Saha Suravi

Published:
2024-08-30 12:12:01 BdST

"আলী স্যার বললেন, এ রকম জানলে আপনার বাসায় আমি খাওয়াদাওয়াই করতাম না"


"মহাকালের যাত্রী 'র লেখক অধ্যাপক ডা. মাহবুব মোতানাব্বি;প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ , প্রাক্তন অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা

পাঠকপ্রিয় আলোচিত বই
"মহাকালের যাত্রী 'র লেখক অধ্যাপক ডা. মাহবুব মোতানাব্বি অপূর্ব সব গল্প লেখেন সমকালীন ও মানবিক বিষয়ে । এমনই একটি মর্মস্পর্শী কাহিনি তাঁর নিজের জীবন থেকে। লেখাটি পত্রস্থ করা হল।

অধ্যাপক ডা. মাহবুব মোতানাব্বি
বিশিষ্ট লেখক ও প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ , প্রাক্তন অধ্যাপক,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা
_____________________

আখাউড়ায় রাধানগর ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে আমার শিক্ষক ছিলেন আলী স্যার।আলী মাস্টার নামেই পরিচিত ছিলেন। আমাকে সন্ধ্যায় প্রাইভেট ও পড়াতেন। দশ বিশ টাকা অতিরিক্ত আয়ের জন্য ঘণ্টা দু ঘন্টা তিনি আমাকে পড়াতেন।ঘন ঘন ঘড়ি দেখতেন না।
ক্লাস ফোর পাস করার পর আব্বা দেখলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই ফার্স্ট হওয়াটা অনেকটা বিনা ভোটের নির্বাচনের মতো হয়ে যাচ্ছে। তখন বড়মামার পরামর্শে আব্বা আমাকে ভর্তি করে দিলেন তখনকার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ কুমিল্লা জিলা স্কুলে।কিন্তু আলী স্যার যেহেতু আশা করছিলেন আমি প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দেবো,তাঁকে আর ব্যাপারটা জানানো হলো না। কিন্তু জিলা স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে বার বার চাপ দিতে লাগলো ট্রান্সফার সার্টিফিকেটের জন্য।
শেষে আব্বা একদিন আলী স্যারকে দাওয়াত দিয়ে ভালো খাওয়া দিলেন। তারপর বললেন, আমার স্কুল পরিবর্তনের কথা। ক্ষুব্ধ, উত্তেজিত আলী স্যার বললেন, এ রকম জানলে আপনার বাসায় আমি খাওয়াদাওয়াই করতাম না। বৃত্তি পেলে স্যারের বেতন, ইনক্রিমেন্ট কিছুই বাড়তো না।ছাত্রের কৃতিত্বের অংশীদার হওয়ার জন্য বাজী ধরেছিলেন স্যার।বাজীর ঘোড়া হারিয়ে আহত সিংহের মতো ফুঁসছিলেন।তিরিশ বা চল্লিশ টাকা বেতনের এই স্কুল শিক্ষককে আমি দরিদ্র বলতে পারবো না কিছুতেই। স্বল্প আয়ের এ শিক্ষক অর্থ বিত্তের আকাঙ্ক্ষা করেন নি।শুধু একটি বিমূর্ত স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছেন।অনেক দিন গেছে। স্যার বেঁচে আছেন কিনা,জানি না।কিন্তু আমার দু হাত সবসময় স্যারের পদতলে।
একবার খাবার টেবিলে বসা অবস্থায় এক স্যারের ফোন আসলো।আমি উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার ছেলে অবাক হয়ে তার মাকে বললো,'আম্মু, কার ফোন আসলো?বাবা এভাবে উঠে দাঁড়িয়ে গেল?'
আমি ও একজন নগণ্য শিক্ষক। নিজের পড়ানো নিয়ে আমি নিজেই কখনো সন্তুষ্ট হতে পারি নি। তারপর ও লোভ বলে কথা!যখন দেখতাম আব্বার ছাত্র ছাত্রীরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের সামনে 'স্যার' বলে ঝুপ করে সালাম করে ফেলে, তখন ভাবতাম, 'এটা কেমন পেশা?বয়স্ক লোকেরা ও এত ভক্তি করে! '
কুমিল্লা জিলা স্কুলের নূর আহমদ স্যার, সামাদ স্যার এঁদের মনে হতো নায়ক।কিশোর বয়সে মনে হতো, আমি কি কখনো নায়ক হতে পারবো?
আর ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে তো মি.হুমায়ূন কবীরকে যেকোনো অর্জনের কথা না বলা পর্যন্ত মনে হতো,আমার এ অর্জনই বৃথা। মি.হাসানের সাথে আলোচনা করেছি, রবীন্দ্রনাথের ভাবনার আদি-অন্ত।
তাঁদের ব্যক্তিত্ব ছিল আলাদা। পাকিস্তানের দোর্দণ্ড প্রতাপ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের চিঠি নিয়ে এসেছিল এক ছাত্র ভর্তি হওয়ার জন্য। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল লে.কর্নেল মরিস ব্রাউন ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া সে ছাত্রকে ভর্তি করেন নি।
শিক্ষকরা আমাদের সামনে জীবনের আনন্দের দ্বার খুলে দিয়েছেন। আমার ও জীবনের একটা-ই অপ্রাপ্তি ছিল শিক্ষক হতে না পারা।তারপর দীর্ঘ তিরিশ বছর শিক্ষকতা করেছি। আগেই বলেছি, পড়িয়ে আমি নিজেই সন্তুষ্ট না।একটাই প্রাপ্তি, ছাত্র ছাত্রী দের ভক্তি। যখন অনেক বয়স্ক বিশেষজ্ঞ ছাত্র ছাত্রীরা প্রকাশ্য জনসমাগমে ঝুপ করে সালাম করে বসে,আমার স্ত্রীর পাশ থেকে অভিব্যক্তি থাকে, 'তুমি এক জীবনে আর কি চাও?'
সাজেকের মতো অপরিচিত জায়গায় আমার এক ছাত্রীর সাথে দেখা।
সে তো বটেই,তার বাবা- মা ও অতি ভক্তিসহকারে স্যার -স্যার বলে সম্বোধন করতে থাকলেন।
এই ভক্তিবাদের দেশে হঠাৎ কি হলো?
ছাত্র ছাত্রীরা শিক্ষক /প্রধান শিক্ষককে টেনে চেয়ার থেকে তুলে ফেলছে। এক শিক্ষক প্রচন্ড মানসিক চাপে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন।
জেন জি কে কি আমরা ভুল সংকেত দিয়ে ফেলেছি? হয়তো বা।তবে তার চেয়ে ও বেশি হলো কতিপয় শিক্ষকের অধঃপতনই এ পথ করে দিয়েছে।
শিক্ষকরা অর্থ বিত্ত ও রাজনৈতিক দাসত্ব এতো বেশি শিখেছেন , শিক্ষাগুরুর আসন এখন টলোমলো। আমার প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই যদি ধরি,অনেক শিক্ষকই আছেন যাঁরা পড়াশোনা, গবেষণা ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না।বহু গবেষণাপত্র,অনেক বার উদ্ধৃতি, টেক্সট বুকে তাঁদের রেফারেন্স আছে।
আবার এমন ও আছেন,ভি সি হয়ে গেছেন, কিন্তু প্রফেসর হওয়ার মতো যোগ্যতা ও নেই।পুরো সময় দলবাজি করেছেন। রাজনৈতিক আখড়ায় পরিণত করেছেন শিক্ষাঙ্গনকে।এক দুর্নীতিবাজ প্রো ভি সি এবং তাঁর সহযোগীরা আমার ডিপার্টমেন্টে জুনিয়রকে সিনিয়র করে এবং আরো নানা অনিয়ম করে বিভাগের সৌহার্দ্য, পরিবেশ সব নষ্ট করে দিয়েছেন। এমনকি বিদেশি ছাত্রকে ও উস্কানি দিয়েছেন শিক্ষকের সাথে বেআদবি করতে। এ ধরণের শিক্ষকরা কি সম্মান আশা করতে পারেন?আইনানুগ বিচার না হওয়ায়ই মানুষ বেআইনি পথে চলে যায়।
তারপর ও শিক্ষক ছাত্রের যে সম্পর্কের কথা প্রথমে উল্লেখ করেছি, তা ভেঙে পড়লে সবই ভেঙে পড়বে। সবচেয়ে ভালো হয়,শিক্ষকরা সংশোধিত হয়ে আবার আগের সম্মানের জায়গায় বসুন।
১.দলীয় রাজনীতি ও সেবাদাসের ভূমিকা ছেড়ে দিন।
২. এ পেশার সম্মান বাঁচিয়ে রাখতে হলে কষ্ট হবে, এটাই মেনে নিন।
৩.নিজেদের মধ্যে ক্ষুদ্র স্বার্থে রেষারেষি করে ছাত্রদের চোখে হেয় হবেন না।
৪.প্রথম পরিচয় শিক্ষাগুরু।পড়াশোনা না করে, ছাত্রদের ঠিকমতো না পড়িয়ে নিজেকে বাতিলের খাতায় ফেলবেন না।
৫.ছাত্র অভিভাবকদের সাথে দুর্ব্যবহার করে নিজেকে শত্রু বানাবেন না।
আর ছাত্রদের বলি,শিক্ষক হারালে তোমাদের ছাত্রত্বই থাকবে না।
কেউ কেউ শিক্ষকদের নিয়ে ও বিভাজনের চেষ্টা করবে।তোমরা বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে না । আমার পিতার উপর অভিমান করতে পারি।
বিচার করতে চাইলে পরিবারের শৃংখলাই ভেঙে পড়বে।
শিক্ষক অন্যায় করলে অভিযোগ করতে পারো,বিচারের ভার তোমাদের উপর না।

@

লেখক

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়