SAHA ANTAR

Published:
2023-11-19 12:22:30 BdST

গণহত্যা নাকি মানবতার হত্যা



সারা জেসমিন

মন্ট্রিল কানাডা থেকে

এক. প্রতিটি মানুষ, জাতিগোষ্ঠী বা দেশের ই রয়েছে তাদের নিজ নিজ পরিধি তে বেঁচে থাকার ,স্বাধীনতা সারভৌমত্ব রক্ষার অধিকার যেটা মানুষ প্রাচীন কাল থেকেই নানা ভাবে করে আসছে! যুদ্ধের হাতিয়ারের বিবর্তনের সাথে সাথে তার প্রাগোয়িকতার মাত্রা ও ধরণ পাল্টেছে। সেটা কখনো হয়েছে আত্মরক্ষামূলক, কখনো বা সশস্ত্র সংগ্রাম যেটা আইনি ভাবে বৈধ ও স্বাধীনতা-সম্মানের লড়াই হিসেবেই স্বীকৃত। সুতরাং আত্মরক্ষার জন্য লড়াই প্রাকৃতিক এবং বৈধ। আত্মপক্ষ সংরক্ষন বা সশস্ত্র সংগ্রামে স্বভাবতই দুটো পক্ষ থাকে-আত্মপক্ষ সমর্থনকারী ও আক্রমণকারী পক্ষ ! আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আজ অব্দি চালু আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার আইনে আক্রমণকারীকে অবশ্যই তার অবৈধ আক্রমণ বা সহিংসতার দায়ভার নিতে হবে যদি তা মানবাধিকার ও যুদ্বাপরাধীর দায়ে বিবেচিত হয়। এই দায়ে তাকে আন্তর্জাতিক আইন ও বিচার কাঠামোর মধ্য দিয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। International Court of Justice যেটা করে থাকে। কিন্তু এখন কি দেখছি আমরা? গত ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের মারাত্মক আক্রমণ (আত্মরক্ষার জন্যও যা সমর্থন যোগ্য নয় )ও তার প্রতিশোধ বা counter-attack হিসেবে ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন ও বিচার কাঠামোর তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে গাজার অবরুদ্ধ অঞ্চলে অবিরাম বোমা বর্ষণ ও নিরীহ নাগরিকদের হত্যা করছে। সবচেয়ে দূ:খজনক বিষয় হচ্ছে যে এদের পালাবার ও কোনো পথ নেই. এটা কোন ধরণের সভ্ভতা? ইসরাইল কি আন্তর্জাতিক আইন ও বিচার কাঠামোর বাইরে?

ইসরাইলী কর্তৃক এ পর্যন্ত যেভাবে হাজার হাজার গাজাবাসীদের গণহত্যা চলছে তা বর্তমান বিশ্বের অন্য সব নৃশংসতাকে ও হার মানাচ্ছে এবং তা পশ্চিমা শক্তির মদদেই হচ্ছে। মনে রাখতে হবে যুদ্ধ আর গণহত্যা এক জিনিস নয়. যুদ্ধ হয় দুই সামরিক পক্ষের মধ্যকার লড়াই, আর এখন যেটা হচ্ছে এক পক্ষের সহিংসতা! প্রায় ২০ লক্ষ নিরীহ জনগনকে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে ওপর থেকে বোমা ফেলে হত্যা করা হচ্ছে । এটাকে কি যুদ্ধ বলে ? অবশ্যই না!! আমেরিকা এখনো এ গণহত্যাকে সমর্থন দিচ্ছে এবং কূটনৈতিক তৎপরতার নামে মধ্যপ্রাচ্চে চালাচ্ছে নানা ধরণের কার্যক্রম!!
যখন ইউরোপ , আমেরিকা সহ সারা বিশ্বের শান্তি প্রিয় জনগণ, ইহুদী ধর্মাবলম্বীসহ এই ভয়ঙ্কর নৃশংস গনহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার , ইহুদী ধর্মাবলম্বী, যারা জায়নবাদী নয় (জায়নবাদীরা ইহুদী ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে ) তারাও বলছে যে ,ইহুদী ধর্মাবলম্বীরা এই গণহত্যার দায় কখনো নেবেনা, তাহলেএই যুদ্ধ কার স্বার্থে?

দুই. যে কারণ ও স্বার্থে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ইউক্রেন এর স্বাধীনতা ও সারভৌমত্ব রক্ষায় পশ্চিমা বিশ্ব সার্বিকভাবে সমর্থন দিয়েছে ,ঠিক একই কারণে পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতিসংঘর সমর্থন দেখানো উচিত ছিল ফিলিস্তিনদের স্বাধীনতা ও সারভৌমত্বর লড়াই কে-যা অনেক আগেই ন্যায্য ছিল ; কিন্তু তা ফিলিস্তিন এর বেলায় কখনই হয়নি !! আমার বেলায় ইউক্রেন যুদ্ধ হচ্ছে স্বাধীনতা ও সারভৌমত্বর লড়াই , আর তোমার বেলায় স্বাধীনতা ও সারভৌমত্ব লড়াই কে সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবে আখ্যা দেওয়া পশ্চিমা বিশ্বের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ভূমিকা কেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় - যা পশ্চিমা বিশ্ব গত শতক থেকেই করে আসছে -----আর পশ্চিমা মিডিয়া গুলো এদের ভূমিকা কে একনিষ্ঠ ভাবে পেশাদারীত্বের সাথে প্রচার করে আসছে !!
যেমন গাজায় ইসরায়েলের নারকীয় বোমাবর্ষণের পরে MSNBC এটিকে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব না বলে এই যুদ্ধ কে " দুই জাতির মধ্যে সহিংস ইতিহাস" বলে উল্লেখ করেছে যেন ফিলিস্তিন কোনো দেশ নয়। যদি তাই হয় তাহলে হামাসের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ না করে ফিলিস্তিনি জনগণকে কেন হত্যা করা হচ্ছে??
এমনকি ৭ই অক্টোবরের হামাস হামলার পর আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র অ্যাড্রিয়েন ওয়াটসন" ইসরাইল কে যুদ্ধের উস্কানি দিয়ে বলেছেন আমাদের প্রত্যেককে অবশ্যই হামাস এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে " We stand for Israel হচ্ছে বাইডেন এর কথা~~ এদের কথা-বার্তা দেখে মনে হয় ইসরাইল ফিলিস্তিনি সংঘাত একটি সাম্প্রতিক বিষয় !! যেন এই যুদ্ধের কোনো প্রেক্ষিত নেই! যেন বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনিরা হাজার বছরের বসতি স্থাপনকারী নয়!! নেই তাদের কোনো ঐতিহ্যবাঁহী অস্তিত্বের ইতিহাস।, এঁরা যেন এই অঞ্চলের রিফুজী! ইসরাইল একটি পূর্ণ্ রাষ্ট্র আর হামাস একটা জঙ্গিগ্রুপ যাদের আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই শুধু ইসরাইল সামরিক অ্যাকশন এ যাবে।এমনকি মনে হতে তে পারে যে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের ভূমিতে উপনিবেশ স্থাপন করেছে --ইসরায়েল নয়!!
অথচ এই বছরেরই ১লা জানুয়ারি থেকে ৪ অক্টোবরের মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনী বা বসতি স্থাপনকারীদের হাতে নিহত হয়েছে ২৪৮ ফিলিস্তিনি ৫ই অক্টোবর আল-আকসা মসজিদে ইসরাইল হামলা করেছে । এরকম হত্যাযঞ্জ, মানবাধিকার ও জাতীয় আকাঙ্খা নিষ্পেষণের ডান্ডা ফিলিস্তিনদের ওপর দশকের পর দশক ধরে চলছে ইসরাইল দ্বারা ;যা অস্বীকার করা উচিত নয় কিন্তু প্রপাগান্ডা চলছে এর বিপরীতেই।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট যখন বলে “আমি গাজা উপত্যকায় সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দিয়েছি। বিদ্যুৎ থাকবে না, খাবার থাকবে না, জ্বালানি থাকবে না, সবকিছু বন্ধ। আমরা মানব পশুদের সাথে যুদ্ধ করছি এবং আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করছি!! এর মানে কি সব ফিলিস্তিনিরা পশু? এই ধরনের ভাষা গাজার সমস্ত ফিলিস্তিনদের বিরুদ্ধে একজন রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি কিভাবে প্রয়োগ করতে পারে ?
তাই গ্যালান্ট এর ভাষা প্রতিরোধের ভাষা বা প্রতিরক্ষার ভাষা নয়। এটা অবশ্যই গণহত্যার ভাষা।

তিন. আসলে পৃথিবীতে কখনো কোনোকিছুই নিরপেক্ষ ছিলনা,এখনো নেই। নিরপেক্ষপতার ও একটি পক্ষ থাকে ,সেটি হতে পারে রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক। যারা প্রগতিশীলতার নামে কিছু শব্দভাণ্ডার বা প্রথা কে সাম্প্রদায়িক হিসেবে অভিহিত করেন, তারাও কোনো না কোনো মতাদর্শ কে সামনে রেখেই সেটা করেন । তাই সমস্যা কোনো মতাদর্শ , ধর্ম বা শব্দভাণ্ডারের নয় , সমস্যা রয়েছে আমাদের মগজে ,চিন্তায় আর কর্মে। কারণ প্রতিটি ধর্মেই আধ্যাত্মিক জগতের নির্দেশনা রয়েছে যা জগতের সকল প্রাণ ও প্রাণী কে ভালোবাসতে শেখায়! মানুষ কর্তন বা নিয়ন্ত্রণ নয়!! যাকে আমরা সুফিবাদ বলি! ধর্মকে আক্ষরিক অর্থে নিয়ে ব্যাখ্যা করা ও চরম উদ্দেশ্যে ব্যাবহার করা কোনও ধর্মের কর্ম নয়!

চার, নিজেকে একজন রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে, মানুষ হিসেবে ভাবলে অবশ্যই মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবার কিছু মৌলিক অধিকার ও শর্তের মধ্যে থাকতে হবে। কিন্তু পুরো এই শতক জুড়ে কিংবা এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনিরা কি সেই মানুষের মর্যাদা পেয়েছে কিংবা পাচ্ছে ? না পাচ্ছেনা!এখন তাদের কে পশুর সাথে তুলনা করা হচ্ছে দম্ভের সাথে!
ইসরাইল 1948 সাল থেকে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্র, তবুও কেন ফিলিস্তিনিদের জন্য UN কতৃক বরাদ্দ এ অঞ্চলের ৪৫ ভাগ জমির ছিটে ফোটা ও এদের দখলে থাকতে নেই?এদের কাছে এ অঞ্চলের বাকি যেটুকু জমি আছে তা দখলে কেন উন্মুখ ফ্যাসিস্ট নেতানিহায়ু সরকার ?
কেন ফ্যাসিস্ট নেতানিহায়ু মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র টাই বদলে ফেলার প্রতিশ্রুতি দেয় দম্ভ ভরে ?
কেন জো বাইডেন পৃথিবীতে নতুন একটি International Order তৈরির ঘোষণা দিচ্ছে ? সমীকরণ সবজায়গায়ই একই!যে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ১৯৪৭ সালে ধর্ম কে সামনে রেখে Divide and Rule policy প্রয়োগের মাধ্যমে ব্রিটিশ রা পুরো ভারত উপমহাদেশ কে খন্ড -বিখন্ড করে ফেলেছে,!মধ্য প্রাচ্যর বহু দেশ হয়েছে ক্ষত -বিক্ষত , তছনছ হয়েছে মানুষেরজীবনওজীবিকা;সেই একই কারণে ইউক্রেন অঞ্চলে চলছে যুদ্ধ ও বিপর্যয় , লক্ষ লক্ষ নিরীহ জনগণ উদ্বাস্তু হয়েছে, ঠিক একই কারণে এখন দুর্ভাগ্যর শিকার হছে ফিলিস্তিনএর নিরীহ জনগণ। পার্থক্য শুধু একটাই , ইউক্রেন এর জনগণ পালাবার পথ পেয়েছে , কিন্তু হতভাগ্য ফিলিস্তিনীদের পালাবার ও পথ নেই.!! হামাস এদের কে কিভাবে রক্ষা করবে সামরিক শক্তি তে শক্তিধর ইসরাইল এর কাছ থেকে সেটাই প্রশ্ন? হতভাগ্য ফিলিস্তিনীদের জাতিসংঘ যদি হিউমান করিডোর দিয়ে উদ্ধার করতে না পারে ,তাহলে আর কত প্রাণ যে যাবে , বা পুরো ফিলিস্তিন জনগণের বাঁচার আশা কতখানি তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখনই ভাবতে হবে!!

একটা উপায় হয়তো বের হবে! পৃথিবীতে আবারও শক্তির ভারসাম্য (Statas-Quo) তৈরী হবে ! শান্তি ও ন্যায় বিচার প্ৰতিষ্টিত হবে আর সেটা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
সারা জেসমিন
২৬ অক্টোবর২০২৩
মন্ট্রিল কানাডা

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়