SAHA ANTAR

Published:
2023-05-04 15:28:46 BdST

উচ্চ শিক্ষা সংকোচন নীতি নয়, উচ্চ শিক্ষা বান্ধব নীতি চাই


লেখক

 

 

ডা. আজাদ হাসান 

স্বাস্থ্য সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা পরামর্শক 

________________________

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় (MOH)এর অধীনে নিযুক্ত ডাক্তারদের বিদেশে এমআরসিপি, এমআরসিএস বা এফআরসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বহিঃবাংলাদেশ ছুটি বা ভ্রমণের জন্য পারমিশন বা অনুমোদন এর আবেদন অগ্রায়ন না করার জন্য মহাপরিচালক (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) বরাবর একটি আদেশ বা প্রজ্ঞাপণ জারী করা হয়েছে। উক্ত আদেশের পরিপ্রক্ষিতে আমি আমার গভীর উদ্বেগ এবং অসন্তোষ প্রকাশ করছি।

উক্ত আদেশটি অন্যায্য হওয়ার পাশাপাশি, এধরণের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর হবে। এ ধরনের পদক্ষেপ এমওএইচ-এর অধীনে কর্মরত সরকারী চিকিৎসকদের পেশাগত উৎকর্ষতা অর্জনে বা উন্নয়নে বাধাগ্রস্থ করবে এবং তাদের উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অনুমতি না দিয়ে প্রকারান্তে দেশের রোগীদের উচ্চমানের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা তাঁদের পক্ষে আরও কঠিন করে তুলবে।

প্রসংগত উল্লেখ্য, পাশ্চাত্যের ডিগ্রি এমআরসিএস, এমআর -সিপি, এফআরসিএস প্রভৃতি পরীক্ষা নিয়ে দুটি কথা বলা প্রয়োজন। এ ডিগ্রীসমূহ আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি, ফলে এসব ডিগ্রীর মূল্যায়ন বিদেশে অনেক বেশি।

আমাদের দেশের প্রচলিত উচ্চশিক্ষার ডিগ্রীসমুহ নিয়ে বিদেশের খুব বেশি দেশে স্বচ্ছন্দে চাকুরী পাওয়া যায় না। বিলেতের উক্ত ডিগ্রি সমূহ নিয়ে বিদেশে চাকুরী করতে গেলে সেখানকার চাকুরীর ক্ষেত্রে খুব সহজে এপ্লাই করা যায়। আর তাই বিদেশের জব মার্কেট ধরা সম্ভব হলে বরং বেশি বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। যা প্রকারান্তে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে উল্লেখ যোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

উল্লেখ্য দেশে বসেই এমআরসিপি, এমআরসিএস এসব ডিগ্রির প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের (লিখিত) পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হলেও কিন্তু শেষ পর্বের ব্যবহারিক (প্রাকটিক্যাল পার্ট) পরীক্ষা যুক্তরাজ্য সহ নির্দিষ্ট কয়েকটি আন্তর্জাতিক পরীক্ষা সেন্টারে (বিদেশে) যেয়ে দিতে হয়।

প্রসংগত উল্লেখ্য, এসব ডিগ্রী সমূহ শেষ করার একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা (টাইম ফ্রেম) রয়েছে। যেমন,
★ এম আর সি পি প্রথম পর্ব থেকে শেষ পর্ব সর্বোচ্চ সাতবার দেয়া যায়। প্রথম পর্ব শুরু করার সাত বছরের ভেতর পুরো ডিগ্রিটি শেষ করা বাধ্যতামূলক। নয়তো কোর্স আউট বা কোর্স থেকে বিচ্যুত হতে হয়।
★ এম আর সি এস ঠিক একই রকম। প্রথম পর্ব চার বার দেয়া যায়। দ্বিতীয় পর্বও চারবার। শুরু করার সাত বছরের মধ্যে শেষ করতে হয়।
এম আর সি এস’র শেষ পর্ব (প্রাকটিক্যাল পার্ট) চার বারের প্রচেষ্টার মধ্যে শেষ করতে হয়। নচেৎ বিদায়।

যাঁরা এসব পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁদের সবাই এই প্রক্রিয়ার / প্রচেষ্টার শেষ পর্যায়ে রয়েছেন।

বিশ্বের সীমিত কিছু কেন্দ্রের মধ্যে পরীক্ষার সেন্টার হওয়ার নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে আসন প্রাপ্তি একটি চ্যালেঞ্জ। সব সময় সব কেন্দ্রে পরীক্ষার সুযোগ পাওয়া যায় না। যুক্তরাজ্য, ভারত, শ্রীলংকা, মিশর, দুবাই, ওমান প্রভৃতি দেশের সেন্টারে শেষ পর্ব বা প্রাকটিক্যাল পার্ট পরীক্ষা দেয়া যায়। কিন্তু ফাইনাল পার্ট /শেষ পর্ব পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য সীট পাওয়া বর্তমানে বেশ কঠিন। কারণ, কেন্ডিডেট এর তুলনায় সীট সংখ্যা সীমিত। তাছাড়া যে দেশে পরীক্ষা সেন্টার সেই দেশের কেন্ডিডেটরা সীট পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন। ঐসব দেশের নিজস্ব কেন্ডিডেটদের মাঝে সীট বরাদ্দ দেয়ার পর সীট অবশিষ্ট থাকলে তখন ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের মাঝে অবশিষ্ট সীট বরাদ্দ করা হয়।

আর এজন্যই কখনো কোন কেন্দ্রে আসন পাওয়া গেলে সাথে সাথে ফি পরিশোধ করতে হয়। ফি’র পরিমান আকাশচুম্বী। ডলার সংকটের এ যুগে ফি’র পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। পরীক্ষা ভেদে বর্তমানে এ পরীক্ষার ফি এক লক্ষ বিশ হাজার থেকে দু লক্ষ সত্তর হাজার টাকা। কঠিন এসব পরীক্ষার দু'টি ধাপ পার করে, সিট পেয়ে, মোটা অংকের ফি পরিশোধ করে পরীক্ষা দিতে না পারলে তাঁদের বিগত পাঁচ সাত বছরের প্রচেষ্টা বিফলে যায়। প্রচুর সময় নষ্ট হয়। অনেক অর্থ বিনষ্ট হয়। ডলার বাঁচাতে পরীক্ষা দেয়ার জন্য এঁদের বিদেশ সফর স্থগিত করলে পূর্বে লগ্নিকৃত অর্থ ও শ্রম - দু'টোই জলে যাবে এবং পরীক্ষার্থীদের সকল চেষ্টা পন্ড শ্রমে পর্যভূষিত হবে।

বর্তমানে বহিঃবিশ্বে আমাদের দেশের মানুষের দারুণ ইমেজ সংকট আছে। আমাদের দেশ হতে বহিঃবিশ্বে যত টেকনিক্যাল এক্সপার্টরা যাবেন ততই দেশের ভাবমূর্তি ইতিবাচক পরিবর্তন করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।

এমতাবস্থায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ বৈশ্বিক দুর্মূল্যের প্রেক্ষিতে বিদেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে যাঁরা এসব পরীক্ষায় ফি পরিশোধ করেছেন বা পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি পত্র পেয়েছেন তাঁদের নিজ খরচে বিদেশ গিয়ে পরীক্ষার সুযোগ দান করতে বিবেচনা করা উচিৎ। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে কখনই বাধা প্রদান করা কাম্য নয়। আর সেই উচ্চ শিক্ষা যদি নিজ খরচে হয়, তাহলে তাতে বাধাগ্রস্থ করার প্রশ্নই উঠে না।

উপরন্তু সরকারের, এই আদেশটি ন্যায্য সুযোগ এবং যোগ্যতার মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে যায়। প্রতিটি ডাক্তার -এর উচ্চ শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের জন্য আবেদন করার অধিকার থাকা উচিত, তারা এখন যেখানেই কাজ করুক না কেন। আমি এই আদেশের তীব্র নিন্দা জানাই এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে চিকিৎসকদের উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পথের স্বার্থ বিরোধী এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য অনুরোধ করছি।

সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ বিভাগ বিশ্বব্যাপী ডলার সংকটের প্রেক্ষিতে অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর বাতিল করে, দেশের স্বার্থে "নিজ খরচে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের নিমিত্তে বিদেশ সফরকে প্রয়োজনীয় ঘোষণা" করতে পারে। উচ্চশিক্ষায় উৎসাহ দিতে বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করবে বলে প্রত্যাশা করি।

স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের উন্নতির সম্ভাবনা সংকুচিত করার পরিবর্তে, সরকারের পক্ষে চিকিৎসকদের জন্য উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিৎ বলে মনে করি।

সিওমেক-২১।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়