SAHA ANTAR

Published:
2023-11-25 16:45:26 BdST

আইনস্টাইন টেলিফোন বই বের করে তাঁর নিজের নম্বরটা খুঁজতে লাগলেন.....


লেখক রাজিক হাসান

 

রাজিক হাসান
লন্ডন থেকে
__________

আইনস্টাইনের এক সহকর্মী একদিন আইনস্টাইনের কাছে থেকে টেলিফোন নম্বরটা চাইলেন। আইনস্টাইন তখন একটি টেলিফোন বই বের করে তাঁর নিজের নম্বরটা খুঁজতে লাগলেন। সহকর্মী তাকে বললেন, ‘কী ব্যাপার, নিজের টেলিফোন নম্বরটাও মনে নেই আপনার।’ আইনস্টাইন বললেন, ‘না। তার দরকারই বা কী? যেটা আপনি বইতে পাবেন, সে তথ্যটা মুখস্থ করে মস্তিস্ক খরচ করার কী দরকার?

ইউরোপে দেখেছি কোমলমতি শিশুদের দশ বারটি সাবজেক্ট নেই, মুখস্ত করার বালাই নেই। সেখানে নেই বস্তার মতো ভারী স্কুল ব্যাগ, প্রতিটা বিষয়ের জন্য আলাদা কোচিং, গৃহশিক্ষক, নোট বা গাইডবই। সেখানে নেই প্রথম দ্বিতীয় হবার কোন অসুস্থ প্রতিযোগিতা। সবাই খেলতে খেলতে অক্ষর চেনে, গুনতে-লিখতে-পড়তে শেখে। শেখে নানা সৃজনশীল বিষয়। শেখে সততা ও নৈতিকতা।

সেখানে দলবেঁধে জঙ্গলে গিয়ে স্কুলের ছেলেরা নানা গাছ, ফুল, লতা-পাতার ছবি আঁকে, দিনে সময়ের সাথে সূর্যের খেলা দেখে, পুকুরে সাঁতার কাটা মাছ ধরা শেখে, শেখে নৌকা চালানো। তারা ঘোড়া দেখে এসে ঘোড়ার উপর রচনা লেখে, কেউ কাঠ কেটে বা পাথর ঘষে বানায় বিভিন্ন জিনিস, যাকে বলে শিল্পচর্চা। মজার এক্সপেরিমেন্ট করে আলো জ্বালায়, চুম্বক দিয়ে খেলনা-গাড়ি বানায়। এতে করে তারা কেউ পায় সৃষ্টির আনন্দ, কেউ পায় বৈজ্ঞানিক কৌশল ও আবিষ্কারের আনন্দ, কেটে যাচ্ছে তাদের লজ্জা, ভয়, শংকা, শিখছে নিয়মানুবর্তিতা।

বিভিন্ন খেলাধুলা ছাড়াও শিখছে গান, কবিতা-আবৃত্তি, গল্প বলা, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি, অভিনয়, হচ্ছে প্রতিভার বিকাশ। সেলাই শিখে, বিস্কিট-পিজ্জা বেক করে শিখছে আত্মনির্ভরশীল হতে। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট কন্টেইনারে ফেলে শিখছে পরিচ্ছন্নতা। ছাত্র-শিক্ষক মিলে দাবা খেলে করছে বুদ্ধির চর্চা, যোগ-ব্যায়ামে শিখছে ধৈর্যশীল হতে। বাগান করে শিখছে গাছ লাগানো ও পরিবেশ পরিচর্যার উপায়।

পাঁচটি বেসিক বিষয় নিয়ে পড়বে আর সেই পাঁচটি বেসিক বিষয় এমন ভাবে মনের গভীরে ঢুকিয়ে দেবে যে সারা জীবনেও সেটা যাতে ভুলে না যায়। বিষয়ের স্ট্যান্ডার্ড নমুনা স্বরূপ কাজ করে ! পাঁচটি বিষয়ের ভেতর হাজারো বিষয় এক সাথে জানা যায় ! শুধু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বাকিটা দেখতে হয় !

সরকারি বা বেসরকারি, সব স্কুলেই মোটামুটি একই পাঠদান পদ্ধতি। জুতার ফিতা লাগানো থেকে শুরু করে সব কাজ নিজে করতে শেখানো, বাবা-মা কে বাসার কাজে সাহায্য করতে শেখানো, সবকিছুই এদের কাছে শিক্ষার মধ্যে পড়ে। নয় বছর বয়সে বাচ্চারা পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মত সাবলম্বী হয়ে যায়।

জাপানের স্কুল কলেজের পড়ালেখাও ইউরোপের মতোই বাস্তবমুখী। জাপানে প্রথম দেশব্যাপী পরীক্ষা হয় টুয়েলভ গ্রেডের সময়। এটাকে সেন্টার পরীক্ষা বলে। পরীক্ষা হয় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, দুই দিনেই শেষ, শনি রবি দুই ছুটির দিনে। পুরা দেশব্যাপী একই সময়ে, একই প্রশ্নে। এত বড় পরীক্ষার জন্য, স্কুল কলেজে একটা দিনও ছুটি থাকেনা, দরকারও হয় না।

আজ আমরা বাস করছি "আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স" বা "কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা"র যুগে। তাই পুরাতন শিক্ষা ব্যবস্থা তাই অকার্যকারী এখন। চাই নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা।

শিক্ষাব্যবস্থায় এক অভূতপূর্ব ও মৌলিক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে ফিনল্যান্ড। বিশ্বে তারাই প্রথম এ যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করতে চলেছে। কিন্তু কেমন সে শিক্ষা ব্যবস্থা?

৯০ এর দশকে সুইডেনে "টেমা" Tema সিস্টেম নামক শিক্ষাব্যবস্থার আবির্ভাব হয়। পরবর্তীতে ফিনিসীয়রা এটা লুফে নেয়। এই শিক্ষা ব্যবস্থ্যায় যে কোন একটা বিষয় নিয়ে সর্বাঙ্গীণ লেখাপড়া করতে হয়। সেটার উপরে থিসিস পেপার তৈরী করতে হয়। তারপর শ্রেণীকক্ষে সবার সামনে বিচার বিশ্লেষণ করতে হয়। এই শিক্ষা ব্যবস্থ্যায় সিলেবাসের বইপত্র থাকে না। নিজেরাই প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করে থিসিস বানিয়ে নিতে হয়। তাই অপ্রয়োজনীয় লেখাপড়ার কোন প্রয়োজন পড়ে না।

শিক্ষকেরা কেবল কাজ করেন পরামর্শদাতা হিসেবে। ছাত্ররা যেখানে খুশি বসে স্কুলের কম্পুটারের বিশেষ ফাইলে আপডেট করেন ও শিক্ষক সেদিকে খেয়াল রাখেন ও প্রয়োজনে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অনেকটা প্রাচীন ভারতের টোল সিস্টেম এর মতোই।

ফিনল্যান্ডের নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় বিষয়ভিত্তিক পাঠদান থাকছে না সেখানে। ছাত্র ছাত্রীর ১৬ বছর বয়সের পর পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, অংক এসব স্বতন্ত্র বিষয় (individual subject ) কে বিদায় করে দেয়া হবে নতুন এই শিক্ষা ব্যবস্থায়। দেশটির শিক্ষা বিভাগের পক্ষে বলা হচ্ছে যে প্রয়োজনে ১৯০০ সালের পর বিদ্যমান পদ্ধতির সূচনা হয়েছিল আজ আর তার প্রয়োজন নেই। এখন নতুন যুগ, নতুন চাহিদা, নতুন পদ্ধতি।

এখন থেকে বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা নয়। পড়াশোনা হবে ' ঘটনা ও পরিপ্রেক্ষিত ' অনুযায়ী। প্রথাগতভাবে ক্লাসে বসে ব্ল্যাকবোর্ড সামনে রেখে নয়। ছাত্র-ছাত্রীরা পড়বে গ্রূপ গঠন করে। অনেকটা study-circle এর মত।

যেমন ছাত্রদের একটা গ্রূপ ' ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ' কে পড়তে চায়। তারা তখন ইতিহাস বই এর দ্বারস্থ হবেনা। কীভাবে পড়বে তবে তারা?

প্রথমে তারা পড়বে, মুক্তিযুদ্ধ - ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত। এখানে ছাত্রদের ' ইতিহাস ' পড়া হয়ে যাবে। তারপর মুক্তিযুদ্ধ - অর্থনৈতিক প্রক্ষাপট। ছাত্রদের এখানে ' অর্থনীতি' পড়া হয়ে যাবে। এরপর মুক্তিযুদ্ধ - সামাজিক প্রেক্ষাপট। এই অংশ থেকে তারা পাঠ নেবে ' সমাজ বিজ্ঞান ' এর। পরিশেষে মুক্তিযুদ্ধ - রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এখানে তাদের ' রাষ্ট্রবিজ্ঞান ' পড়া হয়ে যাবে।

অর্থাৎ শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের বিষয়টা বিষয়ভিত্তিক অর্থাৎ ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদির হাত ধরে এগোবে না। এটা আবর্তিত হবে ঘটনা বা ইভেন্টের এর হাত ধরে।

অভিনব সন্দেহ নেই। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা, পরীক্ষা -নীরিক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। সঠিক প্রয়োগের অপেক্ষা। এর খুঁটিনাটি জানা যায়নি এখনো। প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর দেয়া যাবেনা তাই। বরং পরিবর্তনের মর্মকথাটি বোঝার চেষ্টা করি আমরা। বোঝার চেষ্টা করি কেন এই পরিবর্তন প্রয়োজন?

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান (Open AI) এর তৈরি বহুল আলোচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফটওয়্যার "চ্যাট জিপিটি" মিনেসোটা ইউনিভার্সিটি ল স্কুলে আইন বিষয়ক একটি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল।

পরীক্ষায় সাংবিধানিক আইন, ফৌজদারি আইন, আন্তর্জাতিক আইন, চুক্তি আইন, ভূমি আইন, কোম্পানি আইন থেকে শুরু করে আয়কর আইনের উপর ৯৫টি বহুনির্বাচনী প্রশ্ন ও ১২টি রচনামূলক প্রশ্ন চ্যাট জিপিটি-কে প্রদান করা হয়েছিল।

পরীক্ষায় চ্যাট জিপিটি অনেক শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করেছে। গ্রেড পেয়েছে C+। বলা হয়েছে অচিরেই চ্যাট জিপিটির আপডেটেড ভার্সন আসছে যা হবে আরো বেশি সৃষ্টিশীল এবং আরো অধিক বুদ্ধিসম্পন্ন।

সন্দেহ নেই আগামী পৃথিবী হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) এর। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তির সাথে শিক্ষাব্যবস্থা এবং মূল্যায়ন পদ্ধতির সমন্বয় করতে না পারলে জ্ঞানবিজ্ঞানে আধুনিক দুনিয়া থেকে পিছিয়ে পড়তে হবে।

যে তথ্য বইয়ে লেখা আছে বা নেট বা মেমোরিতে সংরক্ষিত আছে সেটি মুখস্ত করে খাতায় লিখতে পারা-কে একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই এর মাপকাঠি করার পদ্ধতিকে পৃথিবীর অগ্রসর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইতোমধ্যে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।

যদিও আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজও সেকেলে মুখস্ত নির্ভর বর্ণনামূলক প্রশ্নের উত্তর লেখার পদ্ধতিতে পড়ে আছে।

যদি বহুল আলোচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফটওয়্যার "চ্যাট জিপিটি" কে বাংলাদেশের বর্তমান বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়, সম্মিলিত মেধাতালিকায় এর প্রথম হওয়া কি কেউ ঠেকাতে পারবে?

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়