ডেস্ক

Published:
2024-03-08 12:03:53 BdST

আজ থেকে দু' তিনশ বছর আগে নারীরা কেমন ছিলেন


ছবি সৌজন্য  প্রতীক্ষা, (attente) peint par Afroza Khondoker (Afroza's online art studio) রাজিক হাসান এর মাধ্যমে পাওয়া

 

রাজিক হাসান
____________________

আজ থেকে দু' তিনশ বছর আগে নারীরা কেমন ছিলেন? সমাজ তাদের কেমন চোখে দেখতো তখন? তাদের সাথে সমাজের আচরণ কেমন ছিল?

তখন তাদের শিক্ষার অধিকার ছিল না। মত প্রকাশের অধিকারও ছিল না। নারী সন্তানের জন্ম দেয়া পাপ মনে করা হতো। উচ্চ বর্ণের হিন্দু বিধবাকে তার মৃত স্বামীর সাথে সহমরণে যেতে হতো। নারীকে দাসী হিসেবে কেনা বেচাও করা যেতো। এক কথায় বলা যায় ঘরের গৃহপালিত পশুর মর্যাদা পেত তারা। তার বেশি কিছু নয়।

ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম যে নারী আন্দোলন হল তা রাজা রামমোহনের নেতৃত্বে সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ আন্দোলন। নারী বিধবা থাকবে তবুও মৃত স্বামীর সাথে তারা সহমরণে যাবে না। পার্লামেন্ট থেকে আইন পাশ করতে হল। একবার ঠান্ডা মাথায় ভাবুন, কতটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। অনেকে আবার আইন অমান্য করল। তাদের জেল জরিমানা হল। তারপর সময়ের সাথে সতীদাহ প্রথার বিলুপ্তি হল।

এরপর শুরু হল বিধবা বিবাহ প্রথার আন্দোলন। নেতৃত্বে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর শুধু বিধবাদের বিবাহ দেবার আন্দোলনই করলেন না, সেই সাথে নারীদের শিক্ষিত করে তুলবার আন্দোলনও চাঙ্গা করে দিলেন। বহুবিবাহ ও বাল্য বিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণের আন্দোলন। বিধবা নারীদের নতুন সংসার হল। সমাজ প্রচন্ড বিরোধিতা করল। তারপর সময়ের সাথে তারা মেনেও নিল। আজ আর কেউ বিধবা বিবাহের বিরোধিতা করে না।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন নারীশিক্ষার পথিকৃৎ। তিনি অনেকটা নিজের অদম্য ইচ্ছার কারণে শিক্ষিত হন। শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ও সেবাব্রতে তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা ইতিহাসে বিরল। রবীন্দ্রযুগে যে কয়জন বাংলা সাহিত্য সাধনা করে যশ ও খ্যাতি অর্জন করেন, নবাব ফয়জুন্নেসা তাদের মধ্যে অন্যতম। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে নবাব ফয়জুন্নেসার নাম চিরস্মরণীয়।

বেগম রোকেয়ার যখন জন্ম হয় বাঙালি মুসলমান নারীর শিক্ষার অধিকার তখন ছিল না। বেগম রোকেয়া জ্ঞানপিপাসা ছিল অসীম। গভীর রাত্রিতে সবাই ঘুমালে চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে বালিকা মোমবাতির আলোয় বড় ভাইয়ের কাছে ইংরাজী ও বাংলায় পাঠ গ্রহণ নিতো। পদে পদে গঞ্জনা সয়েও দিনের পর দিন শিক্ষার দ্রুত উন্নতি হল। কতখানি আগ্রহ ও একাগ্রতা থাকলে মানুষ শিক্ষার জন্য এমন কঠোর সাধনা করতে পারে তা ভাববার বিষয় বটে। তিনি বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং প্রথম বাঙালি নারীবাদী।

বেগম রোকেয়া হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। তার রচনা দিয়ে তিনি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন, শিক্ষা আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবে না --তা বলেছেন।

রোকেয়া অলঙ্কারকে দাসত্বের প্রতীক বিবেচনা করেছেন এবং নারীদের অলঙ্কার ত্যাগ করে আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে আর্থরাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন,

"পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জ্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডীকেরাণী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডীমাজিস্ট্রেট, লেডীব্যারিস্টার, লেডীজজ — সবই হইব!... উপার্জ্জন করিব না কেন?... যে পরিশ্রম আমরা "স্বামী"র গৃহকার্য্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?... আমরা বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন করি না বলিয়া তাহা হীনতেজ হইয়াছে। এখন অনুশীলন দ্বারা বুদ্ধিবৃত্তিকে সতেজ করিব। যে বাহুলতা পরিশ্রম না করায় হীনবল হইয়াছে, তাহাকে খাটাইয়া সবল করিলে হয় না?"

নারী অধিকার আন্দোলনের আরেক উল্লেখেযোগ্য নাম ইলা মিত্র। ইলা মিত্র একজন বাঙালি মহীয়সী নারী এবং সংগ্রামী কৃষক নেতা। তিনি মূলত তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সংগ্রাম করেছেন। ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। ছিলেন হিন্দু কোড বিল এর বিরুদ্ধে মহিলা সমিতির আন্দোলনের নেত্রী। সেইসময় তিনি সনাতনপন্থীদের যুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। বিয়ের পর সমাজে কন্যা-শিশুদের অবস্থা দেখে বাড়িতে স্কুল খুলে নিজেই শিক্ষকতা শুরু করেন।

এরপর ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পেল বাঙালি নারীর শিক্ষার অধিকার; মত প্রকাশের অধিকার। আজকে যে নারীরা বিভিন্ন চ্যাপ্টারে মত প্রকাশ করছেন তা কিন্তু রাতারাতি সম্ভব হয় নি। আজকের যে শিক্ষিত, আদর্শিক নারী তা কিন্তু একদিনেই হয়ে ওঠে নি। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য নারী পুরুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা।

আজকের যে নারী সমাজ তা হাজার বছরের প্রচেষ্টার ফসল। আজ থেকে পরের যে নারী সমাজ আসবে তা হবে আজকের প্রচেষ্টার ফসল। সুতরাং আজকে আমাদের নারী - পুরুষ সব বিভেদ ভুলে সবাইকে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের মা, আমাদের বোন আমাদের কন্যা, সর্বোপরি আমাদের ভবিষ্যৎ নারী সমাজকে দেখতে চাই।

আজকের অতি নারীবাদ একটি পুরুষতান্ত্রিক বিকার। অসহায় নারীদের সাহায্য করতে তো নারীবাদী হবার কোন প্রয়োজন পড়ে না। প্রয়োজন পড়ে মানবতাবাদী হওয়ার। ব্যাক্তি স্বাধীনতা যেমন স্বীকার্য্য, সামাজিক দায়বদ্ধতাও তেমনি অলংঘনীয়। জয়হোক মানবতার।

এ বছর নারী দিবসে জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য হল “নারীদের উপর বিনিয়োগ করুন : দ্রুত উন্নতি আনুন”। নারীর প্রতি সবরকম বৈষম্য ও অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটিয়ে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বিশ্বগড়ার কাজে পুরুষের সমান অবদান রাখার প্রত্যয় নিয়ে নারীর এগিয়ে চলা আরও বেগবান হোক।

বন্ধুদের সবাইকে বিশ্ব নারী দিবসের প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
--------------------------------------

ছবি সৌজন্য 

প্রতীক্ষা, (attente) peint par
Afroza Khondoker (Afroza's online art studio)

রাজিক হাসান এর মাধ্যমে পাওয়া

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়