Saha Suravi
Published:2024-09-12 12:09:45 BdST
ক্লদ মোনে এবং চিত্রাঙ্কনের নতুনতর ধারা
ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
______________________
অস্কার ক্লদ মোনে, র জন্ম পারি তে -- ১৪ নভেম্বর ১৮৪০ ক্রিস্টাব্দে। তাঁর আঁকা সূর্যোদয় বা সলি ল্যভঁ ( Soleil levant) প্রথম প্রদর্শিত হয় ১৮৭৪ ক্রিস্টাব্দে। এটি একটি নৈসর্গিক চিত্র এবং এই চিত্রটির সঙ্গেই আসে আঁপ্রেশিওঁ বা Impression কথাটি। একেবারেই এতাবৎ অঙ্কনরীতি থেকে ভিন্নতর। আঁপ্রেশিওঁনিজ্ম শব্দটিরো উদ্ভব তখনই। ইতোপূর্বের চিত্রাঙ্কন ছিল মুলানুগ অথবা ফোটোগ্রাফির মতো।
ক্লদ মোনে এবং সমসাময়িক কিছু ফরাসি চিত্রকর এই ধারণাটিকেই বদলে দিতে চাইলেন। ১৮৭৪ সালে তাঁর আঁকা সূর্যোদয় ছবিটি পারির অভিজাত প্রদর্শনীশালা আকাদেমি দে বোজার ( Académie des Beaux - Arts ) এর সালোঁ দ্য পারি ( Salon de Paris )থেকে পরিত্যক্ত হলে ক্লদ মোনে,( Claude Monet ) , কামীঈ পিসারো ( Camille Pissarro) ,পিয়্যার - ওগুস্ত রেনোয়া ( Pierre - Auguste Renoir ), এবং আরো কয়েকজন শিল্পী তাঁদের প্রদর্শনী র ব্যবস্থা করেন সোসিয়েতে আনোনিম দেজারতিস্ত, প্যাঁতর, স্কুল্পত্যর এ গ্রাভ্যার ( Société anonyme des artistes peintures ,sculpteures et graveurs ) এ আলাদাভাবে তাঁদের কলাকৃৎ দেখাবার ব্যবস্থা করেন। তাঁদের প্রথম প্রদর্শনী ই দারুণভাবে সফল হয় --- জনপ্রিয় হয় খুব। ক্লদ মোনে অবশ্যই কামীঈ পিসারো এবং এদুয়ার মানে ( Edouard Manet ) দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। চিত্র সমালোচক লুই ল্যরোয়া ( Louis Leroy )তাঁর সমালোচনায় এই নতুন ধরণের চিত্র গুলিকে লেক্সপোজিসিঁও দে জ্যাঁম্প্রসেনিয়নিস্ত নামে অভিহিত করেন। ল্য শারিভারি ( Le Charivari ) নামক পত্রিকায় এই ধরণের শিল্পকর্ম কে আঁপ্রেশিওনিজ্ম আখ্যায় ভূষিত করেন।
ক্লদ মোনের পিতামাতার নাম ছিল ক্লদ আদল্ফ মোনে এবং লুইজ ঝুস্তিন মোনে। পরের বছর অর্থাৎ ১৪৪১ এ মোনে কে বাপ্তাইজ করা হয় নত্র দাম দ্য লোরেত গির্জায়। একটু বড় হয়ে ক্লদ মোনে অবশ্য ক্যাথলিক থেকে নাস্তিক হয়ে যান।
নর্মান্দির সমুদ্রতটে ইউজেন বুদ্যাঁ র প্রিয় শিষ্য হয়ে যান এবং স্কুলে পড়াকালীন ই তাঁর কাঠকয়লা র আঁকা স্কেচ ১০ থেকে ২০ ফ্রঁ মূল্যে বিক্রি হতো। ক্লদ পরে ল্য হাভ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন, উচ্চতর আঁকা শেখার জন্যে, এবং তাঁর আঁকা শেখার মূলে পরম উৎসাহদাত্রী ছিলেন তাঁর মাতৃদেবী লুইজ ঝুস্তিন।
মোনের দূর্ভাগ্য, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তিনি মা কে চিরতরে হারান। গভীর হতাশাগ্রস্ত মোনে, তাঁর বিধবা ও সন্তানহীনা মাসী মারি জান ল্যকাদ্র এর কাছে গিয়ে থাকতে আরম্ভ করেন।
ল্যুভর্ মিউজে তে মোনে নিয়মিত যেতেন এবং অন্যান্য বিখ্যাত চিত্রকর দের আঁকা খুঁটিয়ে দেখতেন এবং চেষ্টা করতেন নামী ছবি গুলি নিজে আঁকতে। এখানেই তাঁর পরিচয় হয় এদুয়ার মানের সঙ্গে ও নিবিড় সখ্যতা জন্মায়।
মোনে কে এরপরে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার জন্যে সাত বছর আলজেরি তে থাকতে হয়।( আলজেরি ছিল ফ্রঁসের উপনিবেশ)।মনেও শান্তি ছিল না, কারণ প্রিয়বান্ধব হীন একা তাঁকে থাকতে হচ্ছিল আলজেরি তে, তদুপরি তিনি টাইফয়েড আক্রান্ত হন। তখন মোনের মাসী র উদ্যোগে তিনি আবার ফ্রঁসে ফিরে এক আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ডাচ চিত্রকর য়োহান বার্থোল্ড এর সঙ্গে এই সময়ে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে মোনের।
অত প্রতিভাবান যিনি তাঁর কি মন বসবে ওই আর্ট স্কুলে! স্কুল ছেড়ে তিনি ভর্তি হলেন নামী স্কুল শার্ল গ্লেইর - এ। এখানেই বন্ধুলাভ হলো পিয়্যার ওগুস্ত র্যনোয়াঁ, ফ্রেদেরিক বাজীঈ, এবং আল্ফ্রেদ সিসলের সঙ্গে। এখানেই সূচনা হলো অঁ প্ল্যাঁ( En plain ) এর বা ইংরেজিতে আউটডোর আঁকার, ভাঙা রং আর দ্রুত তুলির আঁচড়ে তেই জন্ম হলো আঁপ্রেশনিজমের।
মোনে এর পরে আঁকলেন তাঁর ভুবনজয়ী ছবি ঘাসের ওপর মহ্যাহ্নভোজ বা ল্য দেজ্যুনে সুর লার্ব ( Le déjunér sur l'herbe )। এই ছবিটিই দু বছর আগে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল আকাদেমি দে বোজার থেকে। মোনে এরপরে আঁকেন --- সবুজ পোষাকের মহিলাটি ( Le femme à robe vert ) -- লা ফাম আ রোব ভ্যার। এখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় তাঁর হবু স্ত্রী -- কামীঈ দঁসিয়ু( Camille Doncieux ) এর সঙ্গে। হবু স্ত্রী অথবা বান্ধবীকে মডেল করেই মোনে আঁকলেন--- বাগানে রমণী এবং স্যেন নদীর তীরে,বেনকুর। এই সময়ে কামীঈ অন্তস্বত্বা হয়ে পড়েন এবং ঝ্যঁ নামে তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্মদেন। আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয় পরে, ১৮৭০ এ। তারপরেই শুরু হলো ফ্রাঙ্কো প্রুশিয়ান যুদ্ধ। এই সময় দুজনা ঘুরে আসেন লন্ডন এবং শেষপর্যন্ত থিতু হন আরজঁতঈ ( Argenteuil) শহরে। এখানে মোনে আবার আঁকেন প্রতিদিনের জীবনের নানা দৃশ্য। এই সময়ে তাঁদের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো ছিলো না। সবচেয়ে মজার কথা হলো মোনের আঁকা ঠাঁই পায়নি লন্ডনের রয়্যাল একাডেমী প্রদর্শনী তেও, অথচ ছবি আঁকা বা ভাস্কর্য তে ইংরেজ দের অবদান আদৌ উল্লেখ করার যোগ্যই নয়।
পরে লন্ডন থেকে নেদারল্যান্ডস এর জানদাম এ যান মোনে পরিবার। এখানে ক্লদ আঁকেন প্রায় ২৫ টি ছবি।
আঁপ্রেশনিস্টদের প্রথম প্রদর্শনী হয় পারি তে, ১৮৭৪ সালের মে মাসে। র্যনোয়া হলেন সভাপতি। এখানে মোনে তাঁর সূর্যোদয় ছাড়াও আরো চারটি তেল রং এবং সাতটি প্যাস্টেল এর ছবি প্রদর্শিত হয়। বুলভার দে কাপুসিন রাস্তায়।
১৮৭৮ সালে স্ত্রী কামীঈ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং যক্ষারোগে আক্রান্ত হন এবং আবারো গর্ভবতী হয়ে পড়েন। দ্বিতীয় সন্তান মিশেল এর জন্ম আরো মরণাপন্ন করে তোলে কামীঈ কে। পরে কামীঈ মোনে জরায়ুর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩২ বছর বয়সে প্রয়াতা হন। থাকলো দুই পুত্র ঝ্যঁ ও মিশেল।
অনেক দূ:খ কষ্ট সহ্য করার পরে আঁপ্রেশনিস্ত আন্দোলনের পুরোধা এবং অন্যতম উজ্জ্বল প্রতিভা ক্লদ মোনের জীবনে স্বচ্ছলতা আসে। ১৮৯০ এ মোনে কিনতে সক্ষম হন একটি বড় মাঠ এবং জলাশয় ( আমরা পুকুর বা দীঘি বলতেই পারি) । সাদা লিলিফুল দক্ষিণ আমেরিকা ও মিশরে গিয়ে হলুদ, এবং নীল বর্ণ হলো।
১৮৯৯ থেকে আরো প্রায় কুড়ি বছর মোনে প্রতিফলিত আলো র চমক একেবারে শেষ বয়সে, মোনের আঁকায় যেন নতুন করে ধরা দিলো।
মোনে শেষ পর্যন্ত ১৯২৬ সালে ফুসফুসের ক্যান্সারে, ৮৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন।।
#
আপনার মতামত দিন: