DR. AMINUL ISLAM

Published:
2024-09-08 08:53:23 BdST

গ্রাফিতি প্রতিবাদের শিল্পিত উচ্চারণ


ছবি লেখকের সৌজন্যে পাওয়া


দীপংকর গৌতম
______________________________

বিশ্বের যেকানো আন্দোলন-সংগ্রাম বা পরিবর্তন সাধিত হলে তার কিছু ভিন্ন ভাষা থাকে, ভিন্ন কথা থাকে। যেসব ভাষা ও কথা আন্দোলনের ইতিহাসের একেকটি প্রেক্ষিতের সঙ্গে যুক্ত। আন্দোলনের ভেতর থেকে দেখা যায় সময়ের বুকচিরে বেরিয়ে এসেছে শত মননশীল, যারা সংগ্রামের মধ্যে রচনা করে সংগ্রামভিত্তিক সাহিত্য-সংস্কৃতি। সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি পরিবর্তনের কালে একটা নতুন সুর জুড়ে দেয়।


সেই সুরের নাম শিল্পকলা। বিশ্বের যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামকে গতিশীল করে শিল্পকলার সেই অনিন্দ্য মাধ্যম, সংগ্রাম থেকে যার উৎপত্তি। ১৯৯০ সালের গণসংগ্রামে এরশাদের পতনের আন্দোলনকে চিহ্নিত করতে বুকে-পিঠে স্লোগান লেখা সেই নূর হোসেনের ছবি তৈরি করেছিল ইতিহাস। নূর হোসেন কোনো পরিচিত মুখ ছিলেন না।

আজ তিনি মিছিলের মুখ। আজ তিনি ১৯৯০ সাল। আজ তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সেরা গ্রাফিতি। বুকে-পিঠে স্লোগান লেখার এই আইডিয়া তিনি কোথা থেকে পেয়েছিলেন জানি না।

কিন্তু যেকোনো আন্দোলন দাগ রেখে যায়, যে দাগরেখা আমাদের সেই সময়কে চিনতে সাহায্য করে। সময়ে সেই চিহ্নগুলো সংগ্রামের স্মারক। সম্প্রতি বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের আপামর ছাত্র-জনতা করেছেন গ্রাফিতির বিপ্লব। দেয়ালে দেয়ালে মানুষের ক্ষোভ আর যন্ত্রণার আগুন, মানুষ চায় নতুন দেশ গড়তে, চায় নতুন সময়কে আলিঙ্গন করতে। সেগুলো এবার গ্রাফিতি হয়ে জায়গা করে নিয়েছে সারা দেশের জনপথ থেকে জনপদের দেয়ালে দেয়ালে।

গ্রাফিতির উৎপত্তি কিন্তু এভাবেই।
ইতালিয়ান শব্দ Grafitiato থেকে এলেও ‘গ্রাফিতি’কে বলা হয় কাউন্টার কালচার, অর্থাৎ যা গতানুগতিক সংস্কৃতির বিপরীত। যে শিল্পকর্মটি প্রচলিত রীতিনীতি-সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়ে এক ধরনের শিল্প বিপ্লব গড়ে তোলে, তা-ই গ্রাফিতি। সমাজের অবক্ষয়, উত্পীড়ন, নিপীড়ন, রাজনৈতিক অরাজকতা বা স্বেচ্ছাচারতন্ত্র ইত্যাদি উঠে আসে গ্রাফিতিতে। উঠে আসে সমাজের সমসাময়িক বিশৃঙ্খলার এক ব্যঙ্গাত্মক রূপ, যা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কোন অব্যবস্থায় বাস করছ তুমি, কী তোমার পরিণতি, কিসে তোমার পরিত্রাণ। আন্দোলন-সংগ্রাম, দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে শিল্পিতভাবে প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের মাধ্যম গ্রাফিতি। স্বদ্যোজাত ভাবনা প্রকাশের স্থান দেয়াল। দেশের সব দেয়াল একজন গ্রাফিতি শিল্পীর জন্য উন্মুক্ত ক্যানভাস। তাই বিভিন্ন দেশের দেয়ালে আমরা দেখতে পাই প্রতিবাদ, মুক্তচিন্তা, দেখতে পাই সে দেশের প্রকৃত দৃশ্য একজন গ্রাফিতিশিল্পী বা গেরিলাশিল্পীদের চিত্রকল্পের মাধ্যমে। ঠিক যেমনটি দেখা গিয়েছিল ফ্রান্সে, আটষট্টির ছাত্র বিপ্লবে। গ্রাফিতির জনক ফরাসি চিত্রশিল্পী ব্লেক লে রাত প্যারিসের দেয়ালে দেয়ালে এঁকেছিলেন নানা অসংগতি, রাজনৈতিক ব্যঙ্গ আর সামনের দিনের আশার বাণী। কিন্তু আমাদের দেশে এবার গ্রাফিতি উঠে এসেছে সারা দেশের পথে-প্রান্তরে দেয়াল থেকে দেয়ালে।

সম্প্রতি ছাত্র-জনতা করেছে গ্রাফিতির বিপ্লব। দেয়ালে দেয়ালে মানুষের ক্ষোভ আর যন্ত্রণার গল্প, মানুষ চায় নতুন দেশ গড়তে, চায় নতুন সময়কে আলিঙ্গন করতে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটাপ্রথা নিয়ে টানা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মূলত ১৩ জুলাই থেকে আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মীদের ওপর সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনায় অনেক ছাত্র-ছাত্রী আহত হন। আন্দোলনকারীরাও হামলা, মামলা, লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকেন। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৯ জুলাই থেকে সারা দেশে শুরু হয় গ্রাফিতি এঁকে প্রতিবাদ জানানো। গ্রাফিতি আঁকতে গেলেও হামলা হতো। তার পরও সাহস নিয়ে দাঁড়ালেন সেই শিক্ষার্থীরা, যাঁদের কথা সবাই ভাবত ফেসবুক আর অ্যানড্রয়েড মোবাইলে একটি প্রজন্ম শেষ। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যে যাঁর মতো করে আঁকলেন গ্রাফিতি। তার ভাষা, রংতুলির ব্যবহার দেখে সবাই বিস্মিত হলো। নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে, নানা দিক থেকে হামলা হতে পারে জেনেও তাঁরা লিখেছিলেন প্রতিবাদের ভাষা। তাঁরা যেসব কথা লিখেছেন দেয়ালে, তার কথাগুলো কখনো ছিল প্রতিবাদী কবিতার লাইন, গানের লাইন, অভ্যুত্থানে শহীদদের জন্য শোকগাথা, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি ঘুষ-দুর্নীতিবিরোধী, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা, সুন্দর একটি দেশ গড়ার কথা। খুবই পরিশীলিত ভাষায় অসাধারণ সব ভাষার বিস্তার, যা প্রাণস্পর্শী। এবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেরণা জুগিয়েছে বেশ কিছু গান। এর মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, মোহিনী চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রিন্স মাহমুদ, হায়দার হোসেন, ইথুন বাবু, ফারজানা ওয়াহিদ, সায়ান প্রমুখের লেখা গান আলোচিত হয়েছে। অফলাইন-অনলাইন এবং আন্দোলনের মাঠে এই গান উদ্দীপ্ত করেছে। সমবেত কণ্ঠে গেয়েছেন আন্দোলনকারীরা। সেগুলোও গ্রাফিতির চেয়ে কম নয়। আন্দোলনে একদিকে গুলি চলেছে, টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেডে, তার বিপরীতে শিক্ষার্থীদের বেপরোয়া প্রতিবাদ। বিক্ষোভ একসময় সুর তোলে গানে। গানে-সুরে-স্লোগানে, মুক্তির মিছিলে মিছিলে প্রতিনিয়ত যুক্ত হয়েছে নতুন শব্দ, নতুন মিছিল, নতুন গান।

ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের সময় ও এখনো গ্রাফিতি আঁকছেন শত শত শিক্ষার্থী। রংপুরের শহীদ আবু সাঈদের মায়ের মুখের শোকাহত আঞ্চলিক ভাষা উঠে এসেছে দেয়ালে। ‘হামার বেটাক মারলু কেনে?’ ‘ছাত্র যদি ভয় পাইতো বন্দুকের গুলি/উর্দু থাকতো রাষ্ট্র্রভাষা, উর্দু থাকতো বুলি’। ‘দেশ স্বাধীন হলে আমরা আবার ছাদে উঠব’, ‘তুমি কে আমি কে/বাঙালি বাঙালি। ‘লোহার টুপি মানুষের মগজ খায়’, ‘অপরাজনীতি রুখে দাও’, ‘পিন্ডির গোলামীর জিঞ্জির ছিন্ন করেছি, দিল্লির দাসত্ব মানি না মানব না’, ‘ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার নই/এসো দিন বদলের যোদ্ধা হই’, ‘বুলেট দিয়ে বিপ্লব থামে না’, ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই সাঈদ’ নতুন বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ, মুক্তির মন্দিরও সোপানতলে/কত প্রাণ হলো বলিদান/লেখা আছে অশ্রুজলে। এই সব স্লোগানই বলে দিচ্ছে নতুন প্রজন্মের অদম্য চেতনার কথা। তবে গ্রাফিতির এই পরিমাণ ছড়াছড়ি এই প্রথম। সংগ্রামের মৃত্যু নেই। সংগ্রামকে কেন্দ্র করে জন্ম নেওয়া শিল্পকলা সংগ্রামকে দেয় প্রতিবাদের ভাষা। সেই ভাষা সংগ্রামী মানুষকে দেয় মুক্তি। তবু প্রত্যাশা করি, এই গ্রাফিতিচর্চা টিকে থাকুক। মানুষ পাক মত প্রকাশের অধিকার। শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো গণসংগ্রামের জন্মজড়ুল হয়ে টিকে থাক প্রতিবাদের ভাষার অনন্য মাধ্যম গ্রাফিতি।

 

__________

 

লেখক দীপংকর গৌতম

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়