Ameen Qudir
Published:2017-03-04 15:56:52 BdST
চাকরিডা কী বেশি গাড়া অইয়া গেছেনি! হাস্পাতালডা আপনের ব্যক্তিগত সম্পুত্তি?
একজন ডাক্তারের কর্মপরিবেশের ছবি।
ডা. সাজ্জাদ মাহমুদ
________________________________
সেদিন সকালে এক মহিলা এসেছেন জরুরী বিভাগে।। চিল্লাচিল্লি করতে করতেই ঢুকলেন রুমে। সাধারণত কান্না আর বিলাপের মধ্যে একটা পার্থক্য থাকে। এই রোগীনির বেলায় বিলাপ আর কান্না দুইটাই চলছে। গ্রামের রাস্তায় আসার সময় চিল্লাচিল্লি শুনে মহিলার সাথে আরো জনা বিশেক লোক এসেছে। এরা রোগীনির কেউ নন, এটা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হয় না। 'রং-দেখা' বলতে একটা কথা প্রচলিত আছে। এই অতিরিক্ত ২০ জন লোক রং দেখতেই এসেছেন।
কেউ যদি ২ মিনিট আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলে দেখবেন আশেপাশে আরো ১০ জন এসে একই ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে, কিছু একটা খুজে বের করার চেষ্টা। উনি হয়তো কোন কারন ছাড়াই তাকিয়ে ছিলেন। এটা বাঙ্গালি চরিত্র। এই কিউরিসিটি দূর করা প্রায় অসম্ভব।
আসামাত্রই রোগীর হিস্ট্রি নেয়া শুরু করলাম। রুম থেকে সবাইকে বের করে দেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় রোগীর সব তথ্য পাওয়া যায় না। প্রাইভেসি দিলে অনেক জটিল রোগের হিস্ট্রি নেয়াও সহজ হয়। ভদ্রমহিলার স্বামীকে রেখে বাকি সবাইকে বের করে দিলাম। কিন্তু চেয়ারে ইতোমধ্যেই মাঝবয়সী দুইজন বসে আছেন। উনাদের অনুরোধ করার পরেও চেয়ার ছেড়ে বাইরে গেলেন না! বরং ডাক্তারের দিকে এমন তিরিক্ষ মেজাজে তাকালেন যেন উনাকে অপমান করা হয়েছে। খুব বেশি কথা না বাড়িয়ে রোগী দেখতে লাগলাম।
মহিলা রোগীদের ক্ষেত্রে প্রাইভেসি আরো গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু উপজেলা স্থাস্থ্য কমপ্লেক্স-এ একজন ডাক্তার কদাচিৎ এটা করতে পারেন। প্রেগন্যান্ট হলে চিকিৎসার ধরনও ভিন্ন হয়। মেয়েদের মাসিক বিষয়ক কোন প্রশ্ন করলে এর সহজ উত্তর দিতে চান না অনেকেই। আর সামনে কোন পরপুরুষ থাকলে তো কথাই নেই। লম্বা ঘোমটা টেনে নিরব থাকে। আর সেই পরপুরুষ এইসব আলাপ থেকে একটা গ্রাটিফিকেশন পায়।
রোগী দেখা শেষ করে আমার চেয়ারে বসে প্রেসক্রিপশন লিখছি। সামনে বসে থাকা লোকটি উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন,
- চাকরিডা কী বেশি গাড়া অইয়া গেছেনি?
আমার তখন মেজাজ চরমে। এই "গাড়া অইয়া" যাবার মানে বুঝার চেষ্টা করার ইচ্ছা তৈরী হয়নি। উনার এপ্রোচ বেশ বাজে ছিল। কিন্তু রাগ দমিয়ে আস্তে করে বললাম,
- হুম. হইছে। তো … আপনাকে বলা হইছিলো বাইরে যেতে। গেলেন না!!
- না গেলে কি অইছে?
- আমার রোগীর সমস্যা হলে আপনি দায়ি থাকবেন?
- আমি ক্যারে! (আরো জোরে শব্দ) হাস্পাতালডা আপনের ব্যক্তিগত সম্পুত্তি???
কোন কথা না বলে চুপচাপ রইলাম। মূর্খের সাথে তর্ক করাটা বোকামি। কিন্তু রাগের মাথায় এসব খেয়াল রাখাও কঠিন। সামনে বসে রাগে ঘোতঘোত করছিলো লোকটি; অন্য কোন অফিস হলে হয়তো অর্ধচন্দ্র পেয়ে যেত এতক্ষণে। ভর্তির প্রেসক্রিপশন লিখে রোগীনিকে ওয়ার্ডে নিতে অর্ডার দিয়ে অন্য রোগী দেখায় মনোযোগ দিলাম। এরমধ্যে লোকটি চেয়ার থেকে নড়লো না। তার মত করে বসেই আছে। সামনাসামনি হলেও ঐদিকে ভ্রূক্ষেপ না করাতে মিনিট পাঁচেক পরে চলে গেল। ঘন্টাখানেক পর একদল লোকসহ আবার এলো। কোন কথাবার্তা না বলে সোজা ইমার্জেন্সি রুমের ভেতর দিয়ে টয়লেটে গেল। কিছুক্ষণ পর কোনদিকে না তাকিয়েই চলে গেল। আমি অবশ্য এসব মনোযোগ না দিয়েই চিকিৎসা কাজে ব্যস্ত থাকি।
অনেকটা দেখেও না দেখার ভান করার মতই। এধরনের একটা ঘটনার পর সেবা দেবার মানসিকতা রাখা সাধ্যাতীত। তবুও হাসিমুখেই কথা বলা লাগে। বলার চেষ্টা ছিল, করেছিও। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে. মানসম্মত সেবার আশা করাও উচিত নয়।
জানতে পারলাম উনি ঐ এলাকার ওয়ার্ড মেম্বার। নতুন হইছেন। আমাদের গ্রামে একটা প্রবাদ আছে - নতুন চুল গজাইলে নাকি আয়না দিয়া দেখে। (প্রিয় পাঠক, দয়া করে জিজ্ঞাসা করবেন না কোথাকার চুল!) এখন ঐ লোকটার হয়েছে এই দশা। মেডিকেল সায়েন্স আমাদের শেখায় - রোগীর প্রাইভেসি ইম্পর্টেন্ট! কিন্তু উপজেলার হাসপাতালগুলোতে রোগীর প্রাইভেসি বলতে কিছুই থাকে না। (জেলা সদর.. কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে মেডিকেল কলেজেও না) চাইলেও চিকিৎসক সেটা নিশ্চিত করতে পারেন না। আবার উঠতি পাতিনেতাদের ভাবসাবও সহ্য করা লাগে ডাক্তারদের্।
পত্রিকায় দেখলাম ফরিদপুরে একজন ডাক্তার লাঞ্চিত হয়েছেন রোগীর লোকদের বাইরে যেতে বলাতে । ঠিক একই ঘটনা আমার বেলায়ও ঘটতে পারতো। পত্রিকার শিরোনাম হবার আগে মার খেয়ে ঐ হাসপাতালেই হয়তো ভর্তি হয়ে থাকা লাগতো। কিংবা কোন পত্রিকায় এই খবর প্রকাশও পেত না। হয়তো বিচার হতো। আবার হলেও সেটা আদালত কর্তৃক কিঞ্চিৎ শাসন ছাড়া আর কিছুই নয়। কিছুদিন আগে ময়মনসিংহে যা হয়েছে।
______________________________
লেখক ডা. সাজ্জাদ মাহমুদ । সুলেখক ।
আপনার মতামত দিন: