DESK

Published:
2025-03-08 12:20:50 BdST

স্মৃতি অমলিন : লন্ডনের এক আড্ডায় শরীফ ভাই জিজ্ঞেস করলেন, "হু অ্যাম আই"


 

রাজিক হাসান , লন্ডন থেকে
______________________
·
লন্ডনের এক আড্ডায় শরীফ ভাই জিজ্ঞেস করলেন, "হু য়াম আই?" উপস্থিত সবাই জানালেন, এই প্রশ্নটির কোন সদুত্তর নাই। আমরা কেউ জানি না, আসলে কে আমি। শরীফ ভাই লন্ডন কিংস কলেজের প্রফেসর। সেদিন আমি তাকে একটি উত্তর দিয়েছিলাম,
"আই য়াম আ ক্রিয়েটিভ, ইন্টেলিজেন্ট, কমপেশনেট এন্ড অডারলি এনিম্যাল। ইন মাই মাইন্ড য়াম ফ্রি টু থিঙ্ক এবাউট এনিথিং আই ওয়ান্ট। আই য়াম লয়াল টু থ্রি থিংস, ফার্স্ট টু মাই ফ্যামিলি, সেকন্ড টু হিউম্যানিটি এন্ড ফাইনালি টু দ্যা ট্রুথ।"
শুনে শরীফ ভাই বলেন, "ওয়েলডান রাজিক, আপনার ভিত্তি হয়ে গেছে, এখন এর উপর প্রাসাদ নির্মাণ করেন।"
মনে আছে, ২০০১ সালের কথা, আমি তখন লণ্ডনের থেমস নদীর পাড়ে শেয়ারস্মিথ হাউজের ২১ তলায় বাস করি। ঘরের দুই দিকের দেয়াল মোটা কাঁচের তৈরী। পর্দা সরালে অর্ধেক লন্ডন দেখা যায়। ছোট্ট একটা বারান্দা। সেখানে দাঁড়ালে দেখা যায় থেমস নদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে লন্ডনের হাজার বছরের ঐতিহ্য টাওয়ার ব্রিজ। গভীর রাতে বারান্দায় দাঁড়ানো একটা নেশা হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো পিঙ্ক ফ্লোয়েডের লার্নিং টু ফ্লাই গানটি ফুল ভল্যুয়েমে ছেড়ে বারান্দা থেকে একটা উড়াল দেই।
২০০১ সালের ১লা সেপ্টম্বর টুইন টাওয়ারে যখন হামলা চালানো হয়। সকাল নয়টায় বিবিসির নিউজ দেখছি। অফিস যাবো, ব্রেকফাস্ট তৈরী করছি ঠিক এমন সময় নিউজটি পেলাম। নিজের চোখেই দেখলাম সেই ধ্বংসযজ্ঞ। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল আমার।
নিউজ পেপারের দেখলাম লন্ডনের কিছু উঁচু ভবনও আছে তালিকাতে। যে কোন মুহূর্তে আক্রমণ হতে পারে। সময় নষ্ট না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম। শুনলাম আমার বন্ধু যীশু (কর্নেল তাহেরের ছেলে) ও শুভ স্কটল্যান্ড যাচ্ছে কয়েক মাসের জন্য। আমি চাইলে ওদের ব্রিকলেইনের বাড়িটি ভাড়া নিতে পারি। বাড়ির মালিক দিলি মিয়া তখন বাংলাদেশে। আমি যীশু ও শুভর কাছে থেকে বাড়িটি ভাড়া নেই। এক বেড রুমের বাড়ি। গ্রাউন্ড ফ্লোরে।
প্রিন্সলেট স্ট্রিটের ফ্লাট ওয়ান হয়ে উঠল আমার নতুন ঠিকানা। সেইসঙ্গে আমার জীবনের নতুন যুগের সূচনা। বাড়ির মালিক দিলি মিয়া একজন মিউজিসিয়ান। তখন তাঁর নতুন এলবাম বেরিয়েছে ডান্সিং ইন দ্য ফায়ার। আমার সাথে দিলি ভাইয়ের সখ্যতা হতে সময় লাগে নি। দিলি ভাইয়ের কাছেই শুনেছিলাম ফেরদৌস ওয়াহিদের ছেলে হাবিব একসময় বাস করতো এই ফ্লাট ওয়ানে। হাবিব মিউজিকের বেসিকটা গড়ে নিয়েছিল সেখানেই।
দিলি ভাই এক শুক্রবার দুপুরে এসে বললেন চলেন শরীফ ভাইয়ের বাসায় যাই আজ সন্ধ্যায়। আমি জিজ্ঞেস করি শরীফ ভাই কে? তিনি বললেন, প্রফেসর শরীফ। তিনি কিংস কলেজে পড়ান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের ছোট ছেলে। সন্ধ্যায় ওনার বাসায় ফ্রাইডে নাইট পার্টি, লাইভ মিউজিক হবে। বিয়ে করেন নি, তিনি একাই থাকেন। আজ তিনি নিজ হাতে বিরিয়ানি রান্না করে সবাইকে খাওয়াবেন। প্রতি শুক্রবার তিনি এই কাজ করেন। খুব ভালো শেফ তিনি। শুনে এক কথায় রাজি হলাম আমি।
শরীফ ভাইয়ের সাথে পরিচয় আমার জীবনের একটি উল্লেখেযোগ্য অর্থবহ ঘটনা। শরীফ ভাইয়ের বয়স তখন ৩৯ আর আমার ২৭। আমাদের সখ্যতা হতে সময় লাগে নি। তারপর থেকে নিয়মিত হয়ে ওঠে তার ঘরে যাতায়াত। সপ্তাহে অন্তত দুইটা সন্ধ্যা আড্ডা জমতো শরীফ ভাইয়ের বাসায়। সপ্তাহে একদিন জমতো ফ্লাট ওয়ানে, আমার নতুন ঠিকানায়। সেখানে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে শরীফ ভাইয়ের ৪০তম জন্মদিনের আয়োজন করেছিলাম।
লন্ডন বেতার বাংলার জন্ম হয়েছিল শরীফ ভাইয়ের ঘরে। তিনি তাঁর বেতনের একটা অংশও দিতেন বেতার বাংলার ফান্ডে। আমাকে তিনি বেতার বাংলায় কাজ করতে বলেন। বিনা বাক্যব্যায়ে রাজি হয়ে যাই আমি। নিউজ ও মার্কেটিং দেখার দায়িত্ব আমার। তারপর শরীফ ভাই বার্মিংহামে চলে গেলেন পিএইচডি করতে।
রান্না করাটা যে একটা শিল্প এই ধারণা পেয়েছি আমি শরীফ ভাইয়ের কাছে থেকে। আমি যখন শরীফ ভাইয়ের বাসায় থাকতাম, কিচেন থাকতো আমার দখলে। সারা দুনিয়ার কত রকম স্পাইস যে সাজানো আছে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। রান্নার খুঁটিনাটি তাঁর কাছে থেকে শিখেছি। আমি রান্না করতাম তিনি আমাকে ইন্সট্রাকশন দিতেন। শরীফ ভাইয়ের প্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ছিল মাস্টার সেফ। আমার কাছে শরীফ ভাই সত্যিকারের একজন মাস্টার শেফ।
আমাকে জীবনানন্দ দাশ চিনিয়েছেন শরীফ ভাই। লন্ডনের প্রতিটা ঈদ আমার শরীফ ভাইয়ের ঘরে কেটেছে। বিশ্বকাপ, ইউরো কাপ, প্রিমিয়ার লীগ, লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লীগ সব উপভোগ করতাম একসাথে। সামারে ঘুরতে বেড়িয়েছি, ক্রিসমাসের শীতে পার্টি করেছি। ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়েছি। গার্ডেনিং এর তালিমও পেয়েছি শরীফ ভাইয়ের কাছে থেকে।
তখন ২০০৭ সাল, আমি থাকি ব্রিকলেনের পুলিশ স্টেশনের উপর একটি ফ্ল্যাটে। সেই ফ্ল্যাটে চমৎকার একটি ঝুল বারান্দা আছে। অনেক বড়, এতো বড় যে টেবিল টেনিস খেলা যাবে। শরীফ ভাই সেখানে টমেটো, কাঁচামরিচ ও লাউয়ের চাষ করলেন। আমার দায়িত্ব শুধু জল দেয়া। খুব কাছে থেকে আমি পর্যবেক্ষণ করি আমি। প্রতিদিন লাউয়ের গাছ প্রায় একফুট করে বাড়ছে।
দিনের পর দিন কত গল্প, সাহিত্য, দর্শন, মিথ তিনি আমার মগজে ঢুকিয়েছেন তা বিস্তারিত লিখতে একটা ছোটখাট গ্রন্থ হয়ে যাবে। একবার তিনি আমাকে বলেন, রাজিক ইংলিশদের সাইকিক মাইন্ড বুঝতে হলে ভালো করে ইংলিশ হিস্ট্রি পড়েন। তিনি বললেন, পড়া শুরু করবেন, "ওয়ার অব রোজেস" থেকে।
আমার জীবনের সবচেয়ে চমৎকার স্কুলিং হয়েছে শরীফ ভাইয়ের ঘরে। কত মানুষের যে দেখা পেয়েছি সেখানে। মন্ত্রী থেকে রেস্টুরেন্ট সেফ সবাই আসতেন সেখানে। সবার সাথে একই ব্যবহার করতে তিনি। মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। আমার পরিণত বয়সের মনোজগৎ গড়ে দিয়েছেন তিনি। একবার শরীফ ভাইয়ের সামনে তাঁর একবন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেন, আপনি শরীফের কি কাজিন? আমি উত্তর দেয়ার আগেই শরীফ ভাই বলেন, মোর দ্যান কাজিন। আসলে তিনি আমাকে নিজের সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন।
লন্ডন বেতার বাংলায় দীর্ঘ বছর কাজ করি আমি শরীফ ভাইয়ের অনুপ্রেরণায়। সেখানেও আমি শিখেছি অনেক। সুনীলের পূর্ব পশ্চিম উপন্যাসটি বেতারে প্রচারের প্রস্তাবনা আমি করেছিলাম। পরে তা গ্রহণ করেছিল কর্তৃপক্ষ। আমার মনে হয় ওঠাই ছিল বেতার বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রোডাকশন।
বেতারের জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম আমি। ইস্ট লন্ডনের কত মানুষ যে নাটকে এনগেজ হয়েছিল তার ইয়াত্তা নেই। নাটকটি ব্রডকাস্ট হওয়ার আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল এবং তিনি এসেছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। আমার সৌভাগ্য সুনীলের সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। অনুষ্ঠান শেষে আমরা ডিনারে যাই একসাথে। সুনীলের সাথে ডিনার - সেই স্মৃতি ভোলার নয়। আমার ভেতর হয়তো লেখক সত্ত্বা সুনীল দেখেছিলেন তাই লেখক হয়ে ওঠার তার কিছু সিক্রেট জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে যা আমার ভীষণ কাজে লাগে।
একদিন দুপুরে শরীফ ভাই আমাকে ফোন করে জানালেন, কাল সন্ধ্যায় আশরাফ আমার বাসায় আসছে ডিনারে। আশরাফ আপনাকে আসতে বলেছেন। আশরাফ ভাই তখন আওয়ামীলীগের সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথম লন্ডন আসছেন। দেখা করার তালিকায় আমাকেও রেখেছেন জেনে আপ্লুত হলাম আমি।
পরদিন সন্ধ্যায় আশরাফ ভাই শরীফ ভাইয়ের বাসায় আসেন। আমরা আগে থেকেই শরীফ ভাইয়ের বাসায়। শরীফ ভাইয়ের কিচেন যথারীতি আমার দখলে। আড্ডা চলছে। আশারফ ভাই বললেন শরীফ ভাইকে, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সেক্রেটারি নির্বাচিত হওয়াতে তুমি খুশি তো? শরীফ ভাই উত্তরে বললেন, যদি তোমার নামে কোন দুর্নীতির খবর শুনি নিজের হাতে গুল্লি করমু আমি। আশরাফ ভাই হেসে দিলেন। এই হল শরীফ ভাই। এই ফাঁকে বলে রাখি, রুশনারা আলী, ব্রিটিশ এমপি, প্রথম জীবনে কাজ করতেন শরীফ ভাইয়ের এসিস্টেন্ট হিসেবে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পদক্ষেপ গড়ে দিয়েছিলেন শরীফ ভাই।
২০১৪ সালে শরীফ ভাই বাংলাদেশে চলে আসেন। তিনি বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ ডিপার্টপেন্ট এ ডীন হিসেবে জয়েন করেছিলেন। গত বছর তিনি চাকুরী থেকে অবসরে যান।
গত ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ ছিল শরীফ ভাইয়ের জন্মদিন। আমি তাঁকে ফোন করি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। কথা হল, বললেন তিনি ভালো আছেন। কিন্তু কণ্ঠস্বরে তেমন উচ্ছাস নেই।
দুই সপ্তাহ আগে শরীফ ভাইয়ের বন্ধু ডাঃ ইকবাল আমাকে ফোন করে জানালেন শরীফের ল্যাং ক্যান্সার ধরা পড়েছে, শীঘ্রই লন্ডন উদ্দেশ্যে রওনা হবে। মনটা বিষাদে ভরে গেল খবরটি শুনে। দুই দিন পর শরীফ ভাইয়ের বাল্য বন্ধু তৌহিদ ভাই ফোনে জানালেন, শরীফের ফোর্থ স্টেজ, বাঁচার আশা নেই।
ফেব্রুয়ারি ২২ তারিখ শনিবার সকালে শরীফ ভাই ঢাকার এভারগ্রীন হাসপাতালে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন। এক বিকেলে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন।
শরীফ ভাই, আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। শান্তিতে থাকুন। আপনার শূন্যতা পূরণ হবার নয়। বিদায়। চির বিদায়।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়