SAHA ANTAR

Published:
2023-03-06 10:42:25 BdST

কথাসূত্র :লন্ডনে তখন বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করি এক ইহুদী প্রতিষ্ঠানে


 

রাজিক হাসান
________________________

লন্ডনে তখন বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করি এক ইহুদী প্রতিষ্ঠানে। সেখানেই পরিচয় পারভেজ নামে এক ইরানি মুসলিমের সাথে। কথা প্রসঙ্গে পারভেজ জানাল, পৃথিবীতে একমাত্র ইসলামিক দেশ ইরান, যেখানে ইসলাম সত্যিকার অর্থে টিকে আছে। আলজেরিয়ান ছেলেটি সায় জানাল পারভেজের কথাতে। সেও তাই বিশ্বাস করে। আমি শুনছিলাম ওদের কথা। কথা প্রসঙ্গে আমার রাজিক হাসান নাম শুনে পারভেজ জানতে চাইল আমি শিয়া কি না। আমি মুচকি হেসে জবাব দেই, সুন্নি। পারভেজ তখন আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলে, ওহ তুমি মুসলিম না, তুমি সুন্নি। অবাক দৃষ্টিতে আমি ওর দিকে তাকালাম, সুন্নি মুসলমান না? সে বলে; দেখো তোমাদের হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না।
"প্রতিষ্ঠিত ধর্ম একসময় দ্বন্দ্বে দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ হয়ে যায়। ধর্মপ্রচারকদের চরিত্র ও আচরণ অধ:পতিত হতে হতে লোকনিন্দার খোরাক হয়ে ওঠে আর তাই সমাজে অজ্ঞানতা, নির্বুদ্ধিতা ও বর্বরতা নেমে আসে।" কথাটি ফ্রান্সিস বেকনের। 'অফ স্টাডিজ' (১৫৯৭) নামক এক বিখ্যাত প্রবন্ধে ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) লিখেছেন আজ থেকে পাঁচশত বছর আগে।
কথাটি ইউরোপের জন্য শতভাগ সত্যি হয়েছে। এই কথাটি দিয়ে তিনি ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতির কথা সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়েছেন। তাঁর উদ্ধৃত বাক্যটি যেন আমাদের বর্তমান সময়ের নির্ভুল বাস্তবতার প্রতিফলন।
ফ্রান্সিস বেকন নাস্তিক ছিলেন না, তাঁর লেখায় বরং নাস্তিকতার কঠোর সমালোচনাই আমরা দেখি। সেখানে ধর্ম বাঁচাতে ধর্মের ভেতর সংহতি ফেরানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি। কিন্তু তারপরও ধর্ম সম্পর্কে প্রকৃত সত্য উচ্চারণে একটুও দ্বিধা নেই তার। যা সত্য তাই যেন বলতে পেরেছিলেন অনায়াসে।
বেকনের পরামর্শ অবশ্য উপমহাদেশের শোনেনি কেউ। কারণ তাঁর পরামর্শ ছিল - ধর্মের ভাঙন ঠেকাতে ধর্ম সংস্কারের প্রয়োজন। কিন্তু ধর্মগুলো অনেকটা বিধিবদ্ধ হওয়ায় সংস্কার চেষ্টা সেভাবে সফল হয়নি, বিভেদই বাড়িয়েছে কেবল।
সঙ্গত কারণে সংস্কারের কথা ভাবেনি কেউ। যেন আশংকা তাদের, যে কোন সংস্কার ধর্মের মূল ভিত্তি দুর্বল করে দেবে, শেকড়চ্যুতি ঘটাবে তার এবং পরিণামে ধর্মাশ্রিত প্রথাগুলো ক্রমে ক্রমে মান্যতা হারাবে। ধর্মসংস্কার অসম্ভব অন্য আরেকটা কারণেও। বর্তমান সময়ে জনপ্রতিনিধিদের মতো ঈশ্বর দ্বারা মনোনীত বা নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি ( নবী/ রসুল / অবতার) ইত্যাদি পাবার সম্ভাবনাও আর নেই। মধ্যযুগের মত আর ধর্ম নিয়ে আসবেন না কেউ। ধর্ম সংস্কারের জন্য কে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত বা কে বৈধ এই মিমাংসা না করে সংস্কার হবে কীভাবে?
যে ধর্মের প্রয়োজনীয় সংস্কার বিধিনিষেধের কারণে সম্ভব না, তা কি করে বর্তমানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে? তাহলে সেটি সাংঘর্ষিক হবেই এবং ধার্মিকরা আধুনিকতা ও বিজ্ঞানের সুফল ঠিকই ভোগ করবে কিন্তু তা মানবে না। এখানেই যতো ঝামেলা! এই সমস্যা আজ পৃথিবীময়- তথাকথিত শিক্ষা(!) সত্বেও অন্ধ বিশ্বাস বনাম বর্তমান বাস্তবতা!
সুতরাং উপায় নেই বেকন সাহেব, আপনার ধর্ম সংস্কারের প্রস্তাব উপমহাদেশের কেউ মানতে পারবে না। কারণ এখানে সংস্কার করলেও বিপদ না করলেও বিপদ। সংস্কার করলে মৌলিকত্ব হারিয়ে একদিন তা লুপ্ত হবে আর সংস্কার না করলে প্রয়োগ যোগ্যতা কমতে কমতে একই পরিণতির দিকে এগোবে।
রাজা রামমোহন বিদ্যাসাগররা একসময় হিন্দু ধর্মের সংস্কারে ব্রতী হয়েছিলেন ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রবল বাধা সত্বেও। হয়েওছিল সতীদাহ প্রথা রদ কিম্বা বিধবা বিবাহের মতো কিছু সংস্কার। কিন্তু মজার বিষয়টা দেখুন এই দেড়শো বছর পরে আমার দেশের একটা বড় অংশের হিন্দু আবার সেই পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করেছে এবং এতে প্রত্যক্ষ মদত দিচ্ছে ধর্ম এবং ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবসায়ীরা। এই উপমহাদেশে ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না।
এশিয়ার একটি দেশের উদাহরণ দিই। ২০০৫ সালে দঃ কোরিয়ায় খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ আর ধর্মে অবিশ্বাসীর অনুপাতটা ছিল প্রায় ৪০-৪০-২০ এর কাছাকাছি। এর তের বছর পরে ২০১৮-এ এসে অনুপাতটা হয়ে গেছে প্রায় ৩০-৩০-৪০ এর মতো। এই নিয়ে কোরিয়াতে কোন সমস্যা হয়েছে বলে শোনা যায় নি।
আমার পরিচিত এক কোরিয় ভদ্রলোক, যিনি নিজে অবিশ্বাসী গোত্রের, বিয়ে করেছেন খ্রিস্টধর্মের অনুসারীকে। এই যে দুই মত - কোন অসুবিধা হয় না? আমার প্রশ্নের উত্তরে কোরিয় ভদ্রলোক বললেন - অসুবিধা আর কী, রোববার সকাল হলেই বউ টেনে নিয়ে যায় চার্চে। তার মত করে আমিও হাত জোড় করে বসে থাকি।
- তুমি তো বিশ্বাসই কর না, তাহলে?
- তা হোক, সপ্তাহের একটা দিনই তো। সংসারের শান্তি রক্ষার জন্য এটুকু না হয় করলামই।
এমন চিত্র অনেক দেশেই পাওয়া যাবে। এই যে কোরিয় ভদ্রলোকের স্যাক্রিফাইস, এটুকু আমাদের মধ্যে কয়জন করতে রাজি আছি? বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেও কেউ যদি অবিশ্বাসী হয়ে যায়, তাহলে তাকে দোষী করার কোন কারণ তো খুঁজে পাই না। যদিও এর উল্টোচিত্রই আমাদের মধ্যে প্রবলভাবে দৃশ্যমান। পড়লাম না কিছুই, আমার ধর্মের একটুখানি জেনে, তাও ধর্মগুরুদের মুখনিঃসৃত বাণীর মাধ্যমে, লম্ফঝম্প শুরু করে দিলাম - আমারটাই সেরা। এটাই সত্যি, আর সব মিথ্যা। জানি না আমাদের কী হবে। সুড়ঙ্গের শেষে আলো সত্যিই আছে কি না তাও জানি না।
ধর্মের প্রগতিশীল ভূমিকার কথা যখন কেউ বলেন এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে তখন অবাক হই। ভাবি এরা কি কেউ সমাজ প্রগতির ইতিহাস পড়েনি? প্রগতির রথ কোন ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এগোয় না, এগোয় সমাজের দ্বান্দ্বিক বিকাশের সুনির্দিষ্ট শর্ত মেনে। আজকের বিশ্ব ধর্মান্ধদের যে বর্বরতা প্রত্যক্ষ করছে তা মানব সভ্যতার উপর তাদের শেষ মরণ কামড়।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়