Saha Suravi
Published:2024-09-03 09:34:08 BdST
ঋষিতুল্য সৌম্যদর্শন অধ্যাপক জানতে চাইলেন, "কামরুল হাসান ছেলেটি কে?"
ঋষিতুল্য সৌম্যদর্শন সেই অধ্যাপক
ডেস্ক
_______________
মহান শিক্ষককে নিয়ে স্মৃতিলেখ লিখেছেন তাঁরই গুণমুগ্ধ ও সান্নিধ্য ধন্য ছাত্র। সেই ছাত্রও আজ বাংলাদেশের বরেণ্য কবি ও লেখক; এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। মহান এই সম্পর্ক এবং ফল এরকমই।
আমার শিক্ষক প্রফেসর উদয় চট্টোপাধ্যায়
অধ্যাপক কামরুল হাসান
কবি
শিক্ষক, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
_____________
১৯৮১ সাল। আই আই টি খড়গপুরের রাজেন্দ্র প্রসাদ হল। একজন সৌম্যদর্শন অধ্যাপক, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, হলের কমনরুমের সামনে দাঁড়িয়ে একটি দেয়াল পত্রিকায় আমার লেখা একটি কবিতা পড়ছেন। শেষ লাইনটি একটু জোরেই উচ্চারণ করলেন 'বনের সবুজ টেপ বেজে উঠলেই কথা বলবে কামরুল হাসান।' তাঁর মুখ থেকে একটি প্রশংসাসূচক ধ্বনি বের হলে তিনি পাশে দাঁড়ানো একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কামরুল হাসান ছেলেটি কে? আমাদের হলের ছাত্র?' একটু দূর থেকে লক্ষ করা আমি তখন এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দেই, 'স্যার, আমি কামরুল হাসান।' তিনি প্রফেসর উদয় চট্টোপাধ্যায়, আমাদের হলের ওয়ার্ডেন। আমাকে দেখে বললেন, 'ভালো কবিতা লেখো তুমি।' সেই থেকে স্যার আমার প্রিয় শিক্ষকদের একজন। তিনি মেটালারজির প্রফেসর, আমি পড়ি এ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং, যদিও আমাদের ডিপার্টমেন্ট যাওয়ার পথেই মেটালারজি ডিপার্টমেন্ট পড়ে, তবু আমি ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ছাত্র, ড. উদয় চট্টোপাধ্যায় আমার সরাসরি শিক্ষক নন। দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ছেন, প্রশংসা করছেন দেখেই বুঝেছি তিনি কবিতা ভালোবাসেন। মেটালারজির শিক্ষক নিজেও যে একজন কবি, তখন অনুমান করিনি। তিনি কবিতাটি 'দেশ' পত্রিকায় পাঠাতে বলেন এবং সেটি প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ তিনি ছিলেন জহুরি।
কবিতাই হলো আমাদের যোগসূত্র।। একবার পণ্ডিত শিবনারায়ণ রায় বিদ্যাসাগর হলে বিদ্যাসাগর স্মারক বক্তৃতা দিতে এলে সন্ধ্যায় স্যারের বাড়িতে সাহিত্য আড্ডা বসে। স্যার শিবনারায়ন রায়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কবিতা লিখি বলে আমিও আমন্ত্রণ পাই। তখন ক্যাম্পাসে যারা কবিতা লিখত তারা প্রায় সকলেই সে আসরে উপস্থিত ছিল। মনে আছে শচীদুলাল বিশ্বাস ও প্রণব ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন। কবিতা ও কবিদের ভালোবাসতেন বলে মাঝে মাঝেই তাঁর টেক মার্কেট সংলগ্ন সি-ওয়ান টাইপের বাংলো বাড়িতে কবিতার আসর বসাতেন। গৌরবর্ণের মানুষটিকে ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে বিদেশি সাহেবদের মতো লাগত। আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক, যুক্তিবাদী ও মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও আবেগসম্পন্ন - এই হল তাঁর পরিচয়।
ক্যাম্পাসে আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন অনেকেই, কবিতার টানটি ছিল ড. উদয় চট্টোপাধ্যায়, ড. ধনঞ্জয় সেন, ড. অমলেন্দু মুখার্জী, ড. তপন বসুর সাথে। অমলেন্দু মুখার্জী ছিলেন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক। তিনি বড়ো হয়েছেন রাজস্থানে, যেকারণে ভালো হিন্দি ও উর্দু জানতেন। মূলত উর্দু কবিতা পাঠ করে তিনি কবিতাপ্রেমী হয়ে ওঠেন। ইংরেজির অধ্যাপক ড. ধনঞ্জয় সেন আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমার কবিতা ভালোবেসে ইংরেজিতে অনুবাদ করে জিমখানার ম্যাগাজিন 'অলঙ্কার'-এ পাঠাতেন। ড. তপন বসু কবিতার চেয়ে আমাকেই বেশি ভালোবাসতেন, এর কারণ আমি তাঁর পিতৃপুরুষের দেশ বাংলাদেশের ছেলে। আমি ও আমার কবিতার প্রতি তাঁদের এই মমতা স্মরণে রেখে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত আমার প্রথম কাব্য 'সহস্র কোকিলের গ্রীবা' এই চার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষককে উৎসর্গ করি। দেবতুল্য এই মানুষদের প্রতি উৎসর্গীকৃৎ লাইন 'দেবতারা কখনো মর্ত্যে হাঁটেন' ছিল যথার্থ।
আই আই টি খড়গপুর ক্যাম্পাসটি ছিল একটি বর্ধিত পরিবারের মতো। শিক্ষকরা ছাত্রদের পরিবারের সদস্য মনে করতেন। একটি ছায়াসুনিবিড়, সুবিস্তৃত ক্যাম্পাসে জীবন ছিল শান্তিময় ও একাডেমিক পড়াশোনা কেন্দ্রিক। তাকে নিস্তরঙ্গ বলা যাবে না, কেননা সেখানে উৎসব লেগে থাকত। প্রতি সপ্তাহেই নেতাজি অডিটোরিয়ামে নতুন সিনেমা আসত, ১২টি হলে হল ডে পালিত হত সাড়ম্বরে। তবে সবচেয়ে বড়ো উৎসব ছিল জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে সপ্তাহব্যাপী বসন্ত উৎসব (Spring Fest) আর কালী পূজার অমাবস্যাতিথিতে দেওয়ালির আলোকসজ্জা ও আতশবাজি। হলগুলো অসংখ্য মাটির প্রদীপে আলোকের প্রাসাদ হত আর জিমখানায় জমত হাউই পোড়ানোর উৎসব। এই ক্যাম্পাসে বলতে গেলে গোটা জীবনটিই কেটেছে প্রফেসর উদয় চট্টোপাধ্যায়ের। বর্ধমানে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা, সেখান থেকে ম্যাট্রিক, কলকাতার অদূরেই বেলুড় মঠের একটি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে মেধাবী ছাত্রটি সেই যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আই আই টি খড়গপুরে এলেন শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন পুরোটাই কাটালেন এখানেই। বি টেক ও পিএইচডি খড়গপুর থেকেই। আমার ধারণা ছিল তিনি পিএইচডি করেছেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। স্যার জানালেন তিনি রাশিয়া গিয়েছিলেন পোস্ট ডক্টরেট (Post Doc) করতে ১৯৭০ সালে। এর দুবছর আগে তরুণ প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন নিজ আলমা মাটারে, বিয়ে করেছেন, ওই সত্তর সালেই, করুণা চট্টোপাধ্যায়কে।
রাশিয়ায় তাঁর সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় অধ্যাপক হায়াৎ মামুদের, যে বন্ধুত্ব আজীবন টিকে আছে। আমার মনে আছে উদয় চট্টোপাধ্যায় একবার বাংলাদেশে এলে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আই আই টি খড়গপুরের আরেক অ্যালামনাস জাহিদুল ইসলামের বাড়িতে দাওয়াতে স্যারের সাথে যোগ দিয়েছিলেন ড. হায়াৎ মামুদ। তাঁরা আলাপচারিতায় ফিরে গিয়েছিলেন রাশিয়ার তখন লেনিনগ্রাদ, এখন পূর্বের নাম ফিরে পাওয়া সেন্ট পিটার্সবুর্গে কাটানো দিনগুলোয়। রাশিয়ার পরে ড. উদয় চট্টোপাধ্যায় আরেকটি পোস্ট ডক করতে যান জার্মানির ডুসেলডর্ফে। তবে তিনি যতটা রাশান জানেন, ততটা জার্মান জানেন না। হায়াৎ মামুদের মতো কোন বই রাশান থেকে বাংলায় অনুবাদ করেননি। দুটো রাশান অনুবাদ করেছেন, তবে ইংরেজি থেকে আর সেগুলো সাহিত্যের বই নয়, বিজ্ঞানের বই। এদের নাম 'রসায়নের ১০৭টি গল্প', এবং 'রাসায়নিক মৌল আবিষ্কারের ইতিবৃত্ত'।
জার্মানিতে ফের গিয়েছিলেন ১৭ বছর পরে। এবার ড্রেসডেনে। দুই জার্মানি একত্রিত হবার আগে শহরটি ছিল পূর্ব জার্মানীর অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মুখোমুখি দুটি দেশের মাঝে তার পক্ষপাত রাশিয়ার প্রতি, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের জন্য। আমি যখন আই আই টিতে পড়ি তখন পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার। বামপন্থীরা কেন ব্যর্থ হল আমার এ প্রশ্নের উত্তরে স্যার জানালেন, পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষে স্থানীয় কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। স্থানীয় নেতারা সব ডেমি গড হয়ে গিয়েছিল, তুচ্ছ ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করত। যেমন কেউ বাড়ি বানাবে, কাজটা সিপিএমের লোকদের দিতে হবে। উদ্ধত আচরণ ছিল পার্টি কর্মীদের। বুঝলাম সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মতোই শ্রমিক শ্রেণির একনায়কতন্ত্র হয়ে উঠল পার্টির কিছু লোকের, যারা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির, একনায়কতন্ত্র। কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নে নয়, ভারতেও বামপন্থীরা পিছু হটল দুর্বল রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য, বাস্তবতা ভুলে থিউরি কপচানোর জন্য। এ প্রসঙ্গে স্যার একটি বহুশ্রুত চমৎকার উদ্ধৃতি দিলেন, 'If you do not become a communist in your 20s, and not disilluisioned at 45, you aren't rational'। স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে সকলেরই। এর সুযোগটি নিয়েছে ডানপন্থীরা।
আমি জানতাম স্যারের গবেষণা ও কাজের জায়গাটি হলো ধাতুর অবক্ষয় (metallic corrosion) ফাটল (cracking) ও ভেঙে পড়া (failure)। পরে জেনেছি তা পরিবেশের চাপ থেকে সৃষ্ট অবক্ষয় ও ভেঙে পড়া (stress corrosion cracking)। আমি যেহেতু বিমান প্রকৌশলবিদ্যা পড়েছি, তিনি একটি উদাহরণ দিলেন সে জগৎ থেকেই। যেসব বিমান নিচু দিয়ে ওড়ে, যেমন সী প্লেন, সেগুলো সমুদ্রজলের লবনাক্ততার কারণে বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং একসময় ফাটল ধরে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যায়। প্লেন, আমরা জানি, তৈরি হয় অ্যালুমিনিয়াম যৌগ (alloy) দিয়ে, ওজন হাল্কা রাখতে এর বিকল্প নেই। এই অ্যালুমিনিয়াম যৌগ অবক্ষয়-জাত ভাঙনের শিকার হয়। এর প্রতিকার হল যৌগের উপর বিশুদ্ধ অ্যালুমিনিয়ামের প্রলেপ দেওয়া। তিনি একটি ইন্দো-আমেরিকান সাবমেরিন প্রকল্পে গবেষক হিসেবে কাজ করেছিলেন। সাবমেরিনের বহিঃস্থ ধাতুনির্মিত খোলটিকে ক্যাথোডিক সুরক্ষা দেওয়া হয় সমুদ্রজলে ইস্পাতের অবক্ষয় রোধ করতে। সমস্যা হল ক্যাথোডিক বিক্রিয়ায় অতিরিক্ত হাইড্রোজেন ঢুকে পড়ে, যার ফলে ধাতু ভঙ্গুর হয়ে যায়। হাইড্রোজেন বেশি প্রবেশ করে দুটি ধাতব প্লেটের জোড়া অর্থাৎ ওয়েল্ডিং জয়েন্ট দিয়ে। বিজ্ঞানী দলটির কাজ হয়ে দাঁড়ায় ওয়েল্ডিং প্যারামিটারগুলো ঠিক করা। এসব থেকে একথা অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে একটি আকাশে ওড়া বিমান বা একটি জলের অতলে ভাসা সাবমেরিন- দুটোই প্রযুক্তির বিস্ময়-কত শত শত বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তির ফসল। সে গবেষণা কিন্তু থেমে নেই।
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু থেকে শুরু করে বাংলার অনেক খ্যাতিমান বিজ্ঞানী বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মাঝে দোদুল্যমান ছিলেন, কখনো কঠোর যুক্তিপ্রমাণের নিরেট সত্য, কখনো মনোলোকের নরম মিথ্যার মধ্যে তারা কেউ কেউ পেণ্ডুলামের মতো দুলেছেন। সত্যেন বোস মেতে ছিলেন সঙ্গীত নিয়ে। তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না, স্বয়ং আইনস্টাইন বেহালা বাজাতেন। এখানে প্রশ্নটি হলো সঙ্গীত বা কবিতা কি তাদের বিনোদন, মানসিক চাপ কমানোর নান্দনিক উপায়, না কি বিজ্ঞানের মতোই সাধনার বিষয়? এই দোলাচল প্রফেসর উদয় চট্টোপাধ্যায়েও আছে। কতটা বিজ্ঞান, কতটা কবিতা- এই পরিমাপে তাঁর পাল্লাটি ঝুঁকে আছে বিজ্ঞানের দিকে। দেশি ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর গবেষণাপত্র রয়েছে একশোর বেশি। অসংখ্য মাস্টার্স থিসিস তো আছেই, নয়জন গবেষক তাঁর তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছে, শ্রেণিকক্ষে পড়িয়েছেন ৪২ বছর, ভারত ও ভারতের বাইরে অসংখ্য কনফারেন্স ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন, উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন অনেক প্রকল্পে। তুলনায় কবিতার বই মাত্র তিনটি। ১। আমার ছায়ারা (১৯৮৯) ২। সব ফুলই সূর্যমুখী (১৯৯৭) ৩। কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্না (২০০৬)। 'এরপর?' আমার প্রশ্নে স্যার বললেন, 'এর আর পর নেই। এখন আর কবিতা আসে না। অথচ কখনো গভীর রাতে ঘুম ভেঙে উঠে ২/৩ টি কবিতা লিখেছি; হাওড়া-খড়গপুর লোকাল ট্রেনে চড়ে যেতে যেতে কবিতা লিখেছি। কবিতা মুডের উপর নির্ভর করে, এটা আসে। জোর করে লিখতে গিয়ে দেখেছি, হয় না।' অথচ একসময় সাপ্তাহিক 'দেশ' পত্রিকায় তাঁর কবিতা নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
আইআইটি খড়গপুরের মেটালারজি বিভাগটি মনে হয় লিবারেল আর্টস প্রভাবিত। উদয় চট্টোপাধ্যায় স্যারের বন্ধু, তিনিও মেটালারজিতে ডক্টরেট, অমিত গাঙ্গুলি, কবিতা লেখেন, গান করেন। একবার দিল্লিতে সার্ক সাহিত্য উৎসবে যোগ দেবার পথে কলকাতায় স্টপেজে আমি ও ঝর্না রহমান এক সন্ধ্যায় উদয় চট্টোপাধ্যায় স্যারের আতিথ্য নিয়েছিলাম, সেদিনই পরিচিত হই অমিত গাঙ্গুলির সাথে। মেটালারজি ডিপার্টমেন্ট বর্তমানে অধ্যাপনারত ড. নিরুপম চক্রবর্তীও একজন কবি। নিরুপম চক্রবর্তী হলেন অধ্যাপক অমিত গাঙ্গুলির সরাসরি ছাত্র। 'নিরুপম ভালো কবিতা লেখে', উদয় স্যার জানালেন। সেটা আমিও টের পেয়েছি। শান্তিনিকেতনে অঙ্কের এক অধ্যাপককে চিনি, প্রশান্ত চ্যাটার্জী, তিনিও কবিতা লিখেন। যুক্তি ও আবেগের মেলবন্ধনে তারা নিমগ্ন।
কেবল ওই একবার নয়, আমি যখনি কলকাতা যাই, সল্টলেকে স্যারের বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করি। লুবনা ও আমার দুই মেয়েকে নিয়ে যেবার আই আই টিতে গিয়েছিলাম কলকাতায় স্যারের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলাম। স্যার তখনো আই আই টিতে পড়াচ্ছিলেন। হায়দ্রাবাদ হোক কিংবা দিল্লি, ফেরার পথে কলকাতা থামলে আমার একটি গন্তব্য হয় উদয় চট্টোপাধ্যায় স্যারের বাড়ি। তাঁর প্রতি আমি কতখানি অনুরক্ত বা তিনি আমাকে কতখানি প্রশ্রয় দেন তা বোঝানোর জন্যই ওই উদাহরণ টানা। কবিতার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ লিখেন। প্রথম গদ্যের বই 'লঘুগুরু' বেরোয় ২০০৮ সালে। গতবছর বেরুল 'শব্দ নিয়ে এবং অন্যান্য'। 'শিবনারায়ণ রায়ের সাথে একটি সন্ধ্যা' নামের একটি নিবন্ধে সেই সন্ধ্যাটি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। আমার 'নির্বাচিত কবিতা' নিয়েও একটি রিভিয়্যু লিখেছিলেন। দুটি লেখাই এ বইতে আছে। চতুর্থ কবিতার বইটি তাঁর তিন কাব্য থেকে নির্বাচিত কবিতা ও অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এবং কী মধুর অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার- বইটি আমাকে উৎসর্গ করেছেন বলে জানালেন। এর চেয়ে বড়ো সম্মান আর কী হতে পারে? আমি রীতিমতো অভিভূত! আমার যখনি বই প্রকাশিত হয়েছে স্যারকে পাঠিয়েছি বা নিজে নিয়ে গেছি। স্যারও তাঁর বই আমাকে উপহার দিয়েছেন।
সেদিন টেলিফোনে স্যারের সাথে কথা বলার সময় তিনি বললেন, 'এখনকার আই আই টিকে তুমি চিনতে পারবে না। আগের সেই বাংলো বাড়িগুলো আর নেই। সেগুলো ভেঙে তিনতলা সব এপার্টমেন্ট হাউজ উঠেছে। আই আই টির মুখের দিকে আর তাকানো যায় না।' আমার মনে আছে এ-টাইপ, বি-টাইপ, সি-টাইপ একতলা বাংলো বাড়িগুলোর কথা। প্রফেসরদের এ-টাইপ বাংলোগুলো ছিল সরকারি অতিথিশালার মতো, সামনে ফুলের বাগান, পেছনে বিবিধ ফলের গাছ, রাজার হালে থাকতেন অধ্যাপকগণ। উদয় চট্টোপাধ্যায় স্যার প্রথমে সি-ওয়ান টাইপ বাংলো, পরে বি-ওয়ান টাইপ বাংলো এবং অবশেষে বি-টাইপ এপার্টমেন্ট হাউজে চলে যান। এ-টাইপ বাংলোয় যেতে পারতেন, যাননি। অতিরিক্ত নির্জনতা শুধু নয়, বিচ্ছিন্নতা তাঁর হয়তো পছন্দ নয়। তাদের বি-টাইপ এপার্টমেন্টের নিচ তলায় থাকতেন উদয় চট্টোপাধ্যায়, তিনতলায় থাকতেন অমলেন্দু মুখার্জী। দুজনে ভীষণ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। খড়গপুর যে বদলে গেছে তা আমিও দেখেছি, আগে ছাত্র-শিক্ষকগণ- সকলেই সাইকেলে চড়ে ক্যাম্পাসে চলতেন। পরে দেখেছি মোটরবাইক। এখন গেলে সুপ্রচুর গাড়ি দেখি শিক্ষকদের। আয় বেড়েছে, সঙ্গে বেড়েছে পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি।
তাঁর জীবনের একটি মাইলফলক হল Environmental Degradation of Metal নামের পেশাগত বিষয়ে লেখা বই ২০০১ সালে আমেরিকার মার্সেল ডেকার প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশ। এছাড়া জনপ্রিয় বিজ্ঞান সিরিজে তাঁর লেখা 'ধাতুর কথা'র দুটি সংস্করণ পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। সেদিন টেলিফোনে কথা বলার সময় অনেক বছর আগে তাঁকে লেখা আমার চিঠির একটি লাইন স্যার স্মরণ করলেন। আমি লিখেছিলাম, 'জীবনটাকে পেছনে নিয়ে আবার যদি শুরু করা যেত, তাহলে পেছনের ভুলগুলো সংশোধন করতে পারতাম।' আমি বললাম, এখনো আমি সে চাওয়া থেকে সরিনি। আমার আক্ষেপ দেখে স্যার রবীন্দ্রনাথের গানের চরণ মনে করিয়ে দিলেন, " নাহয় তোমার যা হয়েছে তাই হল/আরো কিছু নাই হল।" উদয় চট্টোপাধ্যায় স্যার আমাকে অনেককিছু শিখিয়েছেন। আজ শেখালেন কী করে পরাজয়ে মাথা উঁচু করে রাখতে হয়, সত্যকে সহজভাবে গ্রহণ করতে হয়। ঋষিতুল্য মানুষটিকে প্রণাম!
অধ্যাপক কামরুল হাসান
আপনার মতামত দিন: