Ameen Qudir

Published:
2019-02-24 07:37:52 BdST

নেতা একশত ভাগ নিশ্চিত: তাই ক্লিনকাট ধর্ষণের সার্টিফিকেট দিতেই হবে


 


ডা. সাঈদ এনাম__________

এক.

কেবল মাত্র ভোরে হয়েছে। পাখির ডাক শুনা যাচ্ছে। আমাদের ইমার্জেন্সী ডাক্তার রুম থেকে বেশ শুনা যায় সে কলকাক। আমি মশারীর ভিতর থেকে জানালার গ্লাস দিয়ে গাছের ডগার সবুজ পাতায় উপর ভোরের সোনালী রোদের খেলা দেখার চেস্টা করছি আর পাখিদের কিচিরমিচির ডাক শুনছি। এমন সময় হঠাৎ হাসপাতালের ইমার্জেন্সী মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ইমার্জেন্সী মোবাইল টি ডিউটি ডক্টরের বুক পকেটে থাকে ডিউটির দিন বা রাতে।

'স্যার জরুরী', মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট দিজেন্দ্র পাল ডাকলেন। অত্যন্ত ধৈর্যশীল, গুনী, অভিজ্ঞ চিকিৎসা কর্মী। সবার খুবই প্রিয়। আমি আদর করে তাকে দ্বীজু ডাকি।

উঠে ছুটলাম ইমার্জেন্সীতে। একটা আট দশ বছরের বাচ্চা মেয়ে ইমার্জেন্সী বেডে শোয়ানো। সারা গায়ে ছোপ ছোপ কাদা মাটি।
'কি হয়েছে' জিগ্যেস করায় মা বললেন, 'আমার মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে সন্ত্রাসীরা মেরেছে আর খারাপ কাজ করেছে'।

যেহেতু রেইপ কেইস, পুলিশ কেইস। সিরিয়াস ও বটে। তাছাড়া সাক্ষী প্রমান মামলা মোকদ্দমা অনেক কিছু অনেক বড় বিষয়, তাই জরুরী ভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সদর হাসপাতালে রেফার্ড দিলাম। বিদায়ের আগে গাইনোকোলজিস্ট বা লেডি ডক্টর না থাকায় সিনিয়র সিস্টার কে বললাম যতদূর পারা যায় প্রাইভেট পার্ট এর একটা এক্সটারনাল ইঞ্জুরী নোট রাখতে। যদিও মেডিকেল হিস্ট্রি তে বাচ্ছা মেয়েটি তেমন পজেটিভ কিছু বলেনি। তারপরও এসবে এক্সপার্ট অপিনিওনের জন্যে রেফার্ড করতেই হয়।

চলে যাবার একটু পরেই চিকিৎসার ব্যবস্থা পত্র নিয়ে হাজির এক নেতা। ডাক পড়লে, আবার গেলাম ইমার্জেন্সীতে। 'কি ব্যাপার?'।
নেতাজী ইরশাদ করলেন, "এই নাবালিকা মেয়েটা রেইপ হলো। গ্রামের মকবুল মাতব্বর এর সাংগো পাংগো সবাই মিলে রেইপ করলো, আর আপনি কিনা ধর্ষণের সার্টিফিকেট না দিয়ে, রোগী ভর্তি না করে সদরে পাঠিয়ে দিলেন"!

আমি বললাম, "যেভাবে নিয়ম সেভাবেই সব করা হয়েছে। বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়া রেইপ বা ধর্ষণ লিখে দেবার নিয়ম নেই। তাছাড়া আমরা তেমন কোন আলামত পাইনি। তারপর ও যেহেতু যারা নিয়ে এসেছেন তারা সে রকম কিছু একটার ইংগিত পাচ্ছেন তাই, হিস্ট্রি অব রেইপ লিখে পাঠিয়ে দিলাম সদরে। সেখানে গাইনী ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বোর্ড বসিয়ে সাফ সাফ সার্টিফিকেট দেবেন। ওটাই যুক্তিযুক্ত আপনারা দ্রুত সেটাই করেন। সদরে যান। আলামত কিন্তু বেশিক্ষণ কিন্তু থাকেনা। পরে প্যাচে পড়বেন"।

তিনি বাদ সাধলেন। তিনি একশত ভাগ নিশ্চিত। তাই ক্লিনকাট ধর্ষণের সার্টিফিকেট দিতেই হবে। তিনি মকবুলের কয়েকজন সাংগো পাংগোদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন, এক্ষুনি এরেস্টের ব্যবস্থা করবেন। একেবারে নাছোড়বান্দা টাইপের নেতা।

কি করবো বুঝিতে পারলাম না। এসবে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কারন শব্দ ব্যবহারে সামান্য হেরফের এ অনেক সময় নিরীহ ডাক্তার ফেঁসে যান।

আমি দ্বিজেন্দ বাবুর দিকে চেয়ে তাকে বললাম,
"বাবু এক কাজ করো, নেতাজী যেহেতু নিশ্চিত করে বুলছেন, রেইপ কেইস তাহলে উনাকে রাজ স্বাক্ষী করে একটা বন্ড সই রেডি করো। রেইপ লিখে দেই"।

"জ্বী স্যার" বলে তিনি তাৎক্ষণিক লাল কালিতে বন্ড সই লিখে আনলেন, 'আমি অমুক নিশ্চিত করে বলিতেছি যে ইহা রেইপ কেইস এবং আমার সম্মুখেই হইয়াছে....'। সাদা পাতায় ঝকঝকে লাল লেখা গুলো নেতার সামনে মেলে ধরলেন, স্বাক্ষর দেবার জন্যে।

দুই.

নেতাজী'তো এখন আর নড়েন চড়েন না। মুখে কোন কথা নেই। আমতা আমতা করে অস্পষ্ট স্বরে বললেন,
"না মানে আমি কেনো স্বাক্ষর দেবো, আমি কেনো রাজ সাক্ষী হবো। আমার সামনেতো রেইপ হয়নি। আমিও সবার মতো শুনেছি রেইপ কেইস স্যার.....'। (অনেক ক্ষন পর তার মুখে 'স্যার' শব্দ বের হলো)

আমি বললাম, "এইনা আপনি একশত ভাগ নিশ্চিত হয়ে বললেন"।
তিনি আবার বললেন, "না স্যার.... বলেছিলাম কি, মানে... আমি শুনেছি রেইপ তাই বলেছিলাম। আচ্ছা ঠিক আছে বন্ড সই লাগবেনা। আমরা সদরে যাই। কইরে তোরা আয়। আসি স্যার। আসসালামু আলাইকুম...."।

আমি বললাম, "ওয়ালাইকুম"।

ডা. সাঈদ এনাম
ডি এম সি, কে-৫২

সাইকিয়াট্রিস্ট
মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন
মেম্বার, ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশ।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়