Ameen Qudir

Published:
2017-03-03 13:29:44 BdST

গরীবের টাকায় পড়াশোনাঃ একটি সামাজিক মীথ এবং কিছু বাস্তবতা




কাজী ওয়াসিমুল হক
______________________________


বাংলাদেশে দুই রকম ফতোয়া চালু আছে, প্রথমটা ধর্মীয়, শিকার মূলতঃ প্রত্যন্ত গ্রামের ‘ঢোড়া সাপ’ ক্যাটেগরি জনগণ, দ্বিতীয়টা সামাজিক, শিকার মূলতঃ আমাদের দেশের কিছু পেশাজীবি, যাদের মধ্যে ডাক্তাররা অগ্রগন্য।


‘আপনারা গরীবের টাকায় পড়াশোনা করেছেন’ এই জাতীয় ফতোয়া শুনেননি, এমন কোন ডাক্তার বাংলাদেশে আদৌ আছেন কি? সেই সাথে আরো যোগ হয়_ কাজেই আপনাদের উচিত গরীবদের ফ্রী দেখা, ইত্যাদি ইত্যাদি... ।


বাংলাদেশে এটা প্রায় ধর্মীয় বিশ্বাসের কাছাকাছি যে ডাক্তার এবং অন্যান্য পেশাজীবি, যারা পাবলিক ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন, তারা সেটা করেছেন গরীবের টাকায় (পারলে একেবারে দরিদ্র কৃষকের টাকায়!)। আসেন এবার একটু কাটাকুটি খেলি, আই মীন বিশ্লেষণ করি এইসব পেশাজীবিরা আসলে কাদের টাকায় পড়াশোনা করেছেন এবং এখনো করছেন।


প্রথম প্রশ্ন, গরীব কারা? না ভাই আমি কোন অর্থনীতিবিদ না, কাজেই খুব সহজ একটা সূত্র দিয়ে শুরু করি, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তাকেই গরীব বলা চলে যার মৌলিক চাহিদা মেটাতে সমস্যা হয়। আইফোন কিনতে পারেন না দেখে যদি নিজেকে ‘গরীব’ দাবী করেন, তাতে আমার যৌক্তিক আপত্তি থাকবে।


আচ্ছা সরকার জনগনের কাছ থেকে টাকা আদায় করে কিভাবে? প্রথমতঃ ইনকাম ট্যাক্স, দ্বিতীয়ত ভ্যাট, তৃতীয়ত বিভিন্ন প্রকার কর আদায়ের মাধ্যমে। বিগত ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের বাজেট ভাষনের সময় আমাদের অর্থমন্ত্রী সাহেব স্বীকার গেছেন যে আমাদের এই ১৬ কোটি লোকের দেশে ট্যাক্স দেন মাত্র ১২ লাখ (তাও নিয়মিত বা বড় অঙ্কের না)। বলাই বাহুল্য যারা ট্যাক্স দেন তারাও আবার চেষ্টা করেন আইনের ফাক গলে বেরিয়ে যেতে অথবা যথা সম্ভব কম ট্যাক্স দিতে। আমার এই লেখা প্রকাশের সময় বাংলাদেশে আয়করবিহীন বার্ষিক আয়ের পরিমান পুরুষদের জন্য ২,৫০,০০০/- (দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার) টাকা আর ৬৫ বছরের উর্ধ্বে এবং মহিলাদের জন্য ৩,০০,০০০/- (তিন লক্ষ) টাকা।


জেনে রাখা ভাল যারা এর উপরে আয় করেন, তারাও সবাই সুরসুর করে এসে সরকারকে ইনকাম ট্যাক্স দিয়ে যান না, এদের বেশীরভাগ লোকের টিন নাম্বারই নেই, এরা চান যতদিন সম্ভব গা ঢাকা দিয়ে থাকতে, বা নেহায়াত কর দিতে হলেও যথা সম্ভব কম দিয়ে পার পেতে। ইনকাম ট্যাক্সের আওতায় পড়ার জন্য (যদি তার আদৌ টিন নাম্বার থাকে) বর্তমানে বাংলাদেশে একজন পুরুষকে মাসে আয় করতে হবে গড়ে ২০,৮৩৩/- (বিশ হাজার আটশো তেত্রিশ) টাকার উপর আর মহিলাদের মাসে গড়ে ২৫,০০০/- (পচিশ হাজার) টাকার উপর।


কিউরিয়াস মাইন্ড ওয়ান্টস টু নো, বাংলাদেশের কোন ‘দরিদ্র’ কৃষক মাসে গড়ে এর চেয়ে বেশী আয় করেন কিনা, আর করলে তাকে আদৌ ‘গরীব’ বলা চলে কিনা, আর ‘গরীব’ বলা না চললেও তিনি ট্যাক্স দেন কিনা, আর দিলেও কত দেন? না আমি গ্রামের কৃষকদের উপর ট্যাক্স আরোপের কথা বলছি না, হাজার হোক কিছুদিন আগে আমাদের অর্থমন্ত্রী সাহেব এরকম একটা প্রস্তাব করে নিজ নামের স্বার্থকতা জাতির সামনে আরো একবার প্রমান করেছেন।


তো পয়েন্ট হচ্ছে, সরকার যেহেতু কৃষকদের কাছ থেকে ইনকাম ট্যাক্স পায়না বললেই চলে, তাহলে কাদের টাকায় পাবলিক ভার্সিটিতে পড়াশোনা চলে? একই সাথে আরো প্রশ্ন জাগতে পারে, কৃষক বাদে সাধারন জনগণ যারা আছেন, তারাও যেহেতু আয়কর বাবদ তেমন টাকা পয়সা দেন না, সরকার এত আয়কর পায় কোথা থেকে? চলে কিভাবে? কিভাবে আবার, বিভিন্ন (অভাগা) কোম্পানী, ব্যাঙ্ক এবং বিভিন্ন ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের উপর ভর করে! যারা জানেন না, এদের কাছ থেকে সরকার ২৫%-৪২.৫০% রেটে কর আদায় করে।


না এরাও খুশী মনে দেয়না, চেষ্টা করে কর ফাকি দিতে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আপনি যেমন বলতে পারেন না যে আপনার পোষা হাতি দিনে দুই প্লেট ভাত খায়, এরাও তেমনি চাইলেও একটা সীমার নিচে আর নামতে পারেনা, ফলাফল? বিশাল পরিমান ট্যাক্স! জী, আমরা জনগণ যে পরিমান ট্যাক্স দেই, তার চেয়ে হাজারগুন বেশী দেয় এইসব ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানগুলি। কাজেই আপনারা যারা বিভিন্ন পাবলিক ভার্সিটিতে পড়েছেন, তারা গরীবের টাকায় না পড়লেও এইসব বিভিন্ন ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের টাকায় অতি অবশ্যই পড়েছেন!


এবার আসি ‘ভ্যাট’ প্রসঙ্গে, এটা সবাইকেই দিতে হয় সত্য, কিন্তু কারা আসলে বেশী ভ্যাট দেন? গরীবেরা নাকি বড়লোকেরা? একজন বড়লোক প্রতিমাসে তার ইলেক্ট্রিক বিল, ফোন বিল, শপিং বিলে যে পরিমান টাকা ভ্যাট দেন, একজন গরীব কি তা দেন? কে বেশী বাজার করে? গরীব না বড়লোক? বাজারের মুদী দোকানদার ভ্যাট কাটে নাকি আগোরা/মীনাবাজার ?
সরকার কৃষকদের ব্যাবহার্য্য জিনিস এর উপর ট্যাক্স/ভ্যাট ধরে? শিওর? আমার যদি ভুল না হয়, বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জাম (যেমন সার) এর উপর ব্যাপক ভর্তুকি দিয়ে প্রতি বছর বিশ্ব ব্যাঙ্কের ধমক খায়। আরেকটা কথা , বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে যারা বাস করেন, তারা কি সবাই কৃষক? সবাই ‘দরিদ্র’? অন্য পেশার লোকেরা কই গেল? বিদেশে ছেলে মেয়ে পাঠিয়ে পায়ের উপর পা তুলে মাছের মাথা খাওয়া লোকেরাই বা কোথায় গেল?


এবার আসি বিভিন্ন করের প্রসঙ্গে, গ্রামের এবং শহরের জমির উপর প্লাস শহরের বাড়ীর উপর কর আছে সত্য, এখন শহরে কোন জমি/বাড়ির মালিককে যদি আপনাদের কারো কাছে ‘দরিদ্র’ মনে হয়, তাহলে ভাই গাজার কলিকাটা হাত থেকে আপাতত নামান, ঠিক হয়ে আবার পড়া শুরু করুন। গ্রামে ২৫ বিঘার নিচে যাদের জমি আছে, তাদের উপর সরকারী খাজনা নেই বললেই চলে, বাৎসরিক খাজনা যা আছে, এমনকি ২৫ বিঘা জমির ক্ষেত্রেও তার পরিমান আমাদের একবেলার চাইনীজ খাওয়ার টাকার চেয়ে বেশী হবেনা, এর চেয়ে ছোট সাইজের জমির কথা না হয় বাদই দিলাম!


এ পর্যন্ত লিখে আমার নিজের কাছেই কৌতুহল লাগছে, এই অবস্থায় ‘গরীবের টাকায় পড়াশোনা’ জাতীয় একটা মীথ কিভাবে আমাদের মধ্যে এতখানি শেকড় গারলো!
আচ্ছা এবার আসি ফিনিশিং স্টেটমেন্টে, ধরে নিলাম কোন ‘অজ্ঞাতভাবে’ বাংলাদেশ সরকার গরীবদের কাছ থেকেও টাকা আদায় করে, ঠিক আছে করে, তো সেই ‘গরীবদের’ টাকাই আলাদা করে কেবল পাবলিক ভার্সিটির ছেলে মেয়েদের পড়ার কাজে লাগায়, এই মহান তত্ব কোন কেতাবে আছে? আমার এই লেখায় ইতিমধ্যে দেখিয়েছি ঠিক কি কি কারনে বাংলাদেশ সরকার গরীবদের কাছ থেকে টাকাপয়সা পায়না বললেই চলে, আর যদি কোন ভাবে কিছু পেয়েই থাকে, সেটা যে একক ভাবে পাবলিক ভার্সিটিগুলিতে ছাত্র পড়ানোর কাজে ব্যাবহার করা হয়না, সেটা আশা করি ইতিমধ্যে সবার কাছেই পরিস্কার হয়েছে।
ধর্মীয় ফতোয়া থেকে আমরা অনেকাংশে মুক্তি পেয়েছি, সামাজিক ফতোয়া থেকে কবে পাব?

_____________________________

কাজী ওয়াসিমুল হক দেশের একজন তরুণ প্রথিতযশা আইনজীবী। ডাক্তারপরিবারের সন্তান।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়