Ameen Qudir

Published:
2017-02-28 20:02:09 BdST

এখন আমি কি করবো আপু?





মুশতারী মমতাজ মিমি, রমেক
_____________________________

ভোর সাড়ে পাঁচটা।রংপুর স্টেশনে ট্রেনের জন্য বসে আছি।গ্রামের বাড়ি যাবো।আব্বা ডাকছেন।উনি মাঝে মাঝে আমাদের তিন ভাইবোনের সাথে ছোট বাচ্চার মতো আচরণ করেন। বিশেষ করে আমরা যখন কাজের চাপে অনেকদিন বাড়ি যেতে পারি না তখন এই আচরণ আরো প্রকট হয় ওনার।এই যেমনটা গতকাল দুপুরেই হল।বৃহস্পতিবার হেলথ কমপ্লেক্সে রোগীর ভীড় বেশি হয়।তার উপর শনি,রবি দুইদিন সরকারী ছুটি পড়ায় লম্বা লাইন লেগে আছে।সকাল থেকে একটানা দেখছি তারপরেও শেষ হচ্ছে না।অফিসটাইম দুইটা পর্যন্ত।কিন্তু সব রোগী দেখা না হলে আমি অফিসটাইমের পরেও থাকি।সরকার এজন্য আমাকে এক্সট্রা বেতন দেয় না কিন্তু আমার মতো থানা লেভের মেডিকেল অফিসাররা প্রতিদিনই মানবতার কাছে হার মেনে বিনা বেতনে খানিকটা ওভারটাইম করে ফেলে।

সবেমাত্র রোগী দেখা শেষ হয়েছে এই সময়ে আম্মা ফোন দিলেন।
বৃহস্পতিবার এই সময়ে আম্মা ফোন করা মানে নির্ঘাত আব্বা আবার কোন ঝামেলা পাকিয়েছেন।আব্বা কোন কথাই নিজে পাড়েন না।আম্মাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন।
আম্মা বললেন আব্বার মনে হয়েছে তার বয়স বাড়ছে।যে কোন দিন তিনি মারা যেতে পারেন।তাই মারা যাওয়ার আগেই তিনি আম্মাকে নিয়ে মাস দুয়েক গ্রামে থাকতে চান।সকালবেলা আম্মাকে নিয়ে চলেও গেছেন।যাওয়ার পর তার মাথায় ভুত চেপেছে মারা যাওয়ার আগে উনি আমাদের নিয়ে ওনার সব আত্নীয়দের বাসায় ঘুরে বেড়াবেন।না হলে উনি মরেও শান্তি পাবেন না।

বুঝলাম আমাকে নেয়ার জন্য মরার কথা বলে ব্লাকমেইল করছেন আব্বা। আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে সরাসরি বললেই পারতেন।কিন্তু তাকে অজুহাত বানাতেই হবে।মাঝে মাঝে একটু আধটু রাগ ওঠে।কিন্তু আমার আব্বা একদম নিখাদ ভালবাসেন আমাদেরকে।এই বাচ্চামিগুলোর জন্য আমার জীবন দিয়ে দিতে পারি।রাগ দেখানো তো দূরের কথা।

জানুয়ারি মাস।প্রচুর কুয়াশা পড়েছে।শীতের কাপড় পড়ে টোপলা হয়ে আছি তাও শীত কাটছে না।পৌঁনে ছয়টায় ট্রেন এলো।মাঝামাঝি একটা কামরায় উঠলাম।পুরো কামরায় মাত্র পাঁচ-ছজন যাত্রী।এতো সকালে বিশেষ প্রয়োজন না থাকলে কে-ই বা ট্রেনে চড়ে!কামরার শেষ মাথায় একটা মেয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে।সাথে একটা বড় ব্যাগ।খানিকটা অবাক হলাম।এতো সকালে আঠারো-বিশ বছরের মেয়ে একটা একা ট্রেনে উঠেছে ব্যাপারটা খটকা লাগার মতোই।আজকাল অবশ্য অভিভাবকরা মেয়দেরকে অনেক স্বাধীনতা দেন।এটাও তেমন কেসই হবে হয়তো।

এগিয়ে গিয়ে ওর মুখোমুখি সিটে বসলাম।মেয়েটা আমার দিকে চেয়ে একটু নড়েচড়ে বসলো।আমি মোবাইলে গেম খেলা শুরু করলাম।একটু পর দেখি মেয়েটা ঠকঠক করে কাঁপছে।বাইরে এতো শীত পড়বে মেয়েটা হয়তো ভাবেই নি।মায়া হলো আমার।আম্মার জন্য একটা ভারী শাল কিনেছিলাম।ব্যাগ থেকে ওটাই বের করে দিলাম ওকে।কোনরকম সংকোচ ছাড়াই মেয়েটা শাল গায়ে জড়িয়ে নিলো। আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো- কই যাবেন আপু?
-পীরগাছা।
-এতো সকালে যে!
-আব্বা-আম্মা ডাকছেন।আমি জব করি তো!ছুটি পাই না।তাই খুব সকালেই বের হলাম।তুমি কই যাবে?
মেয়েটা ইতস্তত করে বলল-বাসায়।
-বাসা কই তোমার?
-জ্বি,গাইবান্ধা।
-এদিকে এসেছিলে কেন?
-আমি সেকেন্ড টাইম কোচিং করছি রংপুরে।
-এতো সকালে যে যাচ্ছো বাসায় জানে?
-হুম জানে।

তারপর অনেক্ষণ কোন কথা নেই।আব্বা-আম্মা ফোন করে করে অস্থির করে দিচ্ছেন।এতো সকালে একলা বের হয়েছি এই ভয়ে তারা ফোনের পর ফোন দিচ্ছেন।যেন কথা বললেই আর কোন বিপদ থাকবে না।

মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে।একটু পর দেখি কাঁদছে।মনে হলো আমার কাছে বাবা-মার এতো ফোন আসা দেখে ওর খারাপ লাগছে।বললাম- খারাপ লাগছে?
ও জবাব দিলো না।
-বাবা-মা ফোন করছে না বলে মন খারাপ?
দূর্বল গলায় বলল-না আপু।
-পাগল মেয়ে।ফোন দিচ্ছে না তো কি হয়েছে!গিয়ে দেখো ঠিকই টেনশনে অস্থির হয় আছেন।বাড়ি গিয়ে দেখবা আন্টি কত কত খাবার রেঁধে বসে আছেন।
-হুম।

এক তরফা আর কত কথা বলা যায়!চুপ মেরে গেলাম।একটু পর কাউনিয়া স্টেশনে ট্রেন থামলো।ইঞ্জিন চেঞ্জের জন্য মিনিট পনের থেমে থাকবে এখানে।এদিকে মেয়েটা কেঁদেই চলছে।আমি ট্রেন থেকে নেমে দুজনের জন্য কিছু খাবার আর কফি আনলাম।মেয়েটা হয়তো কিছুই খায়নি।কিন্তু ও এরকম ব্যবহার করছে কেন বুঝলাম না।মনে হচ্ছে কি একটা অপরাধ করে ফেলেছে।

ট্রেনে উঠে ওকে কফি ধরিয়ে দিয়ে বললাম-খাও।ভাল লাগবে।
মেয়েটা চুপচাপ কফি আর খাবার শেষ করলো।
বললাম-এখন একটু ভাল লাগছে?
-হুম আপু।
-কেন কাঁদছিলে?
-আপনার বাবা-মা আপনাকে অনেক ভালবাসে তাই না?
-কার বাবা মা বাসে না?পাগল..
-আপনাকে একটা কথা বলবো?
-বলো..
-আপু আমি বাসায় যাচ্ছি না।আমিও পীরগাছায় যাচ্ছি।আমার বয়ফ্রেন্ডের কাছে।ও ওখানে চাকরি করে।আমি মেস থেকে পালিয়ে এসেছি।বাসা থেকে মেনে নিচ্ছে না জন্য পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।

এবার বুঝলাম ব্যাপারটা।আবেগের বসে দুম করে বের হয়ে তাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো,এখন দোনমনায় পড়ে গেছে।
-আপনি আমাকে খারাপ ভাবছেন তাই না?
-তা কেন ভাববো?চলে যাচ্ছ যে বাসায় জানিয়েছো?
-নাহ।
-তোমার কি একবারও মনে হলো না যে তুমি ভুল করছো?
-ওতো কিছু ভাবিনি আপু।
-এতো সকালে তোমার বাবা-মা তোমাকে একা ছাড়তো?
-না আপু।
-তোমার বয়ফ্রেন্ড ছেলে মানুষ। ওরই তোমাকে নিতে আসার কথা ছিলো।তা তো আসেই নি উল্টো এতো সকালে তোমাকে আসতে allow করলো!
-আচ্ছা ছেলেটা যদি আজ তোমাকে বিয়ে না করে,তোমার কোন ক্ষতি করে ছেড়ে দেয়?কি করবা তুমি?
-এটা তো মাথায় আসেনি আপু।
-ছেলেটা তোমাকে কত বছর ধরে ভালবাসে?
-দু বছর।
-তোমার বয়স কতো?
-আঠারো।
একটা ছেলের দু বছরের প্রেমের জন্য তুমি বাবা-মার এতো বছরের আশা-ভরসা আর ভালবাসাকে জলাঞ্জলি দিচ্ছো?
ওনারা তোমার কাছে এতই তুচ্ছ?
মেয়েটা কেঁদেই চলছে।
-পালিয়ে না হয় বিয়ে করলে ছেলের পরিবার যদি মেনে না নেয়? আর মেনে সারাজীবন উঠতে বসতে খোঁটা খেতে খেতে জীবন যাবে তোমার ।ভালো লাগবে সেসব?
-না আপু।
-সমাজে তোমার বাবা-মা কতোটা ছোট হয়ে যাবেন ভেবেছো একবারও?পড়াশোনা ছেড়ে করে বিয়ে করছো।রান্নাঘরের জানালা দিয়ে ভালবাসা বেড়িয়ে যাবে কিছুদিন পর।বাবা-মার দোয়া ছাড়া সুখী হওয়া যায় না কোনদিন।

মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরল।বললো-এখন আমি কি করবো আপু?
ট্রেন তখন অন্নদানগর স্টেশনে থামছিলো।তারপরেই পীরগাছা।মেয়েটাকে বললাম চলো এখানেই নেমে যাই।এদিক দিয়ে আমার বাসায় যাই।বিকেলে আমি রংপুর ফিরবো।একসাথে আসা যাবে।কি বল?পীরগাছায় নামলে তো তোমার বয়ফ্রেন্ড তুলে নিয়ে যাবে।হাহাহা...
মেয়েটা এবার জোরে হেসে দিলো।ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বলল-আপু চলেন।
আমরা নেমে গেলাম।ট্রেন স্টেশন ছাড়লো।মেয়টা সেদিকে ফিরেও তাকালো না।
একটা প্রেম ভেঙে দেয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তা আমাকে ক্ষমা করবেন কিনা আমি জানিনা তবে একটা পরিবারের মানসম্মান আর বাবা-মার ভালোবাসা বাঁচিয়ে দিলাম বলে নিজেকে হালকা লাগছে আমার। মেয়েটা শক্ত করে আমার হাত ধরে রেখেছে।আমি হাতে আলতো চাপ দিয়ে বললাম-"সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে আপু।পৃথিবীতে ভালবাসার জন্য অনেক মানুষ অনেক পাবে,বাবা-মা কিন্তু একজন করেই।"
মেয়েটা মাথা নেড়ে হাসলো।অদ্ভুত সুন্দর সে হাসি।কে বলবে এই সুন্দর মেয়েটাই একটু আগে বিশাল একটা ভুল থেকে বেঁচে ফিরলো!

________________________________

মুশতারী মমতাজ মিমি
। Studied Bachelor of Medicine and Bachelor of Surgery(MBBS) at Rangpur Medical College

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়