Ameen Qudir

Published:
2018-10-22 00:18:15 BdST

রুগী মারা যাওয়ার পর সব চেয়ে প্যাথেটিক হল রুগীর স্বজনের কাছে ডেথ ডিক্লেয়ার করা


 

 

ডা. জোবায়ের আহমেদ
____________________________

তখন আমি সিওমেক হাসপাতাল এর ইন্টার্ন।
মেডিসিন ওয়ার্ড এ রাউন্ড দিচ্ছেন প্রফেসর ইসমাইল পাটোয়ারি স্যার। একটা রুগীর বেডের কাছে গিয়ে স্যার খুব শান্ত ভাবে রুগীর দিকে তাকিয়ে আমাদের দিকে ফিরে জানতে চাইলেন রুগীর স্বজন দের কাউন্সেলিং করা আছে কিনা,এই রুগী কিছুক্ষণ এর মধ্যেই মারা যাবেন।
ঠিক ১০ মিনিট পরেই রুগীর মেয়ের গগনবিদারী চিৎকারে মেডিসিন ওয়ার্ড ভারী হয়ে উঠল।আমি অবাক বিস্ময় এ স্যার এর শান্ত সৌম্য চেহারার দিকে তাকিয়ে আছি।
একটা মানুষ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে নিলেন,এই নীল আকাশ আর দেখবেন না,প্রিয়জন এর মায়াবী মুখ আর দেখবেন না,স্ত্রীর হাতের এক কাপ দুধ চা খেতে চাইবেন না,মা বলে প্রিয় মেয়ে কে আর ডাক দিবেন না,জ্যোৎস্নাময়ী রাত কিংবা অস্তগামী সূর্যের রক্তিম লাল আভা দেখবেন না। কিন্ত স্যার এর এতে কোন ভাবান্তর নেই।স্যার একজনের পর একজন রুগী কে দেখে যাচ্ছেন।

মেডিসিন এর একা এডমিশন নাইট।কিছু রাত বিভীষিকার আরেক নাম।দুই টা ওয়ার্ড একা সামাল দিতে হত।রাতে সিনিয়র কেউ থাকতেন না।একা সব সামাল দিতে হয়।পুরুষ ওয়ার্ডে নতুন পেশেন্ট রিসিভ করতে গেলে মহিলা ওয়ার্ড থেকে ফোন সিস্টারের,অমুক বেডের রুগী এক্সপায়ার করছে।
মহিলা ওয়ার্ড এ এসে ডেথ্ সার্টিফিকেট লিখতে লিখতে
পুরুষ ওয়ার্ড থেকে কল আরেক জন এক্সপায়ার করছে।রুগী মারা যাওয়ার পর সব চেয়ে প্যাথেটিক ব্যাপার হল রুগীর স্বজন এর কাছে ডেথ্ ডিক্লেয়ার করা। এই জীবনে কতবার সেই প্যাথেটিক ব্যাপার টার মুখোমুখি হতে হয়েছে তার হিসেব নেই।

মৃত্যু সত্য।মৃত্যু আসবেই।শুধু নির্ধারিত সময়ের অপেক্ষা।কিছু মৃত্যু মেনে নিতে আমাদের বুক ফেটে যায় কিন্ত মেনে না নিয়ে উপায় কি?
মৃত্যুর সময় অসময় বলে কিছু নেই।
কখন কার সময় সেটা মৃত্যুর মালিক জানেন।

তখন কার্ডিওলজি তে ইন্টার্নশীপ প্লেসমেন্ট।
শুক্রবার ছিল।আমার সাথে ডিউটিতে ছিল আমার বান্ধবী কাব্যশ্রী পাল।এত নরম ও শান্ত মনের মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি।আমি আমার একটা পেশেন্ট যিনি একিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান নিয়ে এডমিট হয়েছিলেন,ছুটির কাগজ লিখে জুমার নামাজে গেলাম কাব্যশ্রীর কাছে ছুটির কাগজ এ সিএ ভাইয়ার সিগ্নেচার রাখার দায়িত্ব দিয়ে।২০ মিনিট পর
নামাজ থেকে ফিরে দেখি রুগী লম্বা হয়ে শুয়ে আছে, সাদা বেডশীটে ঢাকা।বুকটা আতকে উঠল।একটু আগে যার সন্তানরা আনন্দে আত্মহারা ছিলেন প্রিয় বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন, নীচে গাড়ি রেডি ছিল,সেই বাবা এখন নিথর। সেই বাবার নাম এখন লাশ।
সেই রুগীর স্বজন দের চেহারা আজো মনে পড়ে।

আমার দাদাভাই একবার খুব অসুস্থ হয়ে গেলেন।বাঁচার কোন আশা দেখা গেল না।উনাকে নিয়ে আমরা কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রাম থেকে APOLLO HOSPITAL এ রওয়ানা দিলাম।
মাইক্রো বাস ছেড়ে দিল।দাদাভাই কে বিদায় দিতে উনার চাচাত ভাই হাবিব উল্লাহ দাদা এক লুঙ্গির উপর আরেক লুঙ্গি পড়েই দৌঁড় দিতে দিতে গাড়ির কাছে আসলেন।বংশের মুরুব্বি বড় ভাই কে বিদায় দিতে,দোয়া নিতে ব্যাকুল ছিলেন।হাবিব দাদার আশংকা ছিল আমার দাদার সাথে এটাই হয়ত শেষ দেখা।লুঙ্গি পাল্টানোর সময় পাননি।আমার দাদাভাই Apollo থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। কিন্ত সেই হাবিব উল্লাহ দাদাভাই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।
আমার দাদাভাই উনার জানাজার ইমামতি করলেন।
বিষয় টা আমাকে আজো নাড়া দেয়।
যিনি বাঁচার আশা ছিল না, তিনি বেঁচে গেলেন কিন্ত যার মৃত্যু নিয়ে আমাদের ভাবনা ছিল না তিনি যে আজরাইল এর লিস্ট এ ছিলেন তা আমরা বুঝিনি।

কুরবারির ঈদের ছুটি কাটিয়ে আন্তঃনগর পাহাড়িকা এক্সপ্রেস এ কুমিল্লা থেকে সিলেট ফিরছি আমি ও ডাঃ নাবিলা।সিলেট এ প্লাটফর্ম এ নেমে দেখা সাস্টের CSE DEPT এর সহযোগী অধ্যাপক আমাদের মামা ড.মো খায়রুল্লাহ এর সাথে।মামা হাসি মুখে আমাদের কুশল জানলেন,কার্ড দিলেন, সাস্টে যেতে বল্লেন কিন্ত আমরা যাওয়ার আগেই মামা চলে গেলেন চিরদিনের জন্য সাস্ট ছেড়ে।গত ৫ অক্টোবর জুমার নামাজে সুন্নত পড়ার সময় মামা ইন্তেকাল করেন।
আমি ভাবছি মামার ছোট্ট পুত্র সন্তান এর কথা।
বাবা কি বুঝার আগেই বাবা হারিয়ে গেলেন দূরে, বহুদূরে, দূর অজানায়।
কুমিল্লা থেকে ডাঃ নাবিলা যখন ফোনে জানালো এই বিষাদের খবর, তখন আমি নীরব হয়ে ছিলাম অনেক ক্ষণ।গত রাতে উনার হাসিমুখ এর ছবি গুলো দেখলাম আর ভাবলাম মায়ার এই পৃথিবীর সাথে উনি কেন এত দ্রুত মায়া ছিন্ন করলেন?
এখানে উনার ইচ্ছার কি কোন দাম আছে।
নেই ত।মৃত্যুর কাছে মানুষ এর ইচ্ছের কোন দাম নেই।

মৃত্যু কত কাছে??
গত ৩০ এপ্রিল বন্ধু ডাঃ জাবেদ এর সাথে রুগী দেখতে গেলাম কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ এর CCU তে।।
একটা রুগী দেখা শেষ করার আগেই ওর তিনজন রুগীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেল।।
আমি রুগীদের অবস্থা দেখে বুঝে গেছি জনাব হযরত আজরাঈল ( আঃ) আমাদের আশেপাশেই আছেন।।
ডাক্তারদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ১৫ মিঃ এর মধ্যে তিনজন রুগী মারা গেলেন।
কিসের এই দুনিয়া??
কিসের পিছনে ছুটে চলেছি আমরা??

দুপুর এ চেম্বারে বসে আছি।।
রুগী দেখছি।।
হঠাৎ মসজিদ থেকে একজন মানুষ এর মৃত্যুর সংবাদ মাইকে ঘোষণা হল।।
সাথে সাথে রুগী দেখা বন্ধ দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে ভাবলাম।।
আহারে জীবন।।
একদিন আমার মৃত্যুর সংবাদও মাইকে ঘোষণা হবে।।
আজ আপনি কাঁদছেন, কাল আমি কাঁদবো।।
আজ আমার মা কাঁদছে, কাল আপনার মা কাঁদবে।।
খুব অল্প সময়,ক্ষণিক এর এই জীবন।।
কোন দিন কারো ক্ষতি করতে নেই।।
কারো বিপদের কারণ হতে নেই।।

আজ কাউকে বিপদে ফেলে আপনি হাসলেন অন্যায় ভাবে।।।
কাল মহান প্রভু আপনাকে বিপদে ফেলে অন্যকে হাসির সুযোগ করে দিতে খুব বেশি সময় নিবেন না।
একদিন ত চলেই যাবো এই মায়ার পৃথিবী ছেড়ে।
তাই অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ান,
সে আপনার অপছন্দের হলেও।আপনার দলের না হলেও।
আল্লাহ অবশ্যই আপনার পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনেক কে পাঠাবেন।।।
মানুষ এর বিপদ এর কারণ হবেন না অন্যায্য ভাবে।

মানুষ ই একমাত্র প্রাণী যে জানে তাকে মরতে হবে।তাই মানুষ মৃত্যুর প্রস্তুতি নেয়,অন্য কোন প্রাণীর সেই প্রস্তুতি নেই।মানুষ এর আছে।
সব মৃত্যুই দুঃখের।সুখের কোন মৃত্যু নেই।
আমরা জানি একদিন আমরা মরে যাব তাই পৃথিবীটা এত সুন্দর লাগে,যদি জানতাম আমাদের মৃত্যু নেই তাহলে পৃথিবীটা এত সুন্দর লাগত না।

জীবন কে দেখুন মৃত্যুর চোখ দিয়ে।তাহলে জীবন হয়ে উঠবে সুন্দর ও সুখের।তবে মরার আগে মরে যাবেন না।

Life is like an ECG.
It will go up,then down,then up again.
When it is a flat line,you are just dead.
So enjoy your up and down in life.
________________________________

ডা. জোবায়ের আহমেদ। সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়