SAHA ANTAR

Published:
2024-03-07 17:21:51 BdST

চিনিকে কেমন করে চিনবেন


 

ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
______________________

চিনি বা টেবল সুগার, একটি নীরব ঘাতক৷ যেমন কার্বন মনোক্সাইড বা পটাসিয়াম সায়ানাইড সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করে, চিনি আদৌ তা নয়।
রবি ঠাকুর লিখেছিলেন -" যদি তারে নাই চিনি গো চিনি "। আজকের যুগে বেঁচে থাকলে নির্ঘাত লিখতেন, " ভাগ্যিস তুমি আসোনি, আমার জীবনে কভু "।
বুঝতেই পারছেন এটি নেহাৎ ই মজা করে লেখা। রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর এতাবৎ কালের পুরুষোত্তম নিঃসন্দেহে। রবীন্দ্রপ্রেমীরা মাফ করবেন, উনি আমারও জীবনের ধ্রুবতারা, পরম পূজ্য।
এই চিনি হলো সেই চিনি যাকে না চিনলেই ভালো হতো । এক অর্থে এই চিনি খাদ্য বা পানীয়ের সঙ্গে গ্রহণ / পান করলে তা অ্যালকোহলের থেকেও খারাপ, ক্ষতির নিরিখে।
আমাদের ব্যবহারের চিনি, যার নাম সুক্রোজ আসলে অর্ধেক ফ্রাক্টোজ আর অর্ধেক গ্লুকোজ। এইবারে গ্লুকোজের শরীরে বিপাকীয় কাজে প্রয়োজন আছে, বা ভালো ব্যবহার করা যায়। দুঃখের হলেও সত্যি কথা যে ফ্রাক্টোজ বা ফ্রুক্টোজের তা নেই আদৌ। চিনি যুক্ত খাদ্য বা পানীয়ের সঙ্গে শরীরে গেলে তা পাকস্থলী থেকে শোষিত হয়। ও রক্তে মেশে। এবারে গ্লুকোজ শরীরের কোষে কোষে পৌঁছয়, এবং ইনসুলিন ক্ষরিত হয়। এই ইনসুলিনের সাহায্যে শরীরে গরিষ্ঠাংশ কোষের অন্দরে প্রবেশ করে গ্লুকোজ এবং ক্রেবস সাইক্ল এর পথে ATP ( Adenosine Tri Phosphate) বা শক্তি তৈরী করে যা কোষের ব্যাটারি মিটোকন্ড্রিয়া তে শক্তির যোগান দেয়, বিভিন্ন রকম বিপাকীয় কাজকর্মের জন্য। ( অবশ্য অধিক কোন কিছুরই ভালো না) ।

এদিকে ফ্রুক্টোজ ( একে ফ্রুট সুগার ও বলে) কিন্তু রক্তে শোষিত হয়ে লিভারে জমা হয়। ইথাইল অ্যালকোহলে পান করলে তাও পাকস্থলী থেকে রক্তে শোষিত হয়, কিন্তু ইথাইল অ্যালকোহলের মস্তিষ্কে প্রবেশ করার জন্যে ইনসুলিনের উপস্থিতি আবশ্যক নয়। ১৫% -২০%অ্যালকোহল মস্তিষ্কের কোষগুলিতে প্রবেশ করে। এটি মস্তিষ্কের উচ্চ কেন্দ্র বা নিবারক কেন্দ্র গুলিকে বিবশ করে ফেলে। আমরা সাধারণ অবস্থায় আমাদের মস্তিষ্কের উচ্চতম কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে থাকি, এবং অসংলগ্ন বা অন্যায় কিছু করতে গেলে উচ্চতর কেন্দ্র তাতে নিরন্তর বাধা দেয়। কিন্তু অ্যালকোহলের প্রভাবে বিবশ উচ্চতর কেন্দ্রগুলি আর বাধা দিতে পারে না। এই অবস্থায় সাধারণত ভালো লাগার অনুভূতি বা নেশা হয় এবং সেটি আমরা বুঝতে পারি। সেজন্যই গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগে কেউই সুরাপান করেন না সাধারণতঃ।
বাকি ৮০ বা ৮৫ % কিন্তু শরীরের অন্য কোন কাজেই আসে না, এবং আমাদের লিভারকেই এই সাফাই প্রকল্প হাতে নিতে হয়। লিভার প্রথমে অ্যাসিটালডিহাইড ও পরে অ্যাসিটোনে পরিবর্তন করে, এই শেষের বস্তুগুলিকে, শ্বাসের সঙ্গে, ঘামের সঙ্গে এবং বেশিরভাগ মূত্রের সঙ্গে দেহের বাহির করে দেয়। উল্লেখ্য যে অ্যালকোহল কোন শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্যই আদৌ প্রয়োজনীয় নয়।
তবে যারা নিয়মিত এবং অধিক মদ্যপান করেন সেক্ষেত্রে লিভারের পক্ষে সম্ভবপর হয় না এই কর্মটি করা, এবং এই অ্যালকোহল তখন কিছুটা ইনসুলিনের সহায়তায় লিভারে ফ্যাট হিসেবে জমা হতে থাকে। দীর্ঘদিন চললে তা লিভারের ক্ষতি করে এবং প্রথমে যেটি হয় তা হলো Alcholic Fatty Liver Disease ( AFLD) । মদ্যপানের আরো বাড়াবাড়ি হলে লিভার আরো ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।
এবারে আসি ফ্রুক্টোজের বেলায়। ফ্রুক্টোজ আদৌ মস্তিষ্ক অবধি পৌঁছে না, তাই অনেক চিনি বা ফলের রস খেলেও আমাদের মস্তিষ্ক বুঝতে পারে না, কাজেই নেশা হওয়ারো প্রশ্ন নেই।

এছাড়াও আরেকটি ঘটনা ঘটে। ফ্রুক্টোজের প্রবল উপস্থিতি তে, আমাদের পাকস্থলী পূর্ণ হলে যে হরমোন টি ক্ষরিত হয়, যার জন্য আমরা খাওয়া শেষ করি। পেট ভরে গেছে, উফফ - এই অনুভূতি টি হয়। অত্যধিক ফ্রুক্টোজের উপস্থিতি তে এই হরমোন টি ক্ষরিত হয় না, বা মস্তিষ্ক অনুভব করতে পারে না। তাই আমরা খেয়েই চলতে থাকি। এই হরমোন টির নাম লেপ্টিন ( leptin)।

লিভার কে কিন্তু ইনসুলিনের সাহায্যে লিভারেই এই ফ্রুক্টোজ কে ফ্যাট হিসাবে জমা করে। ফ্রুক্টোজ দীর্ঘকাল বারে বারে খেলে বা পান করলে তা লিভারে ফ্যাট হিসেবেই জমা হতে থাকে। এই অবস্থায় লিভারের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয় ও এই ডাক্তারি মতে এই অবস্থা কে বলে (Non -Alcoholic Fatty Liver Disease) বা NAFLD।
এই দুই AFLD ও NAFLD র লিভারে ক্ষতি প্রায় তুল্যমূল্য। আমরা শিশু ও বালক বালিকা বা কিশোর কিশোরী দের অ্যালকোহল পানীয় দেওয়ার কথা ভাবতেই পারিনে, কিন্তু চাইলেই চিনি ভর্তি ফ্রুট জুস, বা কোল্ড ড্রিংকস দিতে দ্বিধা করিনে। পেস্ট্রি, কেক বা চকোলেট ও চিনিতে ভরপুর। এবারে লিভারে এই অতিরিক্ত ফ্যাট ই কিন্তু ইনসুলিন রেজিস্টেন্স, এবং পরে ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেসার, হার্টের অসুখ এমনকি আলঝিমার্স ডিমেনশিয়া এমনকি কয়েকটি ক্যানসারের সঙ্গেও সংপৃক্ত। সঙ্গে যোগ করুন হাইপারইউরিসিমিয়া বা রক্তে বেশি ইউরিক অ্যাসিড ও গাউট ( Gout) বা একধরণের গেঁটেবাত। প্রতিদিনের সাধারণ বিস্কুটে ও প্রচুর চিনি থাকে।
এতে স্থুলতা, এবং পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজেরো সম্ভাবনা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে।
আসলে চিনি সস্তা এবং নুনের মতই খুব ভালো প্রিজারভেটিভ ও বটে। দেখবেন কড়া রসের মিষ্টি বহুদিন খারাপ হয় না।

এবারে সুধী পাঠক পাঠিকা এবং বন্ধুগণ কি করবেন, নিজেদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের জীবনে ঠিক করবেন।
#

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়