Saha Suravi
Published:2025-02-05 12:20:08 BdST
শংকরের বিয়ে আটকে গেল : যেদিন লেখা শেষ হল,সেদিন তিনি বিয়ে করতে চললেন
ডেস্ক
_____________________
তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস 'চৌরঙ্গী' ধারাবাহিক ভাবে শুরু হল ১৯৬১ সালে তবে সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কড়া শর্ত লেখার সময় চঞ্চলমতি হওয়া চলবে না। অগত্যা শংকরের বিয়ে আটকে গেল। যেদিন লেখা শেষ সেদিন তিনি বিয়ে করতে চললেন। প্রথম উপন্যাস 'কত অজানারে' লিখে পেয়েছিলেন ২৮৫ টাকা। সেই টাকায় বাড়িতে বিদ্যুৎ আসে। কালক্রমে বনগাঁর ইছামতি ও হাওড়ার গঙ্গা দিয়ে অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে। বনগাঁর ছেলে শংকর হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা লেখক। শুধু লেখক বললে ভুল হবে বেস্টসেলার, বাংলা সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি।
ডালহৌসি পাড়ায় একদিন এক বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা,জানতে চাইলেন 'দেশ' পত্রিকার লেখাটা সে লিখেছে কিনা! লজ্জা একেবারে লাগেনি তা নয়, কিন্তু স্বীকার করতে হল। বন্ধুটিও আচমকা একটা কাগজ বের করে বলল 'অটোগ্ৰাফ' দে। মনে হয়েছিল সে ব্যাঙ্গ করছে! অচিরেই ভুল ভাঙল, নিজের মুখে সে বলল তুই কোথায় উঠে যাচ্ছিস তা তুই নিজেই জানিস না। দে একটা সই, একদিন বলতে পারব 'শংকর' এর প্রথম অটোগ্ৰাফটা আমার কাছে আছে। কিন্তু সাহিত্যের অঙ্গনে কিভাবে প্রবেশ করলেন তিনি, কিভাবে হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের বেস্টসেলার লেখক।
১৯৫৩ সালের অগস্ট মাসে বারওয়েল সায়েব মাদ্রাজে মামলা করতে গিয়ে হার্ট অ্যাটাকের বলি হলেন। নিজের প্রিয় কর্মীর জন্য ছোট্ট একটা চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিলেন । কয়েক মাস দু’টো কাজই করতেন। কিন্তু নতুন জায়গায় পদে পদে কনিষ্ঠ কেরানির অবহেলা ও অবমাননা। মনের দুঃখ মুছে ফেলার জন্যে চুপিচুপি লেখক হওয়ার মুসাবিদা শুরু হল। উৎসাহ দিতেন সহকর্মী আর এক কেরানি ভবানী ঘোষ। তিনিই এক দিন তাঁর বন্ধু ও লেখক রূপদর্শীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের টেবিলে বসে। বললেন, এই ছোকরার যে সব ঘটনা রয়েছে, তা এক দিন পাঠকদের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। শংকরের কয়েকটি কথা শুনে গৌরকিশোর বলেছিলেন "আপনার লেখাগুলো নিয়ে একদিন আসুন, আমি আপনাকে দেশ পত্রিকার সাগরময়বাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো"।
সাগরময় ঘোষ বলেছিলেন লেখাটা রেখে যেতে কিন্তু তিনটি সপ্তাহ যেন কোনও ভাবে তাঁকে জ্বালাতন না করা হয়। মনে মনে প্রবল উত্তেজনা অনুভব করেছেন আবার প্রশমিত করার চেষ্টা করেছেন । একদিন চলে এলেন বর্মন স্ট্রিটে,সাগরময় বললেন এতদিন কোথায় ছিলেন? আমরা খোঁজ করছি,অথচ আপনি পাণ্ডুলিপিতে নিজের ঠিকানাটুকু লেখেন নি। 'দেশ' পত্রিকার সম্পাদক বসতে বললেন, চায়ের প্রস্তাব করলেন। স্বয়ং সম্পাদক মহাশয়ের দপ্তরে বসে সসম্মানে চা পান একজন নতুন লেখকের জীবনে কতবড় প্রাপ্তি অনুধাবন করতে ভুল হয়নি শংকরের। তাই তিনি লিখেছেন " হে ঈশ্বর,আমার কপালে এতো সুখের সম্ভাবনা ছিল"!
মনিশংকর মুখোপাধ্যায়ের পিতা হাওড়ার বাড়িতে তাদের অনাথ করে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আটটি নাবালক সন্তানের মা জননী শান্তভাবেই পুত্র মনিশংকরকে বলেছিলেন তোমাকে এবার কিছু রোজগার করতে হবে। এই শহরে আমি কাউকে চিনি না তোমাকে নিজের পথ খুঁজে নিতে হবে। জীবনের যুদ্ধে লড়াই করতে রাস্তায় কাপড়কাচা সাবানের বিক্রিওয়ালা হয়েছেন। পিতৃদেব হরিদেব বনগ্ৰাম মহকুমা আদালতের আইনজীবী, মফস্বলের দাঁড়িপাল্লায় নিঃসন্দেহে কৃতী আইনজীবী, কিন্তু সাহিত্যের প্রতি তাঁর ঝোঁক নেহাত কম ছিল না। বনগ্ৰামে বা বনগঁয় জন্ম শংকরের। দীর্ঘদিন ভাড়াবাড়িতে বসবাস করার পরে পিতৃদেব হরিপদ মুখার্জি নিজে একটা বাড়ি করতে চাইলেন। কিন্তু চাইলেই তো হয় না, পোস্ট অফিসে আছে মাত্র কয়েকশো টাকা। জাহান আলি বিশ্বাস বলে এক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী লিচুতলার আড্ডায় আসতেন। তিনি জানালেন দাম পরে দিলে হবে, ইঁট,সুরকি, সিমেন্ট তিনি দেবেন। বাড়ির কাজ শুরু হল। ওই বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে দেশছাড়া হতে হত হরিপদ উকিলকে। শিয়ালদহ স্টেশনে হরিপদ বাবুর সাথে দেখা এক মুন্সেফ সাহেবের। তিনি বললেন আপনি মহকুমা থেকে বড় জায়গায় চলে আসুন আপনার যথেষ্ট প্রতিভা আছে। বিচারক জানালেন তিনি এখন হাওড়ায় জজ, হরিপদ বাবুকে তিনি সাহায্য করতে পারবেন যাতে তাঁর মাসে দুশো- আড়াইশো রোজগার হয়। তাঁর হাতে একটা জমিদারি মামলা আছে রিসিভার নিয়োগ করা হবে। তিনি যেন দিন দুই- তিনের মধ্যে হাওড়া কোর্টে নিজের নাম লেখান এবং তাঁকে খবর দেন। শংকরের বয়স তখন মাত্র পাঁচ তিনি হাওড়ামুখী হলেন ভায়া শিয়ালদহ। তখন যারা শিয়ালদহ স্টেশনে যারা নামতেন তাদের কে বাঙাল বলা হত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি আক্রমণের ভয়ে পরিবারের সবাই বনগাঁ ফিরে গেলেও শংকর তাঁর বাবার সঙ্গে থেকে যান হাওড়াতেই। কিন্তু স্বাধীনতার বছরে পিতৃবিয়োগ হয় মণিশংকরের। তিনি লিখেছেন তাঁর যে লেখক হয়ে ওঠা তার আদিতে শিক্ষক সুধাংশুশেখর। তিনি দেখেছেন পিতার মৃত্যুর পরে ছাত্র শংকরের দুঃখ। তাঁর স্কুলের বেতন মুকুব করে দেন। আরও একজন আছেন লেখকের জীবনে তিনি বিভূতিদা। তাঁর অন্ধবিশ্বাস বারওয়েল সাহেবের সংস্পর্শে যিনি আসবেন তাঁর জীবনে সোনা ফলবে। রিপন কলেজে পড়েছেন শংকর। বারওয়েল সাহেবের চেম্বারে শংকরের নতুন জন্ম হয়। একটু বেপরোয়া হয়ে পাকা চাকরি ছেড়ে সত্তর বছরের বৃদ্ধ ব্যারিস্টার এর বাবুগিরি করতে চলে এলেন কলকাতা হাইকোর্টের আদালতী কর্মক্ষেত্রে। বারওয়েল সাহেবকে যেমন ভালবেসে ফেললেন তেমন শ্রদ্ধা করতেন।তাঁকে নিয়েই লিখে ফেলেন আস্ত একটি উপন্যাস, ‘কত অজানারে’।
লেখক শংকরের জীবনের সুখস্মৃতি দেশের পাতায় এক সঙ্গে ধারাবাহিক লিখেছেন বিমল মিত্রের সঙ্গে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ শংকরের 'চৌরঙ্গী' বিমল মিত্রের 'কড়ি দিয়ে কিনলাম'। অনেক সময় এক টেবিলে কিস্তি লেখা হয়েছে ন্যাশনাল লাইব্রেরির রিডিং রুমে। শংকরের জীবনের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘চৌরঙ্গী’। ১৯৬২ সালে এটি প্রকাশের পর অভাবনীয় সাড়া ফেলে দেয়। পাঠক তাঁকে চিনতে শুরু করে তখন থেকেই। উপন্যাসটি এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে ভারতীয় বিভিন্ন ভাষার পাশাপাশি বিদেশি বিভিন্ন ভাষাতেও তা অনূদিত হতে থাকে।
শংকরের প্রথম উপন্যাসের নামকরণ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র। অন্নদাশঙ্কর রায় কে প্রথম উপন্যাসের একটি কপি পাঠিয়ে ছিলেন। আশীর্বাদের সঙ্গে তিনি লিখেছিলেন " আপনার প্রথম সাফল্য যেন জীবনের শেষ সাফল্য না হয়"। তবু অনেকেই তাঁর বিরূপ সমালোচনা করেছেন। বিশেষত সাহিত্যিক মহল থেকে ধেয়ে আসে ব্যাঙ্গাত্মক কুৎসা উকিলের মুহুরী একখানা গল্প ভগবান তৈরি করে দিয়েছিলেন,লিখে ফেলেছে। জীবন সংগ্রামের সৈনিক শংকর তখন ' কত অজানারে ' লিখে ২৮৫ টাকা পেলেন সেই টাকায় বাড়িতে বিদ্যুৎ এল। এমনকি চৌরঙ্গী’-র সাফল্যের পরেও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছে, এ সবই বানানো। হাওড়ার কানাগলিতে বিদ্যুৎবিহীন বাড়িতে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ফাইভ স্টার গল্প কী করে লেখা হয়? নিশ্চয়ই কোনও বিখ্যাত সায়েবের অখ্যাত ইংরিজি বই থেকে চুরি করা! এরপর বনগাঁর ইছামতি ও হাওড়ার গঙ্গা দিয়ে অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে। কালক্রমে উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর ছেলে শংকর হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা লেখক। শুধু লেখক বললে ভুল হবে তিনি সবসময় বেস্টসেলার লেখক। আজকের মত এক ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যের সেবা করেছেন দীর্ঘদিন, দীর্ঘ অনেকগুলো বছর। নিশ্চিত ভাবে কালজয়ী তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি। লেখক শংকরের জন্মদিন চলে গেল ৭ ডিসেম্বর তাঁর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও জন্মদিবসের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
সংকলনে ✍???? অরুণাভ সেন।।
পুস্তক ঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার, চরণ ছুঁয়ে যাই, শংকর
আপনার মতামত দিন: