Saha Suravi

Published:
2024-12-02 10:57:31 BdST

বিশ্বে বিলুপ্ত-প্রায় একমাত্র পারুল গাছটি রয়েছে বাংলাদেশেই



ভয়েস অব আমেরিকা রিপোর্ট
____________

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে বিলুপ্তপ্রায় পারুল গাছ। গবেষক এবং বৃক্ষপ্রেমীরা এই গাছ উপমহাদেশে তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও সন্ধান পাননি। এক সময় বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ এই উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে এই গাছ পাওয়া যেতো। এক সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও কম বেশি এই পারুলের দেখা মিলতো। বাংলাদেশে এই গাছকে বলে ‘পারুল গাছ’। ভারতে হিন্দিতে বলে ‘পারুলা’ আর ইংরেজিতে এই গাছের নাম ‘সিনেক ট্রি’। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে এই পারুল BIGNONIACEACE পরিবারের বৃক্ষ।

বগুড়ার এই পারুল গাছটির উচ্চতা ৬০ থেকে ৭০ ফুট হবে। পারুল গাছটির পাতার রং গাঢ় সবুজ। পাতাগুলো ৬/৭ ইঞ্চি লম্বা হয়। শুস্ক মৌসুমে এই গাছের পাতা ঝরে যায়। আবার মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে পাতা গজায় এবং ফুল ফোটে। সাদা রঙের ফুল। ফুলগুলো ১ ইঞ্চির মত লস্বা হয়। এই ফুলে সচারচার ৫টি পাঁপড়ি থাকে। যখন ফুল ফোটে তখন ওই ফুলের মিষ্টি সৌরভ পুরো এলাকা মাতিয়ে তোলে। ফুল থেকে এক সময় ফল হয়। সেটি দেখতে বরবটির মত। ছোটছোট বীজে ভরা থাকে সেই ফল। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা এই গাছের সন্ধান পাওয়ার পর থেকে বংশ বৃদ্ধির চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে এখন পর্যন্ত এই পারুল গাছের চারা কেউ তৈরি করতে পারেননি।

উদ্ভিদ গবেষক ড. মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, এক সময় আমাদের দেশের শালবনগুলোতে পারুলের দেখা পাওয়া যেতো। শাল গাছের সাথে এই গাছ একই পরিবেশে বড় হতো। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রতিকুল প্রভাবে পৃথিবী থেকে অনেক জাতের গাছ, প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং বিলুপ্ত হচ্ছে। সেই প্রভাবে আমাদের দেশের শালবনগুলোও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর পারুল গাছ অনেক আগেই একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

 


সেই বিরল জাতের একটি মাত্র পারুল গাছ বগুড়ার সোনাতলায় শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকেই বলেছেন এটি বিশ্বের একমাত্র গাছ হিসেবে এখন চিহ্নিত। বগুড়ার সোনাতলার সরকারি নাজির আখতার কলেজের জন্য জমিদানকারী মরহুম সৈয়দ নুরুল হুদা তার কর্মস্থল অবিভক্ত ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার খড়গপুর থেকে দুটি চারা এনে রোপন করেন। চারা দুটির একটি মারা যায় এবং অপরটি আজও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

পারুল গাছ পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পিছনের কারণ জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিজ্ঞানী ও উদ্ভিদ বিশারদ ড. মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণী পৃথিবীতে একটি পরিবেশ নিয়ে থাকে। সেই পরিবেশ নষ্ট হলে সে দুর্বল হয়ে যায়, রোগাক্রান্ত হয়ে এক পর্যায়ে মারা যায়। একই কথা গাছের ক্ষেত্রেও। গাছও একটি পরিবেশের মধ্যে দিয়ে বড় হয়। বেঁচে থাকে। গাছের চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ভালো থাকলে তখন ইকো সিস্টেম কাজ করে। ফলে একটি বন একটি কমিউনিটি রক্ষা হয়। এটা তখন বিলুপ্ত হয় না। কিন্তু কোন কারণে যদি প্রাকৃতিক পরিবেশের কোন একটি পার্ট ধ্বংস হয়ে যায় বা একটা বন্ধ হয়ে যায়, তখন পুরো ইকো সিস্টেমটাই নষ্ট হয়ে যায়। তখন প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল গাছগুলো আর সেই সাপোর্ট পায় না। যার কারণে ওই গাছগুলো সময়ের ব্যবধানে বিলুপ্ত হয়ে যায়। পারুল গাছও ইকো সিস্টেম লস্টের কারণে বিলুপ্ত হয়েছে’।


তিনি আরো বলেন, ‘পৃথিবীর একেক জায়গায় একেক রকম তাপমাত্র ছিলো। কাল ক্রমে পরিবেশ দুষণের কারণে মাটি দুষিত হয়েছে, পানির, বাতাস দুষণের শিকার হয়েছে। এতে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে মারাত্মক ভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ ভেঙ্গে পড়েছে। এর প্রভাব প্রাণী, উদ্ভিদসহ পুরো পৃথিবীকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে’।

এর আগে পারুল গাছের জন্য এই উপমহাদেশ ইকো সিস্টেম উপযোগী ছিলো। ওই গাছ টিকে থাকতে প্রাকৃতিক পরিবেশসহ যা যা প্রয়োজন তার সবই বিদ্যমান ছিলো। সে সময় ইকো সিন্টেম সচল ছিলো। ফলে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই গাছ ছিলো। বর্তমানে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা পারুল গাছকে বিরল প্রজাতির গাছ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তারা এই গাছের সন্ধানে এশিয়া মহাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেড়িয়েছন কিন্তু কোথাও এই গাছের সন্ধান মেলেনি। তবে পারুলের কাছাকাছি জাতের কিছু গাছের দেখা পাওয়া গেছে। গাজিপুরের শালবনে ৫টি গাছ এখনো আছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেছেন সেগুলো পারুলের মত দেখতে হলেও শতভাগ পারুল নয়।

পারুল গাছ মূলত ঔষধি গাছ। জনস্বাস্থ্যের জন্য এই গাছ দারুণ ভাবে উপকারে আসে। বগুড়ার গাছটি বেঁচে থাকার কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে, বগুড়ার এই জায়গায় গাছটি তার বেঁচে থাকার পরিবেশ শতভাগ পেয়েছে। ওখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ গাছটিকে পুরোপুরি সাপোর্ট দিতে পারছে বিধায় এখনো বেঁচে আছে।
বন বিভাগ ইতোমধ্যেই পারুল গাছটির বীজ সংগ্রহ করে চারা উৎপাদনের জন্য গবেষণার কাজ শুরু করেছে। বন বিভাগ তাদের নিজস্ব নার্সারিগুলোর মাধ্যমে চারা উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চারা উৎপাদনে সফলতা অর্জন এবং পারুলের বংশ বৃদ্ধি করতে পারবেন বলে তারা আশা প্রকাশ করেছেন।


পারুল গাছ ঘিরে এলাকাবাসীর উচ্ছ্বাস: পারুল গাছটি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা সদরের সরকারি নাজির আখতার কলেজ আঙ্গিনায় আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই গাছটির এতো কদর হবে এলাকাবাসীর ধারণা ছিলো না। তারা অন্য আর দশটি গাছের মতই এক সময় পারুল গাছটিকেও অতি সাধারণ মনে করতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এসে যখন এলাকার মানুষ জানতে পারেন এই গাছের কদর পুরো দুনিয়া জুড়ে তখন তারা উচ্ছসিত হয়ে পড়ে। দেশে এবং দেশের বাইরের উদ্ভিদ গবেষকদের আনাগোনায় তারা পুলকিত হয়ে ওঠেন। এই গাছটির মাধ্যমে নিজেদের এলাকাকে বিশ্বের মানুষ জানছে এইটি ভেবে তাদের বুক ভরে উঠেছে।
স্থানীয় একজন প্রবীন ব্যক্তি খোরশেদ আলম ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, গাছটি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উদ্ভিদপ্রেমীরা নিয়মিত আসছেন। অনেকে দেখতে আবার অনেকে গবেষনা করতে। আমি অনেক গবেষককে এই গাছের পাতা, ফুল, ফল দিয়েছি। তারা এসব নিয়ে গবেষণা করছেন।


সরকারি নাজির আখতার কলেজর সাবেক শিক্ষার্থী সজল আহম্মেদ, রিমোন আহম্মেদ বিকাশ, আব্দুল ওয়াদুদ ভয়েস অফ আমেরিকাকে এই গাছের সাথে জড়িয়ে থাকা তাদের নানা স্মৃতি বর্ণনা করেন এভাবে। তাদের কৈশোর এবং যৌবনের পুরো সময়টা এই গাছকে ঘিরেই কেটেছে। তারা যখন নব্বইয়ের দশকে এই কলেজের শিক্ষার্থী ছিলো তখনও গাছটি এরকম বড়ই ছিলো। মাঠে ফুটবল খেলে শরীর জুড়িয়ে নিতেন এই পারুলের ছায়ায়। বন্ধুদের আড্ডা, গানের আসর সব কিছু জমতো পারুল তলায়। কর্মব্যস্ততার মাঝেও সুযোগ পেলেই তারা এখনো ছুটে আসেন এই পারুলের কাছে।

সরকারি নাজির আখতার কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান আব্দুস সবুর ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, ‘পারুল গাছ আমাদের কলেজকে ইতিহাসের অংশ করে তুলেছে।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়