Ameen Qudir

Published:
2017-03-11 16:09:10 BdST

ভাষার যৌনবাদের শিকার নারীরাই





ডা. মোরশেদ হাসান
____________________________

ভাষার জন্ম যাঁদের হাতে আমরা সেই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর কাছে অসম্ভব কৃতজ্ঞ । কিন্তু বাংলাভাষায় যে লিঙ্গীয় বৈষম্য আছে তা আপনাকে স্বীকার করে নিতে হবে। এখানে এমন কিছু শব্দ আছে যা বাংলা ব্যাকরণে নিত্য- স্ত্রীবাচক শব্দ হিসেবে পরিচিত। যেমন, ডাইনী, সতীন, সৎমা, দাই, অর্ধাঙ্গিণী, কুলটা, অসূর্যস্পশ্যা, শাকচুন্নী, অরক্ষণীয়া ইত্যাদি। এই শব্দগুলো মতাদর্শ অনুযায়ী নারীর জন্য নেতিবাচক, অবজ্ঞা বা হেয়কারী গুণাবলী ধারণ করে।


ভাষা যখন লিঙ্গীয় বৈষম্যময় আচরণ সম্পর্কে নীতিমালা বা কার্যকারিতাকে ধারণ করে তখনই নারীবাদীরা তাকে যৌনবাদী ভাষা বলেন।

‘যৌনবাদ’ শব্দটা হচ্ছে ভাষিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চর্চা যা সরাসরি নেতিবাচকভাবে নারীর বিপক্ষেই যায়। বর্ণবাদ বললে যত সহজে বিষয়বস্তু সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে ভাষিক যৌনবাদ বললে লিঙ্গীয় বৈষম্যের বিষয়টি তত সহজে অধিপতি বা কর্তা মতাদর্শে বসবাসকারী এ সমাজের মানুষের কাছে সেভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। কিন্তু স্পষ্টতই নারীবাদীরা বলছেন ভাষায় যৌনবাদ হলো নারীর বিরুদ্ধে ভাষার বৈষম্যমূলক প্রয়োগ ও চর্চা যেখানে নারীর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয় না, নারীর অভিজ্ঞতা স্থান পায় না এবং নারীকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়।


এ সমাজে জীবনসঙ্গী হিসেবে স্ত্রীকে স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী বলা হয়। অথচ জীবনসঙ্গী হিসেবে পুরুষ কিন্তু কখনোই স্ত্রীর অর্ধাঙ্গী নয়। এভাবেই ভাষিক লিঙ্গীয় বৈষম্যের মাধ্যমে নারীকে পদে পদে সামাজিক বৈষম্যের শৃঙ্খল পরানো হচ্ছে।


এছাড়া ভাষায় যৌনবাদের ব্যবহারও আছে যার প্রত্যক্ষ শিকার হচ্ছে নারীরাই। যৌনবাদী ভাষার সরাসরি প্রকাশ ঘটে অশ্লীল গালিগালাজ বা খিস্তি খেওড়ের মাধ্যমে। যদিও পুরুষকেই এই গালিগালাজ করা হয় কিন্তু গালিগালাজ বা খিস্তি খেওড়গুলোর প্রকাশভঙ্গি হয়ে থাকে নারীকে কেন্দ্র করেই। এখানে পুরুষকে গালি দেওয়া হয় তার সকল নারী আত্মীয়দের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ইঙ্গিত দিয়ে কিংবা তাঁদের যৌনাঙ্গ নিয়ে ।


পুরুষের জন্ম পরিচয় নিয়ে গালির ক্ষেত্রে সবসময়ই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয় তার মায়ের চরিত্র, কখনোই বাবার চরিত্র আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয় না । গালি দেওয়ার সময় চরম তৃপ্তি পাওয়ার মোক্ষম উপায় হলো ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাবিহীন নারীকে যে কোনভাবে টেনে নিয়ে আসা ; না হলে গালি-গালাজ বা খিস্তি খেওড় করে আবার তৃপ্তি কীসের? এই ভাষিক লিঙ্গীয় বৈষম্যের শিকারে পরিণত হওয়া নারীকে পথে ঘাটে এমনকি কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীর মুখেও প্রকাশ্যে বা অগোচরে শুনতে হয় ‘মাল’ বা ‘মাগী’ শব্দ।


আক্রমণাত্মক ভাষার অর্থও লিঙ্গভেদে পরিবর্তিত হয়ে যায়। যেমন, ‘তোরে খাইছি’-এ কথা পু্রুষের জন্য শারীরিক আক্রমণ বা প্রাণনাশের হুমকি হলেও নারীর ক্ষে্ত্রে এর অর্থ কিন্তু যৌন আক্রমণ । এছাড়া শ্রেণিকক্ষের টেবিলে, বেঞ্চিতে, বাসের সিটের পেছনে কিংবা পাবলিক টয়লেটের দেয়ালে যে অশ্লীল মন্তব্য বা ছবি আঁকা থাকে তা নারীকে উদ্দেশ্য করেই লেখা হয়। এভাবেই সমাজে ভাষিক যৌনবাদের শিকার হচ্ছেন নারীরা ।


‘সতী’ শাব্দিক অর্থে কখনোই ‘সৎ’ শব্দটির সমার্থক হতে পারে না। সতী দ্বারা কী বোঝানো হয়? বোঝানো হয় মেয়েটি বিয়ের পূর্বে কুমারীত্ব রক্ষা করে চলেছে এবং বিয়ের পর সবসময়ই স্বামীর প্রতি সকল অর্থে বিশ্বস্ত থেকেছে। পক্ষান্তরে একজন পুরুষের ক্ষেত্রে ‘সৎ’ শব্দটি যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একগামীতা বোঝায় না বরং তার সততার পরিসর অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত । সমাজে নারীর জন্য ‘সুন্দরী’, ‘আদুরে’, ‘মমতাময়ী’,‘মায়ের মতো’, ‘সহিষ্ণু’, ‘কোমল’, ‘ত্যাগী্’, ‘হিংসুটে’,‘অযৌক্তিক’, ‘বোকাসোকা’ এইসব গৎবাঁধা ভূমিকার বিপরীতে পুরুষ হলো ‘কঠোর’, ‘বুদ্ধিমান’, ‘সাহসী’, ‘শক্তিশালী’,‘সবজান্তা’, ‘অর্থনৈতিক নেতৃ্ত্বদানকারী’,‘ব্যবস্থাপক’ প্রভৃতি অনুপম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যা অবশ্যই নারীর ভূমিকা হতে মর্যাদাসম্পন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ। এই আরোপিত নারীসুলভবৈশিষ্ট্যগুলো নারীকে এ সমাজে গৎবাঁধা ভূমিকাতেই শুধু আবদ্ধ করে দেয় এবং এইসব আরোপীয় সত্তার বাইরে নারীর প্রতিরোধী,কর্মঠ, বলিষ্ঠ চেহারা এই সমাজের কাছে মেয়ে মেয়ে সুলভ নয় বরং কর্কশ কিংবা ব্যাটা ব্যাটা স্বভাবের প্রকাশভঙ্গি।


যৌনপেশা গ্রহণে বাধ্য নারী প্রচলিত ভাষাচর্চায় ‘বেশ্যা’, ‘পতিতা’,‘নষ্টা’, ‘খারাপ মেয়ে’ নামে সমাজে আখ্যায়িত। ‘বেশ্যা’,‘পতিতা’, ‘নষ্টা’, ‘খারাপ মেয়ে’ শব্দগুলো দিয়ে প্রচলিত সমাজের মতাদর্শ অবলীলায় প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত বিশেষণে ভূষিত নারী কোথায় থাকে? থাকে বেশ্যাপাড়ায় এবং এই শব্দগুলো তৈরি করেছে আমাদের এই পুরুষশাসিত সমাজ। অথচ সেই একই বেশ্যাপাড়ায় যে পুরুষগুলো শারীরিক তাড়না মেটাতে যায় তাকে এই সমাজ চোখে আঙুল দিয়ে চেনানোর জন্য সমান মূল্যবোধ তাড়িত শব্দ তৈরি করে না। বরঞ্চ সে পুরুষের জন্য তৈরি করে রেখেছে ‘খদ্দের’ নামক অতি নিরীহ একটি শব্দ, যে শব্দ দ্বারা ভিন্ন আঙ্গিকে পণ্য হিসেবে নারীর উপস্থিতিকেই পুনরায় ইঙ্গিতদান করা হয়।


এমনকি পরিবারের মধ্যেও যে স্ত্রী তাঁর স্বামীর প্রতি একান্ত একনিষ্ঠ তাকে এ সমাজ ভাষিক উপাধি দিয়েছে ‘পতিব্রতা’ এবং এটা তার জন্য প্রশংসনীয় একটি উপাধি অথচ পাশাপাশি যে স্বামী তাঁর স্ত্রীর কথা মেনে চলে তার জন্য এ সমাজের ভাষিক উপাধি হচ্ছে ‘স্ত্রৈণ’ বা ‘ভেড়ুয়া’ আর এটা বলার অর্থ হচ্ছে তার পৌরুষত্বকে আঘাত করা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে একই ভাবসম্পন্ন দুটি শব্দ ভাষিক লিঙ্গীয় বৈষম্যের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ বিপরীত মর্যাদার অর্থময়তার সৃষ্টি করে ।


এ সমাজে পত্রিকা খুললেই দেখা যায় নারীকে শারীরিকভাবে ধর্ষণের সংবাদ। ধর্ষণ হলো নারীর ওপর শারীরিকভাবে চূড়ান্ত যৌন নিপীড়ন। কিন্তু পাশাপাশি ধর্ষণের প্রতিশব্দ হিসেবে আমরা দেখি কিছু শব্দ ‘শ্লীলতাহানি’, ‘সম্ভ্রমহানি’, ‘ইজ্জতহানি’, ‘বলাৎকার’। এ পুরুষবাদী সমাজে নারীরা এখনো পথে ঘাটে নিরাপদ নয়। কিছু পুরুষরূপী হিংস্র হায়েনার কাছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এরকম একটি দুর্ঘটনায় তার ইজ্জতকে কেন আমরা ভাষিকভাবে‘হানি’ বলছি? কেন বলছি সম্ভ্রমহানি?
একজন পুরুষও কিন্তু পাঁচজন সমকামী পুরুষ দ্বারা ধর্ষণের শিকার হতে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনি কখনোই পত্রিকার শিরোনাম হতে দেখবেন না ভিকটিম সেই পুরুষটির ক্ষেত্রে ইজ্জতহানি বা সম্ভ্রমহানি শব্দটির প্রয়োগ। তার পরিবর্তে দেখবেন ‘শারীরিকভাবে নির্যাতনের সংবাদ’। তাহলে ব্যাপারটি কী দাঁড়ায়? নারীর ইজ্জত বা সম্ভ্রম কি তবে বিশেষ কোনো কুঠুরিতে লুকায়িত থাকে? এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীকে যদি ভাষিক লিঙ্গীয় বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয় তবে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না।


আসুন আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমরা সবাই এই ভাষিক লিঙ্গীয় বৈষম্যের প্রতিবাদ করি। নারী-পুরুষ মিলিয়েই তো একটি সমাজের কাঠামো তৈরি হয়। অতএব আজ সময়ের দাবি সমস্ত ভাষিক লিঙ্গীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সচেতন হওয়া।
_________________________

লেখক ডা. মোরশেদ হাসান ।
Works at Medical College, Assistant Professor.
Past: Works at Ministry of Health, Maldives and ICDDR,B

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়