুলকালাম বাঁধিয়ে দিলো। "আপনার বাবা আজীবন চিকিৎসা করলো, এক বেলা খাওয়ার পর আমরা সুস্থ, আর আপনাকে তিন তিনবার দেখালাম, এতো এতো ভিজিট দিলাম, কই উপকার তো পেলাম না। আপনি আপনার বাবার সাথে বসেন মা, ডাক্তারী ভালো করে শিখেন মা, আপনারই ভালো হবে"।

বিব্রত, অপমানিত তুলি একদিন ডায়নিং টেবিলে বসে তার বাবাকে বললো, "বাবা আমি আর চেম্বার করবোনা, আমার সামনে এফ সি পি এস পরীক্ষা"। বাবা বিষয়টি বুঝেন।

একদিন তাকে ডেকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, "মা'রে কোন ডাক্তার কি তার চেম্বারের মায়া ছাড়তে পারে। আমি জানি তুই কেনো চেম্বারে করতে চাচ্ছিস না। আমি কিছুই জানিনা অথচ এ জীবনে হাজার হাজার, লাখ লাখ রুগীকে আমি আন্দাজের উপরে চিকিৎসা দিয়ে দিলাম। কেউ সুস্থ হলো, কেউ হলো না, আবার কেউ বা মারাও গেলো। কিন্ত আজ পর্যন্ত কেউ আমার বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করলোনা। আমি কিছুই জানিনা, আর তোর কাছে রুগীরা যেতেই চায়না"।

তুলি কোন কথা বলেনা। তার চোখ ছলছল। বাবা তাকে কাছে টেনে নেন।

"শোন মা, আমি ছেলে বেলায় এক বিলেতি ডাক্তারের ব্যগ টানতাম। আমার যোগ্যতা বলতে সেটাই। একটা ভালো মানুষের সাথে আমি অনেক দিন ছিলাম। উনি ছিলেন আমাদের গ্রামের বিলেত ফেরত বড় ডাক্তার। খুব অমায়িক। তিনি মাঝেমধ্যে আমাকে ডেকে বলতেন, "রশিদ মিয়া, তুমি দেখো আমি সব রুগী কে প্রায় একই ঔষধ দেই। কুইনাইন আর কয়েকটি সিরাপ। আসলে দেবার মতো ভিন ভিন্ন কোন ঔষধ আমার কাছে নেই। আবিষ্কার ও হয় নি। তাই আমাকে কৌশল অবলম্বন করতে হয়। আমার ঔষধের অভাব আমি পুরন করি কৌশলটি। আমার কৌশল হলো তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, ভালোভাবে দুটো কথা বলা.."।

"তুলি আমি সেই বিলেতি ডাক্তারের কৌশল টাই রপ্ত করেছি, আর তা দিয়ে চলেছি বিগত পঞ্চাশ ষাট বছর। আমরা পল্লী চিকিৎসকদের বেশির ভাগই এরকম। কারো কারো হয়তো কিছু ট্রেনিং বা ডিপ্লোমা আছে। আমি ডাক্তারী জানিনা সত্য তবে আমি যা জানি সেটা তুই সেটা জানিস না। আমি প্রতিমুহূর্তে কৌশলে থাকি রুগীদের খুশি রাখতে। ভালো ব্যবহার দিয়ে যাদুর মতো ধরে রাখতে। ডাক্তারী জ্ঞান নেই বলে আমাকে এটা বেশি করতে হয়। কিন্তু তোর ডাক্তারী জ্ঞান আছে তাই তুই এ নিয়ে ভাবিস না। এটাই তোর দূর্বলতা। আমি জানি না তোর কি করা উচিত। তুই বড় ডাক্তার, তোকে জ্ঞান দেবার সাধ্য আমার নেই। কিন্তু আমারও খারাপ লাগে যখন রুগীরা এসে আমাকে মিস্টি পান খাওয়ায় আর তোদের মতো বড় বড় ডাক্তার দের অপমান করে। বড় আশা নিয়ে তোকে বড় ডাক্তার বানিয়েছি মা।
_________________________

ডা. সাঈদ এনাম
ডি এম সি, কে-৫২
সাইকিয়াট্রিস্ট
মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন
মেম্বার, ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়