DR. Shamsur Rahman

Published:
2024-10-17 10:31:45 BdST

"ব্রিটিশ আমলের দুর্ভিক্ষ এখনকার ডায়াবেটিসের কারণ"


অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী


অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
___________________________

বর্তমান সময়ের একটি গুরুতর রোগ হলো ডায়াবেটিস। এটি নিয়ন্ত্রণ করা না হলে কালক্রমে দেখা দেয় নানান জটিলতা। এই রোগের ক্ষেত্রে ভারত পৃথিবীতে দ্বিতীয় স্থানে আর শীর্ষে রয়েছে চীন। বাংলাদেশ অষ্টম স্থানে থাকলেও সপ্তমে ওঠার পর্যায়ে আছে।


‘গার্ডিয়ানে’ প্রকাশিত নিবন্ধে এবং সিএনএনে প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় নিরন্ন জীবনে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস আর হৃদ্‌রোগের প্রবণতা বেড়েছে। ঔপনিবেশিক
শাসনের সময়, যাকে আমরা ব্রিটিশরাজ বলে জানি, প্রায় ২৫টি বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ ঘটেছে ভারত উপমহাদেশে। এতে মৃত্যু হয়েছে ৬ কোটি মানুষের। শুধু তা-ই নয়, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়েছে জনস্বাস্থ্যের ওপর। এর একটি হলো ডায়াবেটিস।


১৮৭৬-৭৮ সালের মধ্যে মহাদুর্ভিক্ষের বিপুল আঘাত এসেছিল ভারত উপমহাদেশের ওপর। এতে মৃত্যু হয়েছিল ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি মানুষের। পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩) হানা দিয়েছিল দুই বাংলায়। বিধ্বংসী সেই দুর্ভিক্ষে অপুষ্টি আর চরম খাদ্যসংকটে মারা যায় ৩০ লাখ মানুষ, যা সরাসরি ব্রিটিশ নীতির সঙ্গে ছিল সম্পর্কিত। এমন সব ঘটনা এই অঞ্চলের মানুষকে ডায়াবেটিসপ্রবণ করে তুলেছে।


ব্রিটিশরাজের কঠোর ভূমিনীতি, ভারতীয়দের জন্য অর্থ সংকোচন নীতি, খাদ্য রপ্তানি শোচনীয় প্রভাব ফেলে এ দেশের ওপর। খরা এই
সংকট আরও বাড়িয়ে তোলে। এ থেকে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে জনস্বাস্থ্যের ওপর।

এ অবস্থা এই অঞ্চলের মানুষের ডায়াবেটিস রোগের উচ্চ হারের জন্য দায়ী কিছুটা হলেও। তারই উত্তরাধিকার বয়ে চলেছি আমরা।

একটি দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পেয়ে বেঁচে যাওয়া পরের প্রজন্মের মধ্যে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে দ্বিগুণ। এর পরের প্রজন্মে বাড়ে তারও দ্বিগুণ। এই সবকিছুর প্রভাব পড়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের শরীরে মেদ সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া আর শর্করা বিপাকের ওপর। এমনটি ঘটে এপি জেনেটিকসের মাধ্যমে। জীববিজ্ঞানে একে বলে অধিবংশাণুবিজ্ঞান। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বৈশিষ্ট্য আমাদের পরিবেশ ও আচরণে যে পরিবর্তন ঘটায়, তা আমাদের জিনের কার্যকলাপের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে, এর অধ্যয়ন হলো এপিজেনেটিকস।

দুর্ভিক্ষের পরিবেশগত প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জিন হয়েছে অনশন-অনটনে অভিযোজিত। এই জিনের প্রভাবে এ অঞ্চলের মানুষ হয়ে উঠেছে ডায়াবেটিসপ্রবণ। দুর্ভিক্ষের সঙ্গে অভিযোজনের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক অঞ্চলের মানুষ হয়ে পড়েছে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। স্বাভাবিক সময় আমরা যে শর্করাজাতীয় খাবার খাই, তা পরিপাক নলে ভেঙে গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়ে ঢোকে রক্তস্রোতে। এদিকে ইনসুলিন নিঃসৃত হয় অগ্ন্যাশয় থেকে। আর এই হরমোনের সাহায্যে গ্লুকোজ ঢোকে কোষে এবং উৎপন্ন করে শক্তি। বাড়তি গ্লুকোজ সঞ্চিত হয় লিভারে। এনার্জি বা শক্তি সংকটে লিভার থেকে গ্লুকোজ আসে। তাই কিছু সময় খাবার না খেলেও শক্তি কমে না শরীরে। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জিন কিন্তু এনার্জি বা শক্তিকে যত দূর সম্ভব ধরে রাখতে সক্ষম হয়। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হলে ঘটে অন্য ঘটনা।

রক্ত থেকে পেশি ও লিভারের ভেতর ঢুকতে গ্লুকোজের সমস্যা হয়। ইনসুলিন অকার্যকর হওয়ায় এ ঘটনা ঘটে। এটিই হলো ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। রক্তের গ্লুকোজ দেহের কোষে ঢুকতে না পারার জন্য কিছু গ্লুকোজ জমে রক্তে। এ ছাড়া কিছু গ্লুকোজ শরীরে মেদ হিসেবে জমা হয়। খাদ্যের অভাব যখন ছিল, তখন শরীর অভিযোজন করে এই কম ক্যালরির সঙ্গে। জিন হয় মিতব্যয়ী। একে বলে মিতব্যয়ী জিন বা থ্রিফটি জিন। যখন খাদ্যের প্রাচুর্য হয়, এই জিন কাজ করে অন্য রকম। এ থ্রিফটি জিনের প্রবণতা ছিল শক্তি সঞ্চয় করে রাখা। প্রচুর খাদ্যের জগতে এরা মেদ সঞ্চিত করার কাজে নামে। এই মেদ জমে তলপেটে, দেহের আন্তর যন্ত্রে। এমন বিপাকের বৈকল্য থেকে হয় ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ ও স্থূলতা। এই প্রবণতা কালক্রমে গড়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে। একে খণ্ডন করা সম্ভব না হলেও বিজ্ঞানীরা বলেন, নিয়ন্ত্রিত খাদ্য সমৃদ্ধ জীবনযাপনে আর শরীরচর্চার মাধ্যমে ডায়াবেটিসের আশঙ্কা কমানো যাবে।

গবেষকেরা জানাচ্ছেন, শিকড়ে ফিরে যেতে হবে। প্রাচ্য ঐতিহ্যের আয়ুর্বেদ, ইউনানি চিকিৎসা আর যোগব্যায়ামের ঐতিহ্যের সঙ্গে চলবে আধুনিক চিকিৎসা। পশ্চিমা খাবার আর ঐতিহ্যের প্রভাবে এ দেশের আদি জীবনচর্চা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন স্তিমিত। এদের উত্থান ঘটলে হবে নবজীবনের আগমন। আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে নিজ ঐতিহ্যে, যা প্রাচীনকালে ছিল গর্বের বিষয়।
--------------------
  প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল



শুভাগত চৌধুরী (জন্ম ১৯৪৭) একজন বাংলাদেশি চিকিৎসক এবং লেখক। বিজ্ঞান/কল্পবিজ্ঞান/পরিবেশবিজ্ঞান শাখায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০২১ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।


শুভাগত চৌধুরী ১৯৪৭ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। সিলেটে প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। তিনি কলকাতায় শান্তিনিকেতনেও কিছুকাল পড়ালেখা করেন। পরে চিকিৎসা বিষয়ে আগ্রহী হয়ে চিকিৎসাবিদ্যায় পড়ালেখা করেন। কর্মজীবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন এবং পরে একই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর বারডেমসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন।  শুভাগত নিউইয়র্ক সায়েন্স একাডেমীর নির্বাচিত সদস্য।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনি অসংখ্য গ্রন্থ, গবেষণা ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার গবেষণার মূল বিষয় প্রাণরসায়ন, পুষ্টি ও চিকিৎসা-শিক্ষা পদ্ধতি।

 

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়